ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবল প্রেম ও আমাদের 'নান্দনিক' রসিকতা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ফুটবল নিয়ে ট্রল করতে হলে বাফুফের কর্তাদের নিয়ে করুন, যারা গদিতে বসে থেকে দেশের ফুটবলটাকে ধ্বংস করছেন। যে লোকটা কাজ করার চেষ্টা করছেন, তাকে অন্তত এই একটা ব্যাপারে ট্রল থেকে মুক্তি দিন...
বায়ার্নের কাছে আট গোল হজম করার পরেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, বার্সেলোনার ডাগআউটে কোচ সেতিয়েনকে আর দেখা যাবে না। বাংলাদেশের ফুটবল গ্রুপগুলোতে তখন অনেকেই মজা করে ট্রেন্ড চালু করেছিলেন, ব্যারিস্টার সুমনকে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে দেখতে চাই! কয়েকজন তো অতি উৎসাহী হয়ে ফটোশপে ছবি এডিটও করে ফেলেছিলেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট বার্তামেউ'র সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর শেষে জার্সি বুঝে নিচ্ছেন ব্যারিস্টার সুমন! সেই ছবি বা পোস্টগুলো টানা কয়েকদিন আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে।
তবে একটু গভীরভাবে যদি ভাবতে যান, এসব ট্রলকে অর্থহীন মনে হবে আপনার কাছে। না, বার্সেলোনাকে নিয়ে ট্রল করাটা অর্থহীন না, যে দল নব্বই মিনিটে আট গোল হজম করে, তাদের নিয়ে হাসিঠাট্টা হবেই। তবে সেটার সঙ্গে ব্যারিস্টার সুমনকে জড়িতে ফেলাটা বেশ দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ব্যারিস্টার সুমন যদি এযাবৎকালে একটা ভালো কাজও করে থাকেন, সেটা হচ্ছে ফুটবল অ্যাকাডেমি খুলে তৃণমূল থেকে ভালো ফুটবলার তুলে আনার কাজ শুরু করাটা। দেশের ফুটবলের উন্নতি চান তিনি, সেকারণেই এতসব করছেন। তার ফুটবলপ্রেম নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা খুবই বাজে একটা দৃষ্টান্ত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সুমন আলোচনায় এসেছিলেন বিভিন্ন সমস্যা বা অনিয়মের দৃষ্টান্ত ফেসবুকে তুলে ধরার মাধ্যমে। কোথাও কোন অসঙ্গতি দেখলেই ফেসবুক লাইভে চলে আসতেন তিনি, নিজের স্বভাবসুলভ বাচনভঙ্গিতে সেটা তুলে ধরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি একটা সময়। তারপর যা হয়, ব্যারিস্টার সুমনকে নিয়েও সবাই দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল, তিনি অমুক বিষয়ে কথা বলেন, তমুক বিষয়ে কেন বলেন না টাইপের অভিযোগ আসা শুরু হলো। সুমন সাহেবও নিজের নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পারলেন না, অনেকেই তাকে আখ্যায়িত করলো ফেমসিকার, ফুটেজখোর হিসেবে।
সমাজ সংস্কারের পথ ছেড়ে করোনাকালে ব্যারিস্টার সুমন বেছে নিলেন ফুটবলকে, নিজের এলাকা হবিগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করলেন ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমি। ফুটবলটা তিনি নিজেও বেশ ভালো খেলেন, খেলাটার প্রতি তার একটা প্যাশন আছে। এর আগেও তিনি এলাকার শিশুদের মধ্যে খেলার সামগ্রী বিতরণ করেছেন, মাঠ মেরামত করে দিয়েছেন, নিজের খরচে টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছেন। তবে তার এবারের উদ্যোগটা ছাপিয়ে গেছে অতীতের সবকিছুকে।
এলাকার তরুণদের বাছাই করেছেন তিনি একাডেমির জন্য। করোনায় সারাদেশ যখন বিপর্যস্ত, তখন তার একাডেমিতে জোরেশোরে চলেছে অনুশীলন। দূর-দূরান্ত থেকে তরুণরা এসেছে একাডেমিতে অডিশন দিতে, যশোর থেকে এক কিশোর লকডাউনের মধ্যে চারশো কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে চলে এসেছে ফুটবল খেলবে বলে! ঢাকা থেকে কোচ, ফিটনেস ট্রেনার নিয়ে গেছেন ব্যারিস্টার সুমন, যাতে একাডেমির তরুণরা সেরা সার্ভিসটাই পায়।
একশোর বেশি তরুণ ফুটবলার এখন ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবল একাডেমির অংশ। কোচ-সহকারী কোচের পাশাপাশি এদের জন্য অভিজ্ঞ অ্যানালিস্ট আনা হয়েছে, যিনি প্রতিটা ফুটবলারকে নিয়ে বিশ্লেষণী রিপোর্ট করেন। আছে গোলরক্ষকদের জন্য আলাদা কোচ। জিমনেশিয়াম স্থাপনের কাজ চলছে, এমন অত্যাধুনিক জিমনেশিয়াম বাফুফেরও নেই! পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুব শিগগিরই অ্যাকাডেমিতে ইউরোপিয়ান কোচ আনা হবে বলেও জানানো হয়েছে। এই অ্যাকাডেমি নিয়ে ব্যারিস্টার সুমন কতটা ডেসপারেট, সেটা তার কথাবার্তা শুনলেই বোঝা যায়। নিজের খামারের গরু বিক্রি করে হলেও তিনি অ্যাকাডেমি চালাতে চান বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন একবার।
ব্যারিস্টার সুমনের বার্সেলোনার কোচ হওয়া নিয়ে যখন ফেসবুকে ঠাট্টা তামাশা চলছে, তখন এক সাংবাদিক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এই রসিকতার ব্যাপারে। ব্যারিস্টার সুমন খুব স্পষ্ট ভাষাতেই বলেছিলেন, এই রসিকতা করে কেউ আনন্দ পেলে পাক, তার আনন্দে আমি বাধা দেব না। কিন্ত ঠাট্টা করার সাথে সাথে দেশের ফুটবলের দুরবস্থার কথাও একটু ভাবেন। কাজী সালাউদ্দিন সাহেব গত বারো বছর ধরে ফুটবলটাকে কোথায় নিয়ে গেছেন, র্যাংকিংয়ে আমরা এখন কত নাম্বারে, সেসবের খোঁজটাও নেন। বার্সেলোনা-রিয়াল মাদ্রিদকে আপনি ভালোবাসতেই পারেন, সেই সাথে দেশের ফুটবলের খোঁজটাও একটু রাখেন দয়া করে।
ব্যারিস্টার সুমনের অনেক কাজই সমালোচনার যোগ্য, তাকে নিয়ে ট্রল করতেই পারে যে কেউ। কিন্ত অনেকটা নিঃস্বার্থভাবে তিনি ফুটবলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন, এই ব্যাপারটাকে সম্ভবত রসিকতার রাডারের বাইরেই রাখা উচিত। ট্রল যদি করতেই হয়, কাজী সালাউদ্দিনকে নিয়ে করেন, যার অধীনে বাংলাদেশের ফুটবল ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে শুধু, এখনও পিছিয়ে চলেছে, তবুও তিনি পদ আঁকড়ে ধরে রেখেছেন! ট্রল করতে হলে বাফুদের কর্তাদের নিয়ে করুন, যারা গদিতে বসে থেকেও কোন কাজ করছেন না। যে লোকটা কাজ করার চেষ্টা করছেন, তাকে অন্তত এই একটা ব্যাপারে ট্রল থেকে মুক্তি দিন...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন