সুলতান কাবুস ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু। ওমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খোলার ব্যাপারে তার ভূমিকা ছিল অপরিসীম...

ফারুক হোসাইন: ২০১৪-তে আমার ওমান আগমন। কাজের প্রয়োজনেই ছিল দুবাই-মাস্কাট-সালালা দৌড়ঝাঁপ। দুবাই বরাবরই ছিল আমার কাছে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া খাজা একটা শহর। চতুর্দিকে কৃত্রিমতার ছড়াছড়ি। এমনকি সমুদ্র উপকূলও যেন শান বাঁধানো পাড়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যও যেন এখানে কৃত্রিমতার চাদরে ঢাকা।

তারচেয়েও বড় কথা দুবাইসহ অন্যান্য আরবীয়রা আমাদের মিসকিন হিসেবে দেখে। তাদের চাহনিতে স্পষ্টতঃ থাকে ‘করুনা’ নচেৎ ‘ঘৃনা’ অথবা ‘অবজ্ঞা’। সে তুলনায় ওমানিদের চাহনি সম্পূর্নই ভিন্ন। ওরা আমাদের হয় ‘বন্ধু’ নচেৎ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী' হিসেবে দেখে। করুনা, ঘৃনা বা অবজ্ঞার কোন স্থান এখানে নেই। এই ফারাকের কারন শুধু অর্থনৈতিক নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে ওমানীদের প্রাচীন ইতিহাস। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ধর্ম সবসময়ই বিশাল ভুমিকা রাখে। ওমানও ব্যাতিক্রম নয়। আর সে কারনেই অন্যান্য আরবীয়দের থেকে তাদের রয়েছে ভিন্নতা।

ইসলাম ধর্মের সবচেয়ে ক্ষুদ্র ভাগের নাম ‘খারেজি’। বর্তমানে যারা ‘ইবাদি’ নামে বেশি পরিচিত। সমগ্র মুসলিম জনসংখ্যার মাত্র ১% ইবাদি। অথচ এই সংখ্যালঘু দলটি বিশ্বের একটি দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেটা হচ্ছে ‘ওমান’। মূলত খলিফা নির্বাচনে কুরাইশ গোত্রের প্রাধান্য ও আরব-অনারবের মধ্যে পার্থক্যের বিরোধিতার কারনেই খারেজিদের জন্ম।

সুলতান কাবুস

আমি আজ এক ইবাদি বীরের গল্প বলতে চাই। সেই বীরের নাম সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আল সাঈদ। সংক্ষেপে সুলতান কাবুস। যিনি ১৯৭০ সালের ২৩ জুলাই একটি অনুন্নত দেশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যে দেশটি ছিল সেই সময়ের বাংলাদেশ থেকেও বেশি পশ্চাৎপদ। গুটিকয়েক অট্রালিকা, মাত্র ছয় মাইল পাকা রাস্তা (অথচ ওমানের আয়তন বাংলাদেশের দ্বিগুনেরও বেশি), অধিবাসীদের জীবিকা বলতে মাছ ধরা ও কৃষিকাজ, আর স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সেই শূন্য থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ওমান তৈরীর কারিগর হচ্ছেন সুলতান কাবুস।

শুধু সফল কারিগর বললে ভুল হবে। তিনি ছিলেন কূটনৈতিক কলাকৌশলেও বেশ দক্ষ। যে কারনে বরাবরই সুলতান কাবুস ছিলেন ইরান ও আমেরিকার মাঝে মধ্যস্থতাকারী। দুটো দেশ প্রধানের কাছেই ছিল তাঁর ঈর্ষনীয় গ্রহনযোগ্যতা। ২০১১ সালে ইরানে বন্দী তিনজন মার্কিনবাসীকে সুলতান কাবুসের কল্যানেই মুক্ত করতে পেরেছিল আমেরিকা।

এমনকি আরব বিশ্বের শক্তিধর সৌদি আরব ২০১৫ সালে যখন ‘আরব জোট’ গঠন করে ইয়েমেনকে শায়েস্তা করার জন্য, সেখানে সুলতান কাবুস অংশগ্রহণ করেননি। ইয়েমেনের নিরীহ জনগন বরাবরই ওমানের সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে। এটা মহামান্য সুলতানের মানবিকতা ও সাহসিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ। যে সাহসিকতা ও মানবিকতার ছিটেফোঁটা আরব বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে দেখতে পাইনি। একই চিত্র দেখি যখন নাটের গুরু সৌদি সবাইকে নিয়ে কাতারকে ব্যান করেছিল, সেখানেও দেখি সুলতান কাবুসের উদার মনমানসিকতা ও সাহসিকতার পরিচয়।

দুই দিন আগে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এই মহান নেতা

প্রথম যখন আমি ওমানে আসি তখন সবচেয়ে বেশি ঈর্ষা হত সুলতান কাবুসের প্রতি। প্রতিটি ওমানী একজন নেতাকে ‘বাবা’ ডাকে। আমার প্রাপ্ত শিক্ষা-সংস্কৃতি এটা মেনে নিতে পারছিল না। আমার চোখে নেতা মানেই স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। সে কি করে বাবা হয়? মনে মনে বরাবরই ওমানীদের বোকা ভাবতাম। কয়েকবছর থিতু হবার পরে বুঝতে পেরেছি আমার আগের ভাবনা ছিল আমারই হীনমন্যতা ও প্রাপ্ত ভুল শিক্ষার ফল।

লেখার ইচ্ছে ছিল আরো অনেক কিছুর। সুলতান কাবুসের ধোফার বিদ্রোহ কিংবা তথাকথিত আরব বসন্ত দমনের ইতিহাস। তাঁর বিয়ে ও পরিবার পরিজনের গল্প। কিছুই লেখা হল না। আরব বিশ্বের সফল নেতা ১০ জানুয়ারী ২০২০ সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন।

ভালোবাসা ও স্যালুট জানাই মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বের দীর্ঘতম সেবা প্রদানকারী এবং সফল অধিনায়ক, সুলতান কাবুস’কে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা