আইনের ছাত্রী ছিলেন, অথচ হয়ে গেলেন সাংবাদিক। প্রথমেই সামনে এলো হারশাদ মেহতার দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ। তাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল, ব্ল্যাংক চেকের অফার এসেছিল। কিন্ত সুচেতা টলে যাননি, নির্ভিক থেকে সামনে এনেছেন শেয়ার বাজারের সেই ভয়াবহ জালিয়াতির খবর। সুচেতা না থাকলে হারশাদ বোধহয় হিরো হিসেবেই থেকে যেতেন চিরদিন...

'স্ক্যাম ১৯৯২ঃ দ্য হারশাদ মেহতা স্টোরি'তে আমরা পরোক্ষভাবে হলেও হারশাদ মেহতা'কে গ্লোরিফাই করার একটা প্রবণতা দেখি। কাহিনীটা এমনভাবেই সাজানো হয় যেখানে শেষে এসে হারশাদ মেহতার জন্যে মন খারাপ হয়। তবে সিরিজের কথা বাদ দিয়ে যদি রিয়েল লাইফের দিকে তাকাই, বাস্তব সময়ের অর্থনৈতিক এই ধাপ্পাবাজিতে হারশাদ যদি হয় ভিলেন, সেখানে হিরো অবশ্যই সুচেতা দালাল। যে সাংবাদিক প্রথমবারের মতন ভারতীয়দের সামনে নিয়ে এসেছিলেন এমন এক হারশাদ মেহতাকে, যে হারশাদ মেহতা 'স্টক মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন' না, যে হারশাদ মেহতা এক ভণ্ড, প্রতারক৷ সুচেতা দালাল ঠিক সেই মুহুর্তে এসেই হয়ে যান গল্পের প্রোটাগনিস্ট।

মহাভারত থেকে আমরা জানি, অর্জুনের রথের সারথি শ্রীকৃষ্ণ ছোটবেলায় মানুষ হয়েছিলেন গোকুলে। মামা কংস শ্রীকৃষ্ণের জন্মসংবাদ জানতে পারলেই মেরে ফেলবেন, এই আশঙ্কায় তাই তাকে একরকমে লুকিয়েচুরিয়ে গোকুলে পাঠানো হলো। সেখানেই বেড়ে উঠতে লাগলেন তিনি। তো এভাবেই যাচ্ছিলো সব। একদিন রাজা কংস বিকেলবেলা রথে চড়ে নগরভ্রমণে বেড়িয়েছেন, তখন আকাশ থেকে দ্বৈববাণী শুরু হয়-

তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।

অনেকটা এরকমই, যখন হারশাদ মেহতা আস্তে আস্তে হয়ে উঠছেন ভয়ঙ্কর ধাপ্পাবাজ, দেশের জন্যে হুমকি, ঠিক তখনই সুচেতা দালাল যুক্ত হন 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'তে সাংবাদিকতার সাথে। সুচেতার জন্ম মুম্বাইতে। পড়াশোনা করেছেন আইনে। বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে এলএলবি এবং এলএলএম কমপ্লিট করে তিনি যুক্ত হন সাংবাদিকতার সাথে। 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র 'বিজনেস এ্যাণ্ড ইকোনমিকস' উইং এ শুরু হয় পেশাগত জীবন। এখানে কাজ শুরুর ঠিক প্রথমদিকেই পাকেচক্রে তিনি জানতে পারেন হারশাদ মেহতা সম্পর্কে। প্রথম থেকেই অল্প অল্প ফিল্ডরিসার্চ তিনি করে রাখছিলেন বিজনেস ওয়ার্ল্ড এর টাইকুনদের নিয়ে৷ এরকমই এক সময়ে 'শারাদ বিল্লাই' নামের 'স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া'র একজন আসেন হারশাদের ধাপ্পাবাজির সংবাদ নিয়ে, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র অফিসে৷ এবং সেই নিউজ কাভার করেন সুচেতা দালাল। সিরিজ নিউজও করেন পরবর্তী সময়ে এসে। এভাবে সুচেতা দালাল হয়ে যান ইতিহাসের অংশ।

'হারশাদ মেহতা' চ্যাপ্টার চলাকালীন সুচেতার সাথে কাজ করছিলেন আরেকজন সাংবাদিক, দেবাশীষ বসু। এই দেবাশীষ বসুকেই পরবর্তীতে বিয়ে করেন তিনি। দেবাশীষ আর সুচেতা মিলেই প্রথমে হারশাদকে 'এক্সপোজ' করেন মানুষের সামনে। 'হারশাদ মেহতা' হারিয়েই যান একপর্যায়ে। তবে 'হারশাদ মেহতা'র মতন বিগশটকে ঘায়েল করেই থেমে থাকেননি সুচেতা। পরবর্তীতে তিনি করেছেন আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এরকন কর্পোরেশনের দুর্নীতি নিয়ে কাজ করেছেন, দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের অনেক অনিয়মকে নিয়ে এনেছিলেন মানুষের সামনে, কেতন পারেখের অর্থ-কেলেঙ্কারি নিয়েও কাজ করেছেন, লিখেছেন পেপারে। সাংবাদিকতার পেশাদারী মানসিকতায় তিনি আপোষ করেননি কখনোই। অপোনেন্ট যতই দুর্ধর্ষ হোক, তিনি দ্বিধাবোধ না করেই এগিয়েছেন তার নিজস্ব গতিতে। আর ঠিক এ কারণেই সুচেতা দালাল সবার চেয়ে হয়ে গিয়েছেন আলাদা। এভাবে একসময়ে 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র ফিনানশিয়াল এডিটরও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে এখান থেকে তিনি চলে আসেন 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' এ। এরপর কাজ করেছেন 'ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস' পত্রিকাতেও।

২০০৬ সালে এসে তিনি লেখালেখি শুরু করেন 'মানিলাইফ' ম্যাগাজিনে। এই ম্যাগাজিন শুরু করেছিলেন সুচেতার স্বামী দেবাশীষ বসু। বর্তমানে সুচেতা দালাল এই ম্যাগাজিনেরই ম্যানেজিং এডিটর। ২০১০ সালের দিকে তিনি এবং দেবাশীষ বসু মিলে 'মানিলাইফ ফাউন্ডেশন' গঠন করেন। এই সংগঠন ভারতের অনগ্রসর শ্রেনির ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ জোগানোর জন্যে কাজ করে থাকে। এ কথা তাই বলাই যায়, সুচেতা শুধু সাংবাদিকতার সাথেই যুক্ত নন। তিনি যুক্ত সমাজকল্যাণ ও মানবসেবার সাথেও। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অজস্র পুরস্কারও। 'চামেলী দেবী জৈন' এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী' খেতাবও। তিনি লিখেছেন বেশকিছু বইও। যার মধ্যে অন্যতম 'দ্য স্ক্যাম'; যেটা নিয়েই নির্মিত হয়েছে সনির জনপ্রিয় টিভি সিরিজ; স্ক্যাম ১৯৯২ঃ দ্য হারশাদ মেহতা স্টোরি।

সুচেতা দালাল পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী পুরস্কার'ও! 

'সুচেতা দালাল' এর জীবন ও পেশাজীবনের সালতামামি করে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা দেখি, তিনি যখন 'হারশাদ মেহতা' নামের সেলিব্রেটি বিজনেস-ম্যাগনেটের বিরুদ্ধে নেমেছেন কলমের লড়াইয়ে, তখন তিনি নেহায়েতই নবীন একজন সাংবাদিক। কিন্তু তিনি যেটা করেছেন, তিনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, থামেননি। থামতে পারতেন। বরং সেটাই তার জন্যে ভালো হতো। স্বাভাবিকও হতো। কিন্তু তা না করে তিনি যেটা সত্যি, সেটাকেই প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছিলেন। এরকম সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে সরাসরি হুমকি পেয়েছেন 'হারশাদ মেহতা' থেকেও। ভয় পাননি। তিনি লিখেছেনই। পরবর্তীতে আবার যখন হারশাদ জেলে গিয়েছেন, তিনি ছুটে গিয়েছেন হারশাদের বাড়িতে। হারশাদের বাড়ির মানুষের কথা শোনার জন্যে, তাদের কথা পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে। নিরপেক্ষ থেকে ' সত্য সংবাদ' বের করে আনার যে তাগিদ ছিলো তার, সেটিই সুচেতা'কে পরিণত করেছে এক শক্তিশালী সাংবাদিক ও একজন মানবিক মানু্ষে।

এখানেই তার চমৎকারিত্ব।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন







 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা