ছুটিটা দেয়া হয়েছিল গৃহবন্দী হয়ে ভাইরাসের বিস্তারকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে, আমরা সেটাকে উপলক্ষ্য বানিয়ে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেয়ার মিশনে নেমেছি।
করোনাভাইরাস যাতে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে না পড়ে এপ্রিলের চার তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনাবাহিনী নেমেছে মাঠে। জনসমাগম এড়ানোটাই এখন সবার মূল লক্ষ্য হবার কথা ছিল। অথচ চারিদিকে দেখতে পাচ্ছি পুরোপুরি উল্টো চিত্র। মানুষজন পালাচ্ছে শহর ছেড়ে, রেলস্টেশন, বাস স্ট্যান্ড, লঞ্চ ঘাট, ফেরী- সব জায়গায় মানুষের উপচে পড়া ভীড়। ঈদের সময়ও এতটা ভীড় দেখা যায় না! এভাবে আমরা করোনা মোকাবেলা করব? সতর্ক না থেকে করোনাকে উল্টো আমরাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছি দেশের প্রতিটা অঞ্চলে, সেটা এই লোকগুলোকে কে বোঝাবে?
একেকটা ছবি চোখের সামনে আসছে, আর শিউরে ওঠার অনুভূতি হচ্ছে বারবার। ট্রেনের ভেতরে পা রাখার জায়গা নেই, গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়ির পথে পাড়ি দিচ্ছে মানুষ, ছাদেও আছে ভীড়। বাসের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে না, ফেরীতে ধারণক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি মানুষ, লঞ্চ-স্টিমারের কথা আর নাইবা বললাম। ঈদের সময় এই ছবিগুলো দেখলে অটোমেটিক মাথার ভেতরে মিলন মাহমুদের 'স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার' গানটা বাজতো হয়তো। কিন্ত এখন মনে হচ্ছে স্বপ্ন নয়, মৃত্যুদূত যাচ্ছে বাড়ি, আমরাই সেধে সেধে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকেই বলে দেয়া হয়েছিল, করোনাভাইরাস মোকাবেলার প্রথম এবং প্রধান শর্ত হচ্ছে জনসমাগম এড়িয়ে চলা, ভীড় থেকে দূরে থাকা। মানুষের শরীর থেকে শরীরে ছড়ায় এই ভাইরাস। খোদা না করুন, যাত্রীবোঝাই ওই ট্রেনে একজন মানুষের শরীরে যদি করোনার পজিটিভ ভাইরাস থেকে থাকে, তাহলে শুধু কামরা নয়, সম্ভাবনা আছে পুরো ট্রেনের প্রত্যেকটি যাত্রীর শরীরে সেটা ছড়ানোর। সেই ভাইরাসগুলো নিয়ে মানুষগুলো নামবে আলাদা আলাদা স্টেশনে, পৌঁছুবে আলাদা গন্তব্যে, পরিবারের সদস্য, বন্ধু কিংবা প্রতিবেশীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেবে এই ভাইরাসের বীজ!
বিশ্বের আর কোন দেশ এরকম দুই-তিনদিন আগে লকডাউনের ঘোষণা দেয় কিনা আমার জানা নেই। গতকাল সকালে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেটা পত্রিকায় এসেছে, বিকেলে মন্ত্রীপরিষদ সচিব এসে সরকারী সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন যে, ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু। মানুষ তো ছুটি পেয়ে বাড়ির পথ ধরবেই, সেই সঙ্গে বয়ে নিয়ে যাবে ভাইরাসকেও। এই সিম্পল ব্যাপারটা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কারো মাথায় এলো না?
এই শহরে ভাসমান অজস্র মানুষ আছেন, আছে লাখ লাখ দিনমজুর, শহর লকডাউন হলে যারা কাজ না পেয়ে না খেতে পেয়েই মরবেন। তাদের কথা মাথাউ রেখেই হয়তো দুইদিন আগে ঘোষণাটা এসেছে, যাতে তারা বাড়ি চলে যেতে পারেন, সেখানে কাজ করে খেতে পারেন। কিন্ত করোনার মতো প্রাণঘাতি একটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে এমন সেফসাইডে থেকে তো লড়াই করা যায় না! আটকে পড়া অসহায় মানুষগুলোর এই কয়দিনের খাবারের ব্যবস্থা কি সরকারের পক্ষ থেকে করা যেতো না? প্রায়ই তো শুনি দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে, নিউইয়র্ক হয়ে যাচ্ছে, রিজার্ভে থাকা বৈদেশীক মুদ্রা নাকি রেকর্ড গড়বে, তাহলে এটুকু কি করতে পারতো না সরকার? এই সেফ গেম খেলতে গিয়ে কি দেশকে আরও বিপদে ফেলে দেয়া হলো না?
আর আমাদের বলিহারি স্বভাবের কথা না বলি। যে লোকটা দিনমজুর, যার পেটের তাগিদ আছে, সে বাড়ি যেতেই পারে। যে ছেলেটা ঢাকা শহরে টিউশনি করে টিকে থাকে, শহর বন্ধ হয়ে গেলে যার খাবারের টান পড়বে, তার যাওয়াটাও মেনে নিতে পারি। কিন্ত অফিস-স্কুল বন্ধ হওয়ায় লোকজন যেভাবে ঈদের আমেজ নিয়ে দলে দলে বাড়ি যাচ্ছে বেড়ানোর জন্যে, সেটা কি করে মেনে নিই? এদের কি ধারণা, আজরাইল কি ঢাকার বাইরের পথঘাট কিছু চেনে না? ছুটিটা দেয়া হয়েছিল গৃহবন্দী হয়ে ভাইরাসের বিস্তারকে থামিয়ে দেয়ার জন্যে, আমরা সেটাকে উপলক্ষ্য বানিয়ে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেয়ার মিশনে নেমেছি। সাধে কি আর কবিগুরু বলেছিলেন, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি!