ভ্রমণ নিয়ে যেমন একটি কথা প্রচলিত আছে- সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে দেখলে পুরো পৃথিবী দেখার স্বাদ পাওয়া যায়; তেমনি, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলো পড়লে সমগ্র বাংলাদেশই জানা হয়ে যায়...
গভীর রাত। ঢাকার সুউচ্চ কোনো অট্টালিকার বারান্দায় বসে আছে একটি মেয়ে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তাকে দেখে মনে হচ্ছে, স্বর্গ থেকে কোন এক অপ্সরী নেমে এসেছে। মেয়েটির চক্ষুজোড়া মায়ায় পরিপূর্ণ। কোলে তার মোবাইল ফোন। সে যার প্রতীক্ষায় নির্ঘুম বসে আছে, সেই ছেলেটি একটি হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে শহরের অলি-গলিতে। এই জগতের প্রতি তার বুঝি কোন টানই নেই। নির্বিকার চিত্তে সে হয়ত উপভোগ করছে শহরের নীল জোৎস্না। তাকে দেখে মনে হয়, এই শহরে ঘুরে বেড়ানোর জন্যেই যেন তার জন্ম।
বাংলাদেশে এমন একজন বইপ্রেমিক পাওয়া যাবে না, যারা এই হলুদ পাঞ্জাবির ছেলেকে চিনে না। হ্যাঁ, এই ছেলেটিই হিমু; যার ভালো নাম হিমালয়। নামের আগে-পরে কিছু নেই, শুধুই হিমালয়। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে হিমু পড়েছে, কিন্তু তার মতন একা হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর কথা ভাবেনি। অনেকে তো ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পড়ে হিমু হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। এই “হিমু” চরিত্রের নির্মাতাই হলেন হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদের কোন নির্দিষ্ট পরিচয় দেয়া বেশ কঠিন। তাঁর গল্প-উপন্যাস লেখার সাবলীল ক্ষমতার জন্য তাকে হয়ত কথাসাহিত্যিক বলা যায়। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্র তো শুধু সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তাই তো তিনি কখনো কখনো লেখার কলম ছেড়ে ধরেছেন রেকর্ডিং ভিডিও ক্যামেরা। নির্মাণ করেছেন একের পর এক সফল নাটক-সিনেমা।
ফেব্রুয়ারির অমর একুশে বইমেলায় তাঁর নতুন বই কেনার জন্য যেমন লাখো বইপ্রেমিক প্রতীক্ষায় থাকত, তেমনি ঈদ-পুজার সময়েও তাঁর নির্মিত নতুন নাটক-সিনেমা দেখার জন্য সবাই টিভিতে বা সিনেমা হলের সামনে ভিড় করত।
অথচ জীবনের শুরুতে তিনিই কিনা ছিলেন রসায়নের মতন দুর্বোধ্য বিষয়ের শিক্ষক। এমনকি এ বিষয়ে দেশের বাইরে গিয়েও ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন তিনি। এজন্য এই হুমায়ূন আমাদের কাছে মোঘল সম্রাট বাদশাহ হুমায়ূনের চেয়েও অনেক বেশি উচ্চস্থানে আসীন।
কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় গল্পকার হিসেবে হুমায়ূনের বিশেষত্য কী, প্রায় সবারই উত্তর হবে- তাঁর লেখার প্রাঞ্জল্যতা। তিনি তাঁর লেখনীর দ্বারা একটা কাহিনী এত সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতে পারেন যে পাঠকের মনে হয় তিনি নিজের চোখের সামনেই তা দেখতে পাচ্ছেন। মানুষের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ তুলে ধরতে তাঁর কোন জুড়ি নেই। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে স্পষ্টতা। এজন্যই মানুষের ভিতরকার দ্বন্দ্ব তিনি খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। তাই তো, ভালো-মন্দ মিশানো মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হুমায়ূন অনন্য।
হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি বড় গুণ হচ্ছে তাঁর লেখার বৈচিত্র। ভ্রমণ নিয়ে একটি কথা যেমন প্রচলিত আছে- সমগ্র ভারতবর্ষ ঘুরে দেখলে পুরো পৃথিবীরই স্বাদ পাওয়া হয়ে যায়, তেমনি, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলি পড়লে সমগ্র বাংলাদেশই জানা হয়ে যায়। কী নেই তাতে? সেখানে শহুরে মানুষের কোলাহল যেমন আছে, তেমন আছে প্রকৃতির কোলে কোন এক নির্জন গ্রামের অতি সাধারণ একটি পরিবারের উপাখ্যান।
পাহাড়-সমুদ্র, বাগান-জঙ্গল, বর্ষণ-জোৎস্না- বাংলাদেশের সব রূপই যেন তুলে ধরা হয়েছে তার একেকটি রচনায়। কোথাও হয়ত তুলে ধরেছেন মানুষের অন্ধকারতম জগৎ-নন্দিত নরক, আবার কোথাও সন্ধান করেছেন সবচেয়ে শুদ্ধতম মানুষ; খুঁজে বের করেছেন শুভ্রকে। কখনো মিসির আলি হয়ে খুলেছেন রহস্যের জট, আবার কখনো রূপার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন বিশুদ্ধ প্রেম। তাঁর লেখনীতে যেমন উপস্থিত ছিল ধনীদের বিষয়চিন্তা, মধ্যবিত্তদের বেঁচে থাকা, ভাসমান মানুষের সংগ্রাম, তেমনি ছিল প্রেম-রহস্য-রোমাঞ্চ ও বৈরাগ্য।
মিসির আলির কথাই ধরা যাক। কী নেই এই চরিত্রে? মনোবিজ্ঞানের এই শিক্ষকের পেশা শিক্ষকতা থাকলেও, নেশা তার প্যারাসাইকোলজি নিয়ে গবেষণা। বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে মানুষ তার কাছে এসে ধরণা দেয়। সেইসব কেস স্টাডি করতে গিয়ে ঘুরেছেন সারা দেশ, পড়েছেন বিচিত্র সব পরিস্থিতিতে। কখনো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, কখনো বা কেস সমাধান করতে চলে গিয়েছেন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি। এই চরিত্রের কিছু অসাধারণ গুণ থাকলেও, দোষও কিন্তু তার কম ছিল না। খামখেয়ালীপনা, নিকোটিন নেশা তাকে করেছে আরও বাস্তব।
পাঠক মনকে আকৃষ্ট করার একটা সহজাত প্রতিভা ছিল হুমায়ূনের। যেভাবে তিনি গল্পের নির্মাণ করেন, যে পড়বে সে নিশ্চিত সেখানে আটকে যাবে। গল্পের শেষ দেখা না পর্যন্ত পাঠকের সময়ও যেন থমকে পড়ে। প্রায় সময়েই তারা গল্পের শেষ ঠাওর করে উঠতে পারে না। হুমায়ূনের গল্প যে কোন দিকে মোড় নিবে তা একমাত্র তিনিই জানেন। তাঁর এমন অনেক উপন্যাস আছে, যেখানে পাঠকরা যা ভেবেছিল, হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ নিয়ে কাহিনীও হয়েছে অনেক। তারই লেখা 'কোথাও কেউ নেই' উপন্যাসের ভিত্তিতে যে মেগাসিরিয়াল তৈরি হয়েছিল, সেখানে গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র বাকেরের অন্যায়ভাবে ফাঁসি হয়ে যায়। সেই ফাঁসি টিভির দর্শকেরা মেনে নিতে পারেনি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ফোনকল পর্যন্ত গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের কাছে বাকেরের ফাঁসির সিদ্ধান্তটি পরিবর্তন করার জন্য, টেলিভিশনের চরিত্রের ফাঁসির প্রতিবাদে ঢাকার রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু তাতেও হুমায়ূনকে টলানো যায়নি।
লেখক হুমায়ূনের সার্থকতা এখানেই। তিনি নির্মম বাস্তবতাকে আমদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে তুলে ধরতে জানতেন। সমাজের নানান অসঙ্গতি, অবক্ষয় ও নিদারুণ পরিণতি তাই উঠে এসেছে তাঁর উপন্যাসে। আরও উঠে এসেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ। যখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী দেশদ্রোহী রাজাকারদের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে সবাই ভয় পেত, তখন এই হুমায়ূন কলমের জোরে সবাইকে শিখিয়েছেন কীভাবে রাজাকারের সামনে তর্জনি তুলে “তুই রাজাকার” “তুই রাজাকার” বলতে হয়। একজন শহীদ পিতার সন্তান হিসেবে তিনি সারাজীবন লালন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ না দেখা প্রজন্মের সামনে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ।
এই রচনায় মূলত কেবল কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যার কেবল বিন্দুজল অংশই তুলে ধরতে পেরেছি, না বলা রয়ে গেছে অগাধ-সমুদ্র সমান কথা। কিন্তু লেখক হুমায়ূনকে জানার জন্য তার বই পড়ার চেয়ে ভালো কোন রাস্তা নেই। এ জন্য হয়ত তাঁর লেখা শত-শত ছোটগল্প, শ’য়ের উপর উপন্যাস পড়তে হবে। এইসব পড়লেই যে পাঠক তাকে চিনতে পারবে, এর কোন নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু এইটুকু বুক হাত দিয়ে বলা যায়- তিনি জীবনের অনেক কিছু নতুন করে জানতে পারবেন। বাংলা সাহিত্য যেমন রবীন্দ্রনাথ না পড়লে অর্থহীন, তেমনি বাংলার আধুনিক গদ্য সাহিত্য হুমায়ূন ছাড়া মূল্যহীন।
-
* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুুুুপে