এই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জীবনে যখন এখনকার সময়ের মতো ঈদ আসছি আসছি ভাব, চারিদিকে নতুন জামা, পাঞ্জাবী, জুতা নিয়ে হৈচৈ সবার মধ্যে। তখন অফিস থেকে ফেরার পথে একা একা রিকশায় হঠাৎ বেতনের টাকায় পাজামা-পাঞ্জাবী না দিতে পারার মতো অপ্রাপ্তির কথা মনে পড়লে মন খারাপ হয়। ভালো লাগে না।
কাসাফাদ্দৌজা নোমানঃ (১) জীবনের প্রথম বেতন যখন হাতে পেলাম তখন বিকেল ছুঁইছুঁঁই। এতোগুলা টাকা হাতে, সব আবার আমার! ভাবতেই কেমন উদাস লেগে উঠলো। যা ভাবছি তাই ভালো লাগছে। ভেতরে এক ধরনের ছাইচাপা আগুনের মতো আনন্দ। একে ওকে ডেকে ঘটনা খুলে বলে জড়ায়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সেটা বলা বা করা যাচ্ছে না। আমি পারলে গাছ, ফুল, পাখিকে বেতনের খবর বলি। অনেকটা শচীন কর্তার মতো, "শোনো গো দখিনা হাওয়া স্যালারী পেয়েছি আমি!" টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ঠিক আছে এতোগুলা টাকা পাইছিস, তার মানে এই না যে তুই এতগুলা টাকা আগে দেখিস নাই। নরমাল থাক। কতো টাকা আসবে যাবে জীবনে!
কেউ আমার দিকে তাকালেই সন্দেহ হয়। এই বুঝি আমার ভেতরের অবস্থাটা বুঝে যাবে। চমকে উঠলাম পাশের ডেস্ক থেকে বসের কথা শুনে। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, "কিরে, স্যালারী পাইছো?" জ্বি ভাই। আর কোনো কথা হলো না। একটু পর আমি ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "ভাই আজকে আমি বের হয়ে যাই?" প্রথম বেতন পাইছো, ডেটে যাবা? না ভাই। প্ল্যান বলো। প্ল্যান পছন্দ হলে যাইতে দিবো। প্ল্যান নাই ভাই। প্রথমে বের হয়ে নিজের টাকায় এক কাপ চা আর একটা সিগারেট খাবো প্রাণ ভরে। তারপর ভাববো কী করা যায়। ভেবে কিছু না পেলে অফিসে চলে আসবো। আর অফিসে যদি চলে আসি তাহলে বুঝবেন আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।
(২) আম্মা ভাবতেন, আমাকে দিয়ে চাকরী হবে না। দুইদিন চাকরি করলে তিনদিনের দিন আমাকে বের করে দিবে। আব্বু আবার এটা ভাবতেন না। তিনি ভাবতেন, শুধু চাকরী না, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। দোকানে চা খেতে খেতে উদাস হয়ে এসব ভাবছিলাম। প্রথম বেতনটাতে আমার চেয়ে তারা বেশি খুশি হবেন। আম্মার জন্য শাড়ি আর আব্বুর জন্য পাজামা-পাঞ্জাবী কেনার পরিকল্পনা করলাম। আব্বু দেশের বাইরে থাকেন, অতএব সেটা আবার পাঠাতে হবে। অতএব যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।
আম্মাকে ফোন দিয়ে ঘটনা এবং পরিকল্পনা উভয়েই বললাম এক নিঃশ্বাসে। তিনি খুশি হলেন এবং আমার পরিকল্পনা এক কথায় বাতিল করে দিলেন, "ওইসবের দরকার নাই। তুমি টাকা আমাকে দিবা। আমি যা করার করবো। সামনের মাসে ঈদ। শাড়ি, পাঞ্জাবী ঈদে কিনতে পারবা।" মে মাসে আমি চাকরিতে জয়েন করি। জুনে আমার প্রথম স্যালারী হয় আর জুলাইতে ঈদ। অতএব আম্মার কথা আমার পছন্দ হয়েছে। আম্মার জন্য শাড়ি আর আব্বুর জন্য পাঞ্জাবী-পাজামা। ওহো, আমার একটা প্রেমিকাও ছিলো তখন। তাকে কী দেয়া যায় এই বিষয়ে বিস্তর ভাবতে ভাবতে ফোন দিয়ে দেখা করার পরিকল্পনা করে ফেললাম। এরমধ্যে দুই একবার আড়ং গিয়ে শাড়ি পাঞ্জাবী হাতের কাছে যা পেয়েছি সব দেখে এসেছি, অনেকগুলো পছন্দও করেছি।
(৩) রমজান মাস শুরু হয়েছে। এদিক জুন মাস শেষ, জুলাই এসে পড়েছে। দ্বিতীয় বেতনের একদম দ্বারপ্রান্তে আমি। মনে নতুন করে আবার উত্তেজনা। টাকাটা পেলেই কেনাকাটা করে ফেলতে হবে। সেদিন ছিলো ৩ জুলাই, শুক্রবার ছুটির দিন। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমালাম এক প্রকার। অনেকগুলো ফোন এসেছে, বেশিরভাগই অপরিচিত নম্বর। কোনোটাই ধরিনাই। ফোন দেয়ার প্রয়োজনও মনে করিনি কাউকে। যার দরকার সে দিবে। বিকালে বন্ধুরা আসলো, বিশাল আড্ডা দিতে দিতে ইফতারের সময় হয়ে গেলো। ইফতার মাখাচ্ছি সবাই মিলে। একটা ফোন আসলো, বাইরের নম্বর। ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আমার নাম নোমান কিনা?" আমি বললাম, হ্যাঁ। এরপর তিনি আমাকে বাবার মৃত্যুর সংবাদ শোনালেন।
দুপুরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি খুব শক্ত মনের মানুষ। খুব বেশি আবেগ আমাকে কখনোই ছুঁয়ে যায়নি। সেদিনের সেই মুহূর্তটা কোনোভাবেই বর্ণণা করতে পারি না। এই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জীবনে যখন এখনকার সময়ের মতো ঈদ আসছি আসছি ভাব, চারিদিকে নতুন জামা, পাঞ্জাবী, জুতা নিয়ে হৈচৈ সবার মধ্যে। তখন অফিস থেকে ফেরার পথে একা একা রিকশায় হঠাৎ বেতনের টাকায় পাজামা-পাঞ্জাবী না দিতে পারার মতো অপ্রাপ্তির কথা মনে পড়লে মন খারাপ হয়। ভালো লাগে না।