টাকা-পয়সা লেখাপড়ার পথে কোনো বাধা নয়। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সে এগিয়ে যাবেই, পথ বেরিয়ে আসবেই।

গরীব ঘরে জন্ম ছেলেটার। অনেকটা সিনেমার মতোই গল্প। বাবা একটি বাড়িতে সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন, মা অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তবুও দারিদ্র তার মেধাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। গত ১৯ জানুয়ারি ঘোষিত গেজেটে তালিকায় ১২তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে ৬৭তম হয়েছেন। আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে সহকারী জজ হিসেবে পিরোজপুর জেলায় যোগদান করবেন তিনি।

অভাব অনটনের সংসারে লেখাপড়া যেন বিলাসিতা। টেনেটুনে কলেজ পাশ করার পর লেখাপড়াই বন্ধের উপক্রম হয়েছিলো সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এই সহকারী জজ এর। পরবর্তীতে মায়ের পালা গরু বিক্রী করে ঢাকায় চলে আসেন ইউনিভার্সিটি ভর্তি কোচিং করতে। এটা ২০১০ সালের ঘটনা। গরু বিক্রীর টাকাও যখন ফুরিয়ে যায়, অর্থাভাবে উক্ত কোচিং সেন্টারের মালিকের কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাড়ি থেকে সাহায্য নেবার মতো অবস্থা ছিল না। বাড়ি ফিরে যাবার মতোও অবস্থা ছিলো না। সেসময় ঐ কোচিং সেন্টারে বিনামূল্যে থাকা এবং পড়ালেখার সুযোগ না পেলে এতোদূর আসাই হতো না তার।

২০১০-১১ শিক্ষা বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা দেবার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পান। সেসময় পরিচয় গড়ে ওঠে সহপাঠীদের সাথে। তাদের আন্তরিকতায় অনেক সাহায্য পান। জোগাড় হয়ে যায় কিছু টিউশনি। এভাবেই কেটে যায় শিক্ষাজীবন। যতোটা সহজে বর্ননা করা হলো, তার জীবনটা ছিলো ততোটাই কঠিন।

গোলাম রসুল সুইট

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামের বাবা মোশারফ হোসেন ও মা মাহফুজা খাতুনের বড় ছেলে গোলাম রসুল সুইট। নিজের জীবন সংগ্রামের কথা এভাবেই তুলে ধরেছেন সম্প্রতি। শাখরা কোমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ভোমরা ইউনিয়ন দাখিল মাদরাসা থেকে দাখিল পাস করেন। এরপর দেবহাটা উপজেলার সখিপুর খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কলেজ শেষ করার পর লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময় সাতক্ষীরা শিল্পকলা একাডেমিতে একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলে সেখান থেকে এক ভাইয়ের পরামর্শে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় আসার জন্য মায়ের পালা গরুটি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রী করতে হয়।

সেই টাকা শেষ হয়ে গেলে ঢাকায় এক কোচিং সেন্টারের উদারতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তির সুযোগ হয়। ভর্তির পর নিজ হাতে পোস্টার ছাপিয়ে অভিভাবকদের কাছে বিতরণ শুরু করে পাঁচটি টিউশুনি জোগাড় হয়ে যায়। আত্মীয় স্বজন যেখানে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি সেখানে বন্ধুবান্ধবেরা সবসময় পাশে ছিলেন। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও কুন্ঠা বোধ করেননি তিনি। এতো কষ্ট বৃথা যেতে দেনিনি তিনি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ফলাফলে বি-ইউনিটে মেধাতালিকায় হয়েছিলেন ১১তম। অতঃপর জুডিশিয়াল সার্ভিসের  ১০০ জনের মেধাতালিকায় ৬৭তম হয়ে সহকারী জজের পদ পেয়েছেন।

ইতিমধ্যেই মা-বাবাকে ছাড়িয়েছেন অন্যের বাসার কাজ থেকে। সন্তানের এ সাফল্যে গর্বিত তারা। শুধু তারাই নয়, এই সাফল্যে গর্বিত তার এলাকাবাসী। শুধুমাত্র মেধা থাকলেই হবে না সাথে থাকতে হবে কঠোর অধ্যাবসায়। যা দিয়ে বদলে দেয়া যায় জীবনের গল্প, তার এক অনন্য দৃষ্টান্ত গোলাম রসুল সুইট।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমার বড়লোক হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। সবসময় ন্যায়ের পথে থেকে মানুষের জন্য কাজ করে যাবো। কখনো অনিয়ম বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হবো না। যখন চাকরিজীবন শেষ করবো তখন যেন অবৈধ উপায়ে উপার্জনের একটি টাকাও আমার ব্যাংক একাউন্টে না থাকে। আমার কাছে সব মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। অসহায় মানুষরা কখনই ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না। দুস্থ পরিবারের সমস্যাগুলো আমি বুঝি, জানিয়ে গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে গোলাম রসুল সুইট বলেন, টাকা-পয়সা লেখাপড়ার পথে কোনো বাধা নয়। ইচ্ছাশক্তি থাকলে সে এগিয়ে যাবেই, পথ বেরিয়ে আসবেই।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা