এরা আফগানিস্তানে গিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করলে কিছু হয় না, সিরিয়ায় গিয়ে পুরো দেশটা ধ্বংস করে ফেললে, মসজিদে ঢুকে পাখির মত গুলি করে মারলেও কিছুই হয় না। যত সমস্যা সব আমাদের। গাছের একটা পাতা পড়লেও তাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে- কেন পড়লো পাতা!

ফিরছিলাম গ্রীস থেকে। এয়ারপোর্টে আমার সহকর্মী, ছাত্রসহ সবাই পার হয়ে গেল। কেবল আমি গেলাম আঁটকে! ওরা আমার পাসপোর্ট দেখে বললো, 'ভালো করে চেক করতে হবে'। আমি বেশ একটা হাসি দিয়ে বললাম, 'নিশ্চয়ই'। এরপর এরা আমার পাসপোর্ট এই মেশিন দিয়ে চেক করে, ওই মেশিন দিয়ে চেক করে; এরপর আরও কতো কি! এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, 

- তুমি এখানে এসেছ কেন? 
- সামার স্কুলে যোগ দিতে। 
- কিসের স্কুল? 
- শরণার্থীদের উপর একটা সামার স্কুলে। 

এরপর ওরা কাগজপত্র দেখতে চাইল। দেখালাম। খানিক বাদে হেসে বলল, 'আমাদের এখানে অনেক শরণার্থী থাকে। ওরা মাঝে মাঝে নকল পাসপোর্ট করে ইউরোপের অন্য দেশে পালিয়ে যায়। এই জন্য এভাবে চেক করলাম'। আমি কিছু না বলে একটা হাসি দিয়ে প্লেনে উঠলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আমার সহকর্মী, ছাত্ররা আমার দিকে কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছে! ভাবখানা এমন- আমি নিশ্চয়ই সন্ত্রাসী টাইপ কিছু! যেহেতু ওরা আর কাউকে চেক করেনি, স্রেফ আমাকেই করেছে! করবে না কেন! সেখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে আমার মতো ছিল না। সবাই ছিল সাদা চামড়ার! তাই তারা আমাকেই আটকিয়েছে! 

আমার এক মাস্টার্সের ছাত্র থিসিস করছে আমার সুপারভিশনে। সে এই মুহূর্তে ডাটা কালেকশন করছে। ইন্টার্ভিউ করছে ফরেন স্টুডেন্টদের। কারণ সে তার মাস্টার্স থিসিসে দেখার চেষ্টা করছে- ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট'রা বিদেশে এসে কেমন অনুভব করছে। কাল রাতেই আমার এই ছাত্র ওর ইন্টারভিউর কয়েক'টা অডিও টেপ পাঠিয়েছে আমাকে। আমি সবগুলো ইন্টার্ভিউ শুনতে পারিনি। কেবল এক আফ্রিকান ছাত্রের ইন্টার্ভিউ শুনেছি। সেই আফ্রিকান ছাত্র বলছে, 'এই দেশে আসার পর আমি প্রতিনিয়ত বর্ণবাদের শিকার হচ্ছি। আমি যে "কালো" সেটা আমি প্রতিনিয়ত বুঝতে পারি চলতে ফিরতে'। 

গত বছর সাউথ আফ্রিকা থেকে এক ছেলে পড়তে এসেছিল আমাদের ইউনিভার্সিটিতে। সেই ছেলে গেল সিটি সেন্টারে। বোধকরি এক রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছিলো। হঠাৎ এই দেশের সাদা চামড়ার এক লোক তার উপর হামলে পড়ে ছুরি নিয়ে। সেই লোক নাকি বলছিল, 'কালো মানুষ এই দেশে কী করে! ফিরে যাও নিজের দেশে'। ছেলেটা পায়ে ছুরির বেশ কয়েকটা আঘাত পেয়েছিল। আমি তাকে হোস্টেলে দেখতে গিয়েছিলাম। ছেলেটা দুঃখ করে বলছিল, 'পুলিশকে গিয়ে বললাম। ওদের দেখে মনে হলো- অন্যায় মনে হয় আমিই করেছি'। এর কয়েকদিন পর এই ছেলে পড়াশুনা না করে নিজ দেশে চলে গিয়েছে। আমি যে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, পরবর্তীতে অনুভব করলাম সেটাও অনেকে পছন্দ করছে না। বুঝতে পারলাম, আমিও তো মাইগ্রেন্ট। দেখতে অন্য রকম। 

গায়ের রঙ আলাদা হওয়াটা যেখানে 'অপরাধ'!

আমরা হয়ত ভুলতে বসেছি, ক'দিন আগ পর্যন্তও পুরো পৃথিবী শাসন করেছে যে দেশ, সেই দেশের প্রেসিডেন্ট কিন্তু মুসলিম আর ইমিগ্রেন্ট বিদ্বেষী কথা বলেই প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। সে এক সময় বলেছিল- আমেরিকা থেকে সব মুসলিমকে বের করে দিবে।

অন্যদের কথা বলতে পারব না। আমি প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি- আমি দেখতে অন্যদের চাইতে আলাদা, আমার ধর্ম আলাদা, আমার সংস্কৃতি আলাদা সুতরাং আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে ফেলা যায়। আমার কাজ সয়ে যাওয়া। এরা মানুষ হত্যা করলে কিছু যায় আসে না। এরা আফগানিস্তানে গিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করলে কিছু হয় না। সিরিয়া গিয়ে পুরো দেশটা ধ্বংস করে ফেললে কিছুই হয় না। মসজিদে ঢুকে পাখির মত গুলি করে মারলেও কিছুই হয় না। পুরো পৃথিবী জুড়ে সতর্কতা জারি করা হয় না। হয় না কোন ভ্রমণের সতর্কতা।

আমাদের খেলোয়াড়'রা বিনা নিরপত্তায় প্রাণ ভয়ে দৌড়ে পালালেও কিছু হয় না। যত সমস্যা সব আমাদের। গাছের একটা পাতা পড়লেও তাদের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে - কেন পড়লো পাতা! আর হবেই না বা কেন? আমরা তো সাদা চামড়ার মানুষ দেখলে- হুজুর হুজুর করতে থাকি। আমরা ভুলতে বসেছি- পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলো আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা মিশর থেকে উঠে এসেছে। সেই আমরাই কিনা এখন হয়ে গেলাম অসভ্য!

ভুলে গেলে চলবে না প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আমাদের মত দেখতে কেউ শুরু করেনি। শুরু করেছে সাদা চামড়ার মানুষগুলোই। পারমাণবিক বোমাও কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষরাই প্রথম মেরে মানুষ হত্যা করেছে। আমরা তৈরি করলাম সভ্যতা। আর এই সাদা চামড়ার মানুষরা তৈরি করল কিভাবে সেই সভ্যতা ধ্বংস করা যায়। এরপরও এরাই নাকি শান্তিপ্রিয় মানুষ!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা