২৫ বছরের যুবতী মেরীকে চারজন লোক অপহরণের পর ৩০ হাজার ডলার মুক্তিপণ পেয়ে ছেড়েও দেয়। অথচ তাদের গ্রেপ্তারের পর মেরী আদালতে দাঁড়িয়ে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন করেন। শুধু তাই নয়, মেরী নিয়মিত জেলখানায় বন্দী ওই লোকগুলোকে দেখতে যেতেন এবং তাদের জন্য উপহারসামগ্রীও নিয়ে যেতেন...

বহুবছর আগে,আমার এলাকার কয়েকজন মানুষ সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ডাকাতির কবলে পড়েন। ডাকাতরা ওই ট্রলারের তিনজন মানুষকে ধরে নিয়ে যায় গভীর জঙ্গলে। বাকি লোকজন ফিরে এসে এ ঘটনা পুলিশকে জানায় এবং থানায় একটা সাধারণ ডায়েরিও হয়। এরপরে আর কয়েক বছরে তাদের কোনো খোঁজ মেলেনি।

এর ঠিক ছয় বছর পর সুন্দরবনে পুলিশ একটা ডাকাতের আস্তানার সন্ধান পায় এবং সেখানে অভিযান চালালে অন্যান্য ডাকাতদের সাথে সেই নিখোঁজ হওয়া তিন ব্যক্তিরও হদিস মিলে। তাদেরকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় এবং কোর্টে বাদবাকি ডাকাতদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার জন্য বলা হয়। যাতে করে তারা সত্যটা বলেন যে,এই ডাকাতরাই ছয় বছর আগে তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই তিনজন ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী তো দিলোই না আরও উল্টো তাদেরকে সমর্থন করে কথা বললো। তারা জানালো এতবছর বাকি ডাকাতরা তাদের সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছে এবং কোন অত্যাচার করেনি এবং তাদের মধ্যে একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে! 

একটু ভালোভাবে যদি লক্ষ্য করা যায় তাহলে এটাও পরিষ্কার যে, ওই তিনজন চাইলেই আস্তানা থেকে পালাতে পারতো এবং তারা মাঝেমধ্যে বাজার সদাই করার জন্য সুন্দরবন উপকূলের স্থানীয় জেলাগুলোতেও আসতো। তবু তারা পালায়নি। কিন্তু কেন? কেবলমাত্র ভয়ের জন্য? আচ্ছা,সেটাও যদি হতো তবুও তো এতগুলো বছরে  এতবার এসব জেলা শহরে এলো, অন্তত একবার কি পালানোর চেষ্টাও করতো না? বা পুলিশকে জানাতে পারতোনা ? 

এটাই তো মানুষ হিসেবে সহজাত প্রবৃত্তি হওয়া উচিত ছিলো। তাহলে সমস্যাটা কোথায় হলো? আচ্ছা,এবার তাহলে সমস্যাটার সমাধান দিচ্ছি। এই তিনজন লোকের মধ্যে যেই মানসিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিলো এটাকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। ব্যাপারটাকে "Capture Bonding Syndrome" বলা হতো। সোজা বাংলায় অপহরণকারীর সাথে অপহৃত ব্যক্তিদের একটা অদ্ভুত সুসম্পর্ক। সবক্ষেত্রে যে এমনটা ঘটে তা কিন্তু নয়; খুব অল্পসংখ্যক ক্ষেত্রেই এমনটা দেখা যায়।

তবে শুধুমাত্র অপহরণ কথাটা বললে হয়তো ভুল হবে।কারণ এই অদ্ভুত ব্যাপারটা আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে। যেমন বহুদিন ধরে নির্যাতনের শিকার নারী,শিশু,যুদ্ধবন্দী কিংবা প্রাচীনকালের দাসত্ব থেকে বর্তমানকালের অনেক জঙ্গি (যেসব অপহৃত যুবকরা পরবর্তী সময়ে অপহরণকারী জঙ্গিদের সাথে সেচ্ছায় মিশে যায়) পর্যন্ত।

১৯৭৩ সাথে একটা বহুল আলোচিত ঘটনার মাধ্যমে Capture Bonding Syndrome নতুন নামে পরিচিতি পায়। 'স্টকহোম সিনড্রোম'. ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট সকালবেলা সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে একটা ব্যাংকে ডাকাতি হয়।

দুজন ডাকাত ব্যাংক ভল্টে ওখানেরই চার কর্মকর্তাকে জিম্মি করে। যাদের মধ্যে ৩ জন নারী ও একজন পুরুষ ছিলেন। ১৩১ ঘন্টা, মানে মোটামুটি ছয় দিন পর তারা জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পায়. কিন্তু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন ওই চারজন। কারণ তাদের প্রত্যেকটা কথাতেই ছিলো অপহরণকারীদের প্রতি সমর্থন এবং সহানুভূতি। এমনকি তাদের মধ্যকার একজন মহিলা ওই অপহরণকারীর সাথে সম্পর্কেও জড়িয়ে যান। পরবর্তীতে আবার ওই অপহরণকারীদের মুক্তির জন্য অর্থসংগ্রহও শুরু করেন।

স্টকহোম সিনড্রোমে অপরাধীর প্রতি একটা মায়ার জন্ম নেয়

আর এ ঘটনা থেকেই মনোবিজ্ঞানে স্টকহোম সিনড্রোম নামক এক নতুন পৃষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়। যদিওবা এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান একে পুরোপুরিভাবে কোনো মানসিক রোগের আওতাভুক্তই করেননি তবুও অনেক সাইকিয়াট্রিস্টই একে মানসিক বিপর্যস্ততা/ধকল পরবর্তী ফলস্বরূপ (Post traumatic event) বিবেচনা করেন।

স্টকহোম সিনড্রোম এর লক্ষণগুলের মধ্যে প্রধানতই হচ্ছে অপহরণকারীর প্রতি সহবস্থান, সমর্থন কিংবা সহানুভূতি। একইসাথে পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি যারা ওই অপরাধীদের বিপক্ষে অবস্থান করছেন তাদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব।

১৯৩৩ সালে মেরী ম্যাকইলোরী নামক ২৫ বছরের এক যুবতীকে চারজন লোক অপহরণ করে। মেরীর বাবা ধনাঢ্য রাজনীতিবিদ হওয়ায় তার কাছে ৬০ হাজার ডলার মুক্তিপণ দাবি করে এবং ৩০ হাজার ডলার দেয়া মাত্রই তারা মেরীকে ছেড়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যকার তিনজন অপহরণকারী গ্রেফতার হয় এবং তাদের শাস্তিও হয়। কিন্তু মেরী আদালতে দাঁড়িয়ে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন করেন। একইসাথে তাদের শাস্তি কমানোর জন্যও অনুরোধ করেন।

এরপর থেকে মেরী নিয়মিত জেলখানায় বন্দী ওই লোকগুলোকে দেখতে যেতেন এবং তাদের জন্য উপহারসামগ্রীও নিয়ে যেতেন। জেলখানায় তাদের দূর্দশা দেখে মেরী মনোকষ্টে ভুগতে থাকে. ১৯৩৯ সালে মেরীর বাবার মৃত্যু হলে সে পুরোপুরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। ১৯৪০ সালের ২১ জানুয়ারি মেরী আত্মহত্যা করে। তার সুইসাইড নোটে লেখা ছিলো-

"My four kidnappers are probably the only people on Earth who don't consider me an utter fool."

স্টকহোম সিনড্রোম নিয়ে এ পর্যন্ত প্রচুর বই লেখা হয়েছে,সিনেমাও হয়েছে অসংখ্য। রণদীপ হুদা ও আলিয়া ভাট অভিনীত জনপ্রিয় সিনেমা 'হাইওয়ে', এটিও কিন্তু স্টকহোম সিনড্রোম ব্যাপারকেই সমর্থন করে। সহজভাবে দেখলে বলা যায় যে,আমরা সবাই ই প্রায় এমন ঘটনা দেখেছি সেটা হোক সিনেমায় বা বইয়ে। বাংলা ফিল্মে হিরো হিরোইনকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়,পরবর্তীতে তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। শেষে নায়িকার বাবা পুলিশ নিয়ে এলে তখন দেখা যায় মেয়ে ওই কিডন্যাপার নায়ককেই সমর্থন করছে।

এ ব্যাপারগুলো আমাদের কাছে বেশ পরিচিত কেবল কখনো তলিয়ে দেখার সময়টা হয়নি বা গভীরভাবে ভাবিনি এগুলো নিয়ে। যাইহোক, Lucy Christopher তার 'Stolen:A letter to my captor' বইয়ে স্টকহোম সিনড্রোম নিয়ে একটা দারুণ উক্তি দিয়েছেন-

"And It’s hard to hate someone, once you understand them."

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করেআপনিও লিখুন

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা