শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকা- সমতা, সম্প্রীতি, অসাম্প্রদায়িকতার এক অনন্য নিদর্শন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
দেশটিতে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৯.৭ ভাগ মুসলমান, তবুও জাতীয় পতাকায় এই ধর্মকেও তারা স্থান দিয়েছে, কারণ, সংখ্যালঘু হলেও মুসলমানরাও তো মানুষ, দেশটির নাগরিক- এটি তারা বিশ্বাস করে...
শ্রী শব্দের অর্থ পবিত্র এবং লঙ্কা শব্দের অর্থ দ্বীপ। শ্রীলঙ্কা বলতে বোঝানো হচ্ছে পবিত্র দ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুন্দর একটি দ্বীপ রাষ্ট্রের নাম শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালের আগ পর্যন্ত দেশটি ব্রিটিশদের অধীনে ছিল। তখন নাম ছিল সিলন। ১৯৪৮ সালে যখন দ্বীপদেশটি স্বাধীনতা পেলো, তখনো তারা সিলন নামেই পরিচিত। তবে, ১৯৭২ সালে এসে দেশটির নতুন নামকরণ হয়, শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে যিনি গোটা পৃথিবীর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শ্রীলঙ্কার শাসনে ছিলেন, তার নেতৃত্বে নতুন নামকরণ হয় সিলনের। তখন থেকেই মূলত সিলনের পরিবর্তে শ্রীলঙ্কা হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপ দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধতা মিলিয়ে দেশটি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে।
তবে, এই দেশটির অনন্য একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে সম্প্রীতি এবং সমতা রাষ্ট্রীয়ভাবেই স্বীকৃত। যার উদাহরণ মিলবে শ্রীলঙ্কার জাতীয় পতাকাতেই। পৃথিবীর যে কয়টি দেশের পতাকা অনেক কালারফুল, তার মধ্যে শ্রীলঙ্কার পতাকা অন্যতম। লাল, সবুজ, কমলা এবং সোনালী রঙয়ের মিশেলে শ্রীলঙ্কার পতাকা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এই পতাকায় একটি সোনালী রঙয়ের সিংহ রয়েছে যার হাতে তলোয়ার, এই সিংহের ছবিটি একটি আয়তক্ষেত্র দ্বারা বেষ্টিত যার চারটা কোনে আছে সোনালী পাতা। এর বাইরে আরো একটি আয়তক্ষেত্র দ্বারা পুরো পতাকাটি তৈরি যেখানে সবুজ ও কমলা রঙয়ের দুটি ক্ষেত্র আছে আলাদা। কিন্তু, এইসব কিছু নিছকই অর্থহীন কিছু নয়, এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে অন্তর্নিহিত কিছু অর্থ।
১৯৪৮ সালে যখন শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হলো, তাদের একটি দ্বীপ রাজ্য ক্যান্ডির প্রাচীন পতাকাকেই তারা জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করে। যে পতাকায় ছিল তলোয়ারবাহী সিংহল সোনালী রঙয়ের সিংহের ছবি, যা লাল ক্ষেত্র দ্বারা পূর্ণ। কিন্তু, ১৯৫১ সালে এই পতাকায় যোগ হয় সবুজ ও কমলা রঙয়ের দুটি বক্স। কেন? শ্রীলঙ্কায় মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা সংখ্যায় বেশি, শতকরা ৭০ ভাগের বেশি মানুষ সেখানে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু, এছাড়াও সেখানে হিন্দু, মুসলিম, মুরস, তামিল সম্প্রদায়ও বাস করে। প্রতিটি ধর্ম ও সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে একেকটি রং। একারণে, আপনি শ্রীলঙ্কার পতাকায় সবগুলো ধর্মকে প্রতিনিধিত্বকারী রঙ খুঁজে পাবেন। এক পতাকায় যারা সব বর্ণ, ধর্ম, মতকে জায়গা দিয়েছে তাদের এই অসাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারা যায় না।
পতাকায় সবুজ রঙয়ের উলম্ব যে ক্ষেত্রটি আছে সেটি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং মুরস সম্প্রদায়কেও প্রতিনিধিত্ব করে। উল্লেখ্য, দেশটিতে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা মাত্র ৯.৭ ভাগ, তারপরেও জাতীয় পতাকায় এই ধর্মকেও স্থান দিয়েছে, কারণ, সংখ্যালঘু হলেও মুসলমানরাও তো মানুষ, দেশটির নাগরিক এটি তারা বিশ্বাস করে। যাইহোক, তার পাশেই কমলা রঙয়ের ক্ষেত্রটি প্রতিনিধিত্ব করে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী এবং তামিল সম্প্রদায়কে। যে সোনালী রঙয়ের বর্ডার দিয়ে পতাকাটি বেষ্টিত, সেটি বৌদ্ধ ধর্মের মতকে নির্দেশ করে। চারটি সোনালী পাতা বৌদ্ধ ধর্মে চারটি মৌলিক প্রতীক- প্রেম, সমবেদনা, পারস্পরিক সম্পর্ক এবং আত্মনিয়ন্ত্রণকে বোঝায়।
পতাকায় যে সিংহটিকে দেখা যায় তারও অর্থ আছে। এটি সিংহলিজ মানুষদের প্রতীক। সিংহের হাতে তলোয়ারটি নির্দেশ করে দেশটির সার্বভৌমত্ব। তলোয়ারের হাতল দ্বারা বোঝানো হয়েছে পানি, আগুন, বায়ু, পৃথিবী অর্থাৎ যে উপাদানগুলো দিয়ে এই দ্বীপ দেশটি গঠিত সেসবকে। লাল/মেরুন রঙ সিংহলিজ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে যারা দেশটির সবচেয়ে বড় সম্প্রদায়।
সব মিলিয়ে দেশটির জাতিগত ঐক্য ও বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে সব বর্ণ, মত, ধর্মের সমতাকে স্বীকার করে নিয়ে দেশটি জাতীয় পতাকা তৈরি করেছে। এই পতাকা কেবলই একটি পতাকা নয়, এটি অসাম্প্রদায়িক শ্রীলঙ্কাকে নির্দেশ করে। দেশটির প্রতি শ্রদ্ধা কার না আসবে, যে দেশ সব ধর্মকে সম্মান দিতে পারে, সব জাতের মানুষকে সম্মান দিতে পারে, সে দেশেরই তো সম্মান প্রাপ্য!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন