আকস্মিক মৃত্যু তার পথচলাটা স্তব্ধ করে দিয়েছে। একজন শ্রীদেবীর জন্ম কখনও হবে না আর। নায়িকা আসবে, জন্ম হবে আরও কত সুপারস্টারের, কিন্ত ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে বড় ফিমেল স্টারের নাম নিতে গেলে ‘শ্রীদেবী কাপুর’ নামটাই ঠোঁটের ডগায় এসে পড়বে বারবার।

২০১২ সাল। যশ চোপড়া স্টুডিওতে বসেছে ৫৮তম ফিল্মফেয়ারের আসর, আলো ঝলমলে মঞ্চে উপবিষ্ট দুই উপস্থাপক শাহরুখ খান এবং সাইফ আলী খান, দর্শকসারিতে বলিউডের নামজাদা তারকারা সেই সন্ধ্যের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছেন বহুগুণে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে হুট করেই শাহরুখ-সাইফ ঘোষণা করলেন, ১৯৮৬-৮৭ সালে দুবছর ফিল্মফেয়ার পুরস্কারটা দেয়া হয়নি, সেই পুরস্কারটা দিয়েই এবারের আসরের উদ্বোধন করতে চান তারা। পুরস্কার পাবেন কে?

দুটো সিনেমার নাম উচ্চারিত হলো দুই উপস্থাপকের মুখে, নাগিনা আর মিস্টার ইন্ডিয়া; দুটোরই নায়িকা ছিলেন শ্রীদেবী। লাল একটা গাউন পরে অপ্সরীর মতো তিনি বসেছিলেন স্বামী বনী কাপুরের সঙ্গে, একদম প্রথম সারিতে। দেখে কে বলবে, এই মহিলার বয়স পঞ্চাশ ছুঁতে চলেছে তখন? বোঝার সাধ্য ছিল কারো? তাকে বলা হতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম নারী সুপারস্টার। শিশুশিল্পী হিসেবে সিনেমায় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, নায়িকা হবার ইচ্ছেটা ছিল পুরোপুরি।

দক্ষিণ ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে বোম্বের বিশাল জগতটায় আগমন, নিজের প্রতিভায় সবকিছু জয় করার জন্যেই জন্ম হয়েছিল তার। একটা সময় ছিল, যখন তার নামেই সিনেমা চলতো, নায়কের নামের আগে উচ্চারিত হতো তার নামটা, তাকে ঘিরে সিনেমার গল্প ভাবতেন পরিচালক। সিনেমার পোস্টারে সবচেয়ে বড় ছবিটা থাকতো তার। ‘শ্রীদেবী’ নামটাই ছিল আশি আর নব্বইয়ের দশকে সবচেয়ে দামী ব্র্যান্ডগুলোর একটি।

সেই মানুষটা দুই বছর আগে হুট করে চলে গেলেন না ফেরার দেশে, মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে। জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজে, বাবা-মা দুজনেই দক্ষিণী। বাবা ছিলেন তামিল, মা তেলেগু। দক্ষিণের চারটা ভাষায় ছোটবেলা থেকে অনর্গল কথা বলতে পারতেন ছোটবেলা থেকেই। রঙিন পর্দায় অভিনয়ের হাতেখড়ি মাত্র পাঁচ বছর বয়সে। তামিল একটা সিনেমায় অভিনয়ের অভিষেক হলো তার, ১৯৬৯ সালে মুক্তি পেয়েছিল ‘থুনাইভান’ নামের সেই সিনেমাটা।

শ্রীদেবী ও তার পরিবার 

শ্রী আম্মা ইয়াঙ্গার আয়াপ্পান নামের ছোট্ট মেয়েটা তখন আধো আধো স্বরে কথা বলে, স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তার বাকী বন্ধুরা যখন গাদা গাদা হোমওয়ার্ক করতে ব্যস্ত তখন সে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জগতে ঢুকে গেছে। ১৯৭৫ সালে ‘জুলি’ নামের একটা সিনেমা দিয়ে বম্বেতে পরিচিত হলেন, এখানেও তিনি চাইল্ড আর্টিস্ট। চারবছর পরে নায়িকা হিসেবেই বলিউডে অভিষেক হয়ে গেল তার, সিনেমার নাম শোলভা সাভান, আমল পালেকারের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন শ্রীদেবী। তবে পুরো ভারতের দর্শকেরা তাকে চিনেছিল ‘হিম্মতওয়ালা’ দিয়ে। দারুণ নাচতে পারতেন তিনি, সেটাও বোধহয় দর্শকেরা ভালোভাবে খেয়াল করলো সেবার। ‘ন্যায়নো মে স্বপনা’ গানটা তো বলিউডের এখনও নস্টালজিক করে তোলে আশির দশকের বলিউডি দর্শকদের।

হিম্মতওয়ালার সাফল্যের পরে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত জিতেন্দ্র’র সঙ্গে জুটি বেঁধে ১৬টা সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন, তেরোটাই ছিল ব্যবসায়িকভাবে সফল। তবে একজনের ভরসায় কখনও বসে থাকেননি, নিজেই ওয়ান ওম্যান আর্মি হবার পথে হেঁটেছেন। ১৯৮৩ সালে কমল হাসানের সঙ্গে করেছিলেন সদমা, স্মৃতি হারানো একটা মেয়ের চরিত্রে শ্রীদেবীর অভিনয় ভোলার নয়। অল্প ক’দিন আগেই ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হিট সিনেমাটা (তখন পর্যন্ত) পেয়েছেন, এরমধ্যে মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জড একটা মেয়ের চরিত্রে অভিনয়ের চ্যালেঞ্জটা সবাই হয়তো নিতেন না। শ্রীদেবী নিয়েছিলেন, সেটায় লেটার মার্ক পেয়ে পাশও করেছিলেন। 

১৯৮৬ সালে সাপ হয়ে এলেন পর্দায়, সিনেমার নাম নাগিনা। লোকে যে অন্ধের মতো সাপের প্রেমেও পড়তে পারে, সেটা ‘নাগিনা’র ক্রেজ না দেখলে বোঝা যেতো না। অবশ্য সেই সাপের চরিত্রে যদি থাকেন শ্রীদেবী, দর্শকেরই বা কি করার আছে বলুন? সেবছরের দ্বিতীয় ব্লকবাস্টার হিট সিনেমা ছিল সেটা। এক বছর আগে ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিন তাকে নাম দিয়েছিল অবসংবাদিত এক নম্বর স্টার, এবার নাগিনা’র পরে বক্স অফিস ইন্ডিয়াও শ্রীদেবীকে একই নামে অভিহিত করলো।

শ্রীদেবী তখন মনে মনে হয়তো বলেছিলেন- ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত!’ পরের বছর অনিল কাপুরের সঙ্গে এলেন ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ সিনেমায়। শেখর কাপুরের এই সিনেমাটা তোলপাড় করে দিলো বক্স অফিস, রেকর্ডের ভাংচুর হলো অজস্র। সেকালের সেই সায়েন্স ফিকশন সুপারহিরো ফিল্মে শ্রীদেবীই ছিলেন প্রাণ। তার চার্লি চ্যাপলিনের গেটাপে সাজার দৃশ্যটা এখনও বলিউডের দর্শকদের কাছে এক কথায় অনবদ্য। মিস্টার ইন্ডিয়ার পরে আরও একটা নাম তার গায়ে সেঁটে গেল, ‘মিস হাওয়া হাওয়াই’!

অনিল কাপুরের সঙ্গে তার জুটিটাও ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। দুবছর বাদে আবার ইন্ডিয়ান বক্স অফিসে ঝড়, শ্রীদেবীর কল্যাণেই। যশ চোপড়ার পরিচালিত চাঁদনী সিনেমায় ঋষি কাপুরের সঙ্গে তার রোমান্স লুফে নিয়েছিল দর্শকেরা। গানগুলো হয়েছিল ভীষণ জনপ্রিয়। অমিতাভ বচ্চনের ক্যারিয়ারে তখন গোধূলিবেলা, জনপ্রিয়তায় ভাটার টান। সেই সময়ে তার ‘খুদা গাওয়াহ’ বক্স অফিসে সুপারহিট হলো। লোকে সেটার কৃতিত্ব শ্রীদেবীকেই দেয়। তখন শ্রীদেবীর সিনেমা মানেই বিশেষ কিছু, অন্তত প্রযোজকের মুখে হাসি নিশ্চিত।

এর আগে ‘চালবাজ’ সিনেমায় ডাবল রোলে অভিনয় করেছেন, অঞ্জু-মঞ্জু দুই চরিত্রে কি অদ্ভুত ট্রান্সফর্মেশন তার! একটা মানুষ, দুটো চরিত্র, দুটো ভিন্নধর্মী ফ্লেভার! অনিল কাপুরের সঙ্গে করেছেন ‘ও লামহে’, ‘জুদাই’। জুদাইতে তিনি নায়িকার ভালোমানুষি ছেড়ে ধরলেন কুটিল একটা ছদ্মবেশ, লোভী এক গৃহবধুর চরিত্রে অদ্ভুতরকমের বাস্তব তার অভিনয়। দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, যেন সত্যিই তার রূপের আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন লোভ!

১৯৯৭ সালে সিনেমাজগত থেকে বিদায় নিয়ে সংসারী হলেন। প্রযোজক বনী কাপুরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, এর আগে বাঙালী অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন, কিন্ত সেটা টেকেনি বেশিদিন। বনীকে নিয়ে সংসার পাতলেন, নামের পেছনে কাপুর পদবী যুক্ত হলো। তেত্রিশ বছর বয়সে, খ্যাতির তুঙ্গে থেকে ‘না’ বললেন সিনেমাকে। ফিরলেন পনেরো বছরের একটা ম্যারাথন বিরতির পরে, ২০১২ সালে। অভিনেত্রীদের দ্বিতীয় ইনিংস নাকি কখনোই ভালো হয় না, বি-টাউনে এমন একটা প্রবাদ চালু ছিল।

কিন্ত এসব প্রবাদ প্রবচন শ্রীদেবীর জন্যে নয়। তিনি ফিরলেন, রানীর মতো দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরলেন আবার রঙিন পর্দায়, তার চিরচেনা জায়গাটায়। এবার একটু উত্তমপুরুষে যাই, গৌরী সিন্ধের ইংলিশ ভিংলিশ, আমার দেখা শ্রীদেবীর প্রথম সিনেমা। আমি নব্বই দশকের দর্শক নই, হিন্দি ভাষাটা মোটামুটি বুঝতে শিখেছি যখন, ইংলিশ ভিংলিশ তখনকার সিনেমা। আমি অবাক হয়ে দেখি, অদ্ভুত একটা সিনেমা, যে সিনেমায় নায়ক নেই, গল্পটাই সেখানে নায়ক। আর পুরো গল্পটাকে টেনে নিচ্ছেন শাড়ী পরিহিতা আটপৌরে এক ভারতীয় ভদ্রমহিলা!

ইংরেজী না জানায় বিদ্রুপ সইতে হয় তাকে, সেই ভাষাটা শেখার কি প্রবল আগ্রহ তার! শেষ পরীক্ষাটা দিতে না পারার বেদনাকে যিনি ভালবাসায় রূপান্তরিত করে ছড়িয়ে দেন নিজের হাতে বানানো লাড্ডুর ভেতরে! ওই একটা সিনেমা, দুই ঘন্টা সময়, আমি শ্রীদেবীতে বুঁদ হয়ে থাকি। খানিকটা বুঝতে পারি, কেন আশি আর নব্বইয়ের দশকের দর্শকেরা বাকী সবকিছু ছেড়ে এই মহিলার প্রেমে পড়েছিল।

‘মম’ সিনেমায় অভিনয় করলেন তিনি, তার ক্যারিয়ারের তিনশোতম সিনেমা। শ্রীদেবী কি জানতেন, ট্রিপল সেঞ্চুরী পূরণ করেই থেমে যেতে হবে তাকে? কেউ ভাবতে পেরেছিল এমনটা? রাজসিক একটা প্রত্যাবর্তনের পরে সিনিয়র অভিনেত্রী হিসেবে তিনি দাপিয়ে বেড়াবেন পর্দা, এমনটা হতে পারতো। কিন্ত বিধাতার স্ক্রীপ্টটা সিনেমার চেয়ে অনেকটা আলাদা ছিল। তাই হয়তো অকালেই চলে যেতে হলো, একটা ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে গেল তাতে, অদ্ভুত একটা শূন্যতা তৈরী হলো। পনেরো বছর রঙিন দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন শ্রীদেবী, তার অভাব অনুভূত হয়েছে, কিন্ত আশাও তো ছিল, একদিন তিনি ফিরবেন। তিনি ফিরেছিলেন ঠিকই, কিন্ত সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না, এটাই চির আক্ষেপ।

ক্যারিয়ারে ছয়টা ফিল্মফেয়ার আছে তার, এরমধ্যে তিনটা বলিউডি সিনেমার জন্যে, বাকি তিনটা দক্ষিণী। নিজের শেকড়টাকে কখনও ভুলে যাননি তিনি, ক্যারিয়ারের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার সময়টাতেও নিয়মিত কাজ করেছেন তামিল-তেলেগু সিনেমায়, মালয়লাম ইন্ডাস্ট্রিতেও তার পায়ের ছাপ পড়েছিল। অমিতাভ থেকে রজনীকান্ত, কমল হাসান থেকে অনিল কাপুর, সময়ের সেরা তারকাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি, অথচ সিনেমার ঔজ্জ্বল্যটুকু সবসময়ই নিজের ওপরে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি, কারো ছায়ায় ঢাকা পড়েননি কখনও। তার নামেই সিনেমা চলতো, দর্শক শ্রীদেবীকে দেখার জন্যে, শ্রীদেবীর নাচ দেখার জন্যে সিনেমা হলে ভীড় জমিয়েছে।

মেয়ে জাহ্নবীও সিনেমায় নাম লিখিয়েছেন, অভিষেক হয়েছে তার। জাহ্নবী হয়তো বড় তারকা হবেন একদিন, শ্রীদেবীর ছায়া থেকে বেরিয়ে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবেন, কিন্ত যে মা’কে নিজের আইডল ভেবে এসেছেন সারাজীবন, তাকে নিজের অভিনীত সিনেমা দেখাতে পারবেন না কখনও। এই আক্ষেপটা হয়তো সারাজীবন সঙ্গী হয়েই থাকবে তার। একটা স্বতন্ত্র যুগের মতোই ছিলেন শ্রীদেবী। বলিউডে তার আগে নায়িকারা এসেছেন, কিন্ত প্রথম নারী সুপারস্টারের খেতাবটা নিজের গায়েই জড়িয়েছেন তিনি।

তার মতো প্রভাবশালী কি কেউ এসেছেন গত দুই যুগে? মাধুরী, ঐশ্বরিয়া থেকে আজকের দীপিকা-প্রিয়াঙ্কা, সুপারস্টারের তকমা বেশ কয়েকজনই পেয়েছেন, কিন্ত শ্রীদেবী অনন্য, অন্যরকম একজন। তার মধ্যে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ছিল, আলাদা একটা চার্ম, যেটা আপনাকে পর্দার সামনে টেনে বসিয়ে রাখবে, অপার মুগ্ধতায় বিস্মিত হতে বাধ্য করবে বারবার। চুয়ান্ন বছর বয়সটা চলে যাওয়ার নয়। আকস্মিক মৃত্যু তার পথচলাটা স্তব্ধ করে দিয়েছে। একজন শ্রীদেবীর জন্ম কখনও হবে না আর। নায়িকা আসবে, জন্ম হবে আরও কত সুপারস্টারের, কিন্ত ভারতীয় সিনেমার সবচেয়ে বড় ফিমেল স্টারের নাম নিতে গেলে ‘শ্রীদেবী কাপুর’ নামটাই ঠোঁটের ডগায় এসে পড়বে বারবার।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা