দুধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও কিছু মিশনের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থা এটি। অবিশ্বাস্য সব মিশন তাদের, নিষ্ঠুর সব হত্যা। আজকে থাকছে মোসাদের গল্প!
বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাটি কোন দেশের? আমেরিকা, ভারত নাকি রাশিয়া? এই দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থা বেশ শক্তিশালী হলেও সবচেয়ে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাটি আসলে ইসরায়েলের। এই গোয়েন্দা সংস্থাটির নাম ‘মোসাদ’।
এই মোসাদকে ঘিরে জড়িয়ে আছে অজস্র মুখরোচক, চাঞ্চল্যকর ও রহস্যঘেরা তথ্য! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার পৃথিবীর সব ইহুদি হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। নাৎসিদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতো।
ওই সময় যে ইহুদিরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা তখন নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করেন। ইহুদিরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছে, এর জন্যে তারা বেছে নিয়েছিলো প্যালেস্টাইনকে। আর এই কাজে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখে ইহুদিদের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। মোসাদের নীতি খুবই সহজ, নিজেদের স্বার্থরক্ষায় যেকোনো কিছু করতেই তারা প্রস্তুত।
মোসাদের জন্ম
১৯৪৮ সালের ১৪ মে বিতর্কিতভাবে আরব দেশগুলোর বিরোধিতার মুখে একরকম গায়ের জোরেই প্যালেস্টাইনের মূল ভূখন্ডের অর্ধেক জায়গা দখল করে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল নামক রাষ্ট্রটি। আর মোসাদ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। ‘Central Institute of Co-ordination’ নামে এর কার্যক্রম শুরু হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মোসাদ’ নাম দিয়ে এটির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৫১ সালের মার্চের শেষের দিকে। এর কর্মচারী-কর্মকর্তারা সংখ্যায় কত তার সঠিক তথ্য নেই। তবে ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা ১হাজার দুইশ'র মতো হতে পারে। মোসাদে যারা কাজ তাদের অধিকাংশই মিলিটারি ফোর্সের সদস্য।
কীভাবে মোসাদ কাজ করে
মোসাদের এতটাই প্রভাব যে, প্রচলিত আছে যত দিন মোসাদ থাকবে, তত দিন পর্যন্ত ইসরায়েলকে কেউ কোনোভাবেই ক্ষতি করতে পারবে না। বহিঃবিশ্বে ইসরায়েলের দাপট, প্রভাবও দিন দিন বেড়ে চলেছে। আমেরিকার রাজনীতিতে ইহুদি প্রভাব আজ কারো অজানা নয়। ইহুদিরা সংখ্যায় অল্প হলেও বর্তমান বিশ্বরাজনীতি এবং বাণিজ্যিক কার্যক্রমে তাদের প্রভাব খুবই প্রকট।
মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোর উপর বিশ্বের অন্যান্য দেশের সহযোগিতা কিংবাপ্রতিবন্ধকতার নির্ধারক হিসেবেও তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একটা বড় অংশই ইহুদি। শিক্ষায়, বাণিজ্যে ইহুদিরা দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।
মোসাদের এই রহস্যময় শক্তির পেছনে আছে তাদের দুর্ধর্ষ পরিচালনাপদ্ধতি। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে কাজ করে থাকে মোসাদ। তাই তাদের সম্পর্কে সবটুকু জানা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তবু কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে থাকা অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালিত হয় মোসাদের মোট ৮টি বিভাগ। এই বিভাগগুলো মোসাদকে পরিচালনা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কালেকশন ডিপার্টমেন্ট। এই বিভাগের এজেন্টরা ডিপ্লোম্যাট, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য ছদ্মবেশে কাজ করেন। তাদের মূল কাজ তথ্য, ঘটনা, ঘটনার গতি প্রকৃতি সংগ্রহ করা। এরা গুপ্তচরের মতো কাজ করে থাকে। এদের বলা হয়, কাটসাস।
“রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ” নামে একটি বিভাগ আছে মোসাদের। এই বিভাগের কর্মীরা দেশের রাজনৈতিক নেতা, অন্য দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও যেসব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক যোগাযোগ নেই, সেসব দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। প্রয়োজনে অর্থ ও নারীসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এ ছাড়া অন্য দেশের কূটনৈতিক ও দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এই বিভাগের কর্মীরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখে।
মোসাদের আছে নিজস্ব “গুপ্তহত্যা বিভাগ”। এই গ্রুপটির সক্ষমতা এমন যে এরা চাইলে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে একযোগে ১৩/১৪ টি অপারেশন চালাতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই বিভাগের সক্রিয় স্টেশন আছে। বিভাগটি তাদের সাথে সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে। সিক্রেট কিলিং এর জন্য এই বিভাগের বিকল্প আর কিছু নেই।
“ল্যাপ ডিপার্টমেন্ট” নামে আরকটি গ্রুপ কাজ করে। এরা প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। যাবতীয় যুদ্ধের পরিকল্পনাও এখান থেকেই করা হয়। মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের জন্য প্রচার চালায়। শত্রুশিবিরে ভুল খবর ছড়িয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে থাকে। গুপ্তহত্যা, আধা-সামরিক অপারেশন, নাশকতামূলক কাজ, রাজনৈতিক কলহ তৈরি বা প্রোপাগান্ডা চালানো এই বিভাগের কাজ।
“রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট”- এর গবেষকরা বিভিন্ন প্রযুক্তিগত জিনিস উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা করে। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, ধারণা ও তত্ত্ব প্রচার, নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার এবং তার সঠিক ব্যবহার ছাড়াও গবেষণা কাজের জন্য ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি গঠন করা এই বিভাগের দায়িত্ব। ইসরায়েলের ভেতরে ও বাইরে কাজ করে, এমন সব গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে এই কমিউনিটি গঠন করা হয়।
মোসাদের ফ্যাসাদ!
মোসাদ তার জন্মলগ্ন থেকেই কুখ্যাত অনেক ঘটনার জন্মদাতা। কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে-
এডলফ ইচম্যান হত্যা: নাৎসি যুদ্ধে অভিযুক্ত এডলফ ইচম্যানকে অনেকদিন ধরে খুঁজছিল মোসাদ। ১৯৬০ সালের দিকে তাকে পাওয়া যায় আর্জেন্টিনায়। সে বছর মোসাদের এজেন্টরা তাকে গোপনে আটক করে। ইসরায়েলে নিয়ে আসে। তার বিরুদ্ধে উত্তর ইউরোপে ক্যাম্প গঠন ও পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে ইহুদিদের হত্যার অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে ইসরায়েলের আদালতে একটি সাজানো বিচারের মাধ্যমে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রযুক্তিগত তথ্য চুরি: ১৯৬০ সাল। ফ্রান্সের মিরেজ ফাইভ জেট বিমানের প্রযুক্তিগৎ বিভিন্ন তথ্য দলিল চুরি করে নেয় মোসাদ। পরে ইসরায়েল এই দলিলের তথ্য কাজে লাগিয়ে বিমান-প্রযুক্তিকে আরো উন্নত ও যেকোনো আবহাওয়ার উপযোগী করেজে-৭৯ নামের ইলেকট্রনিক টার্বোজেট ইঞ্জিন তৈরি করে।
ইরাক অপারেশন: ১৯৬৬ সালে মিগ-২১ জঙ্গি বিমানের পাইলট ছিলেন মুনির রিদফা। ১৯৬৬ সালে তাকে বিমানসহ কৌশলে ইরাক থেকে ইসরায়েলে নিয়ে আসে মোসাদ এজেন্টরা। তার কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। শুধু তা-ই নয়, পরে তাকেই ব্যবহার করা হয় ইরাকবিরোধী প্রচারণায়।
অপারেশন প্লামব্যাট: ১৯৬৮ সালে ইজরাইলের একটি শিপে ২০০ টন ইউরেনিয়াম অক্সাইড সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে একটি কার্গো বিমান যাত্রা শুরু করেছিল। বলে রাখা ভালো, ইউরেনিয়াম অক্সাইড পারমাণবিক বোমার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জার্মানির আকাশে বিমান উড়ছিলো। কিন্তু তারা বুঝে ওঠার আগেই বিমানটি তাদের রাডারের বাইরে চলে যায়। পরে তুরস্কের একটি পোর্টের রাডারে ধরা পড়লেও ওই কার্গো বিমান থেকে বলা হয় পথ হারিয়ে তারা এই দিকে চলে এসেছে। তাদের জ্বালানিও ফুরিয়ে গেছে। গালফ থেকে জ্বালানি নিয়ে তারা আবার ফিরে যাবে। কিন্তু আড়ালে তারা নিরাপদেই “ইউরেনিয়াম অক্সাইড”গুলো ইসরায়েলের একটি শিপে খালাস করে দেয়। এটি ছিল লেকেম ও মোসাদের একটি যৌথ অপারেশন।
অপারেশন স্প্রিং অব ইয়ুথ: ১৯৭৩সালের ৯ এপ্রিল রাতে ও ১০ এপ্রিল ভোরে লেবাননে বিমান হামলা চলে। একই সময়ইজরাইল ডিফেন্স ফোর্সের স্পেশাল ফোর্স ইউনিট বৈরুত, সিডন ও লেবাননে পিএলওর টার্গেটকৃত নেতাদের খুঁজছিল। তারা সম্ভাব্য স্থানগুলোতে হামলা করছিল। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছিল “অপারেশন স্প্রিং অব ইয়ুথ”।
মন্ত্রী খুন: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও কূটনৈতিক এবং চিলির সাবেক মন্ত্রী অরল্যান্ডো লেটেলার’কে ওয়াশিংটন ডিসিতে গাড়ি বোমায় হত্যা করা হয় ১৯৭৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে। পরবর্তী সময়ে জানা যায়,এটি ছিল মোসাদের একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মন্ত্রীর সাথে তার সহকারী রনি কার্পেন মোফিট্টও খুন হন। রনি কার্পেন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক।
অপারেশন আন্টাবি: এই অপারেশনটি চালানো হয় মূলত আটককৃত বন্দীদের মুক্ত করার জন্য। ১৯৭৬ সালে এই ঘটনা ঘটে। মোসাদ এজেন্টরা উগান্ডায় এয়ার ফ্রান্স ফাইট ১৩৯ বিমানটি ছিনতাই করে।
বিজ্ঞানী খুন: ১৪ই জুন, ১৯৮০। বিজ্ঞানী Yahya El Mashad-কে খুন করে মোসাদ। তার চারিত্রিক দূর্বলতাকে কাজে লাগায় মোসাদ ইন্টিলিজেন্স। তার কাছে সেদিন যে প্রস্টিটিউট তাকে যৌনসেবা দিতে গিয়েছিলো, ধারনা করা হয় সে ছিলো মোসাদের এজেন্ট। যাই হোক, তার গলাকাঁটা লাশ পাওয়া যায়। এই বিজ্ঞানী মূলত কাজ করতেন সাদ্দামের গোয়েন্দাবাহিনীর পক্ষ হয়ে। তার কাছ থেকে ইরাকে তৈরি হতে থাকা নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরের গোটা মডেল হাতে পেয়ে যায় মোসাদ।
অপারেশন স্ফিঙ্কস: ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইরাকের নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের (নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ারশক্তি উৎপাদনের জন্য যন্ত্রবিশেষ) স্পর্শকাতর কিছু ব্যাপারে গোয়েন্দারা ব্যাপক তৎপরতা চালায়। এই অপারেশনের নাম দেয়া হয় অপারেশন স্ফিঙ্কস। ইরাক এই গবেষণা সম্পন্ন করতে পারলে পারমাণবিক গবেষণায় বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে অগ্রবর্তী থাকত। মোসাদ মনে করেছিল এখনই যদি এই প্রোগ্রাম ধ্বংস করা না হয় তাহলে শিগগিরই গবেষণা সেন্টারে পারমাণবিক অস্ত্রের কাঁচামাল সরবরাহ করা হবে। মোসাদ তাই ১৯৮১ সালে অপারেশন অপেরা নামে একটি অপারেশন চালিয়ে এই প্রকল্পের এতটাই ক্ষতি করে যে ইরাক এই প্রকল্পটি পরে আর চালিয়ে যেতে পারেনি।
নাইন ইলেভেন ও মোসাদ সম্পৃক্ততা: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে চার হাজার ইহুদি কাজ করতো বলে জানায় ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। কিন্তু বিমান হামলায় মাত্র একজন ইহুদি নিহত হয়। পরে অবশ্য আরো দু’জনের নিহতের কথাও বলা হয়। তবে, সেদিন এত বিপুল সংখ্যক ইহুদি কিভাবে নিরাপদে ছিল তার জবাব আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। যদিও এই হামলার ঘটনায় ওসামা বিন লাদেন ও তালেবানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। আর শাস্তি হিসেবে দখল করে নেয়া হয়েছে ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ দেশ আফগানিস্তান। এই পুরো ঘটনায় মোসাদের জড়িত থাকার ব্যাপারে সন্দেহ করা হয়।
আইএস-এর সাথে মোসাদের সম্পৃক্ততা: বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাবী করা হয়েছে আইএস নেতা খলিফা আবু বকর আল বাগদাদির আসল পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন ইহুদি। তার মূল নাম বলা হচ্ছে, আকা ইলিয়ট শিমন। আইএস এর শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতারাই মোসাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে বিভিন্ন বিদেশী গণমাধ্যম এর খবরে উঠে এসেছে। বলা হয় যে, মোসাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতেই আইএস জঙ্গিদের যুদ্ধকৌশল শেখানো হয়।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন