সৌমিত্র শেষমেশ 'ফেলুদা' হয়েই এলেন পর্দায়। হলেন বাঙ্গালীর সারাজীবনের প্রেম, 'সোনার কেল্লা'র নায়ক! 'ফেলুদা'র যাবতীয় আবেগকে চাদরের নীচের সেই ট্রেডমার্ক সুতির পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলেন তিনি, গোটাটাই।

ফেলুদার সাথে পরিচয় অদ্ভুতভাবে। সদ্য সদ্য স্কুলে যাচ্ছি। টিনটিন, চাচা চৌধুরী, হাত কাটা রবিন পড়ছি। এক দুপুরে স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছি। পড়ার টেবিলে পড়ে আছে এক বই। সাদা মলাট। যত্নে মুড়ে রাখা। বইয়ের নাম- শ্রেষ্ঠ ফেলুদা। যে বইয়ের প্রথম উপন্যাস- ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি। যে উপন্যাসের প্রথম লাইন- রাজেনবাবুকে রোজ ম্যালে আসতে দেখি আর সে সাথে তারার মত জ্বলজ্বলে ইলাস্ট্রেশন; ছোট্ট তোপসে আর ফেলুদা। মনে আছে, সব বাদ দিয়ে শুরু করেছিলাম পড়া। এরপর পেরিয়েছে অনেক বছর। তবু চোখ বুজলে সেই পুরোনো দৃশ্য; সেই প্রথম লাইন আর চকচকে ইলাস্ট্রেশন। বড়ভাই আমাকে বইটি কিনে দিয়েছিলেন। সেই শুরু। ফেলুদা গ্রাস করে নিয়েছিলো সেদিনই। সেই বই, ইলাস্ট্রেশন আর কালো কালো অক্ষর দেখতে দেখতে কখন যে বয়স হয়ে গেছে অনেকটা, খেয়াল করলাম, এই তো গতকাল। যখন ফেলুদা আর নেই! 

বয়স বাড়ার পরে 'স্মৃতি'কে দখলে নিয়েছে সিনেমা;  সোনার কেল্লা। আমার চোখে সব্যসাচী ছিলেন আসল ফেলুদা। গম্ভীর চাহনি, তীক্ষ্ম চেহারা, জমাটি কন্ঠ... সবটাই তো আছে সব্যসাচীর মাঝে। কিন্তু গতকাল শেষ রাতে আমি আবিষ্কার করি, আমার ফেলুদা যে ছিলেন, তিনি আর নেই। রক্তমাংসের জীবন শেষ করে বইয়ের পাতাতেই ফিরে গিয়েছেন আবার, পঁচাশি বছরের পুরোনো শরীর রেখে আবার নেমেছেন এ্যাডভেঞ্চারে। চোখ একটু অন্ধকার সয়ে নিলেই নেমে যাচ্ছে পর্দা। ফুটে উঠছে 'সোনার কেল্লা', টুকরো কাঁচের রাস্তায় ফেলুদার চিৎকার 'আছে, আছে, আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে', জাতিস্মর মুকুল, ডঃ, হাজরা, পিসি মিটার, জটায়ূর কুকড়ি...একের পর এক। অঙ্ক মিলিয়ে। সব। 'জয় বাবা ফেলুনাথ'ও বাদ যাবে কীভাবে? বিশ্বশ্রী গুনময় বাগচীর কিলবিলে মাসল, কাশির মন্দিরে-ঠাসা গলি, দেয়ালে পিঠ; মগনলাল মেঘরাজ, ফেলুদার হাতে কোল্ট রিভলবার, ঠান্ডা চোখ, মছলিবাবা... চোখে ভেসে আসছে সব। একের পর এক। যেন ভরা চাঁদ-তারা-নক্ষত্রের নীচে আদ্যিকালের বায়োস্কোপ, ভেজা বাতাসে ফিসফিস- আমি ছিলাম! আমিও ছিলাম! 

জয় বাবা ফেলুনাথ; সত্যজিৎ-সৌমিত্র'র আরেক মাস্টারপিস! 

সত্যজিৎ রায়ের 'ফেলুদা' লিখতে বসা একরকমের বাধ্য হয়েই। যদি খোলামেলাভাবে বলি, আটঘাট ভেবে তিনি লিখতে বসেননি এই চরিত্রকে। টাকার দরকার ছিলো। তাই ফরমায়েশ মেনে এক কাল্পনিক চরিত্র ফেঁদে বসা। সেই 'ফেলুদা'ই যখন সিরিজ আকারে প্রথম প্রকাশিত হলো পত্রিকায়, কী যেন একটা হয়ে গেলো পাঠকের হৃদয়ে। দীপাবলির রাতে তারাবাতির প্যাকেট হাতে পেলে যেমন লাগে, অনেকটা সেরকম। রীতিমতো বিপ্লব। ফেলুদা হয়ে গেলেন খুব পরিচিত। খুব কাছের। ঘরের ছেলে। ভেতরে ভেতরে 'ফেলুদা' হতে চাইলেন সবাই। 'ফেলুদা' হতে চাইলেন সৌমিত্রও। তবে মুখ ফুটে কোনোদিন নিজের আগ্রহের কথা জানানো হয়নি। ততদিনে সত্যজিৎ রায়ের সাথে বেশ কয়েকটি সিনেমা করে তিনি বিশপ লেফ্রয় রোডের সেই তিনতলার নিয়মিত মুখ। একদিন সত্যজিৎ রায়কে খুব ভেবেচিন্তে জিজ্ঞেস করলেন-  

মানিকদা, ফেলুদার ইলাস্ট্রেশনগুলো আপনার সাথে খুব মিলে যাচ্ছে। আপনি কী ফেলুদাকে নিজের মত করেই তৈরী করেছেন? 

সত্যজিৎ রায় হেসে উত্তর দিয়েছিলেন সৌমিত্রকে- 

বলছো কী হে? সবাই যে বলে, ইলাস্ট্রেশনগুলো তোমার মত হয়ে যাচ্ছে?

এরপর বহুবার ফেলুদার বইয়ের প্রচ্ছদে দেখেছি সৌমিত্রের সাথে ফেলুদার মুখের আদলের মিল। শেষমেশ সৌমিত্র 'ফেলুদা' হয়েই এলেন পর্দায়। হয়ে রইলেন বাঙ্গালীর সারাজীবনের প্রেম, সোনার কেল্লা'র নায়ক!  'ফেলুদা'র যাবতীয় আবেগকে চাদরের নীচের সেই সুতির পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলেন তিনি, গোটাটাই। সোনার কেল্লা নিয়ে হাসতে হাসতেই বললেন-  

সিনেমা তো অনেক করেছি। কিন্তু সোনার কেল্লা চিত্তজয়ী। 

যখন কোথাও 'সোনার কেল্লা'র  আবহসংগীত শুনি, মাঠের মাঝখানে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে যাচ্ছে ট্রেন, উটের পিঠে ফেলুদা-তোপসে-লালমোহনবাবু... টাল সামলাতে পারি না। হাজারো সমস্যা যাপিত জীবনে। সব হেলা করে উঠে বসি ফেলুদার পিছুপিছু। একই ট্রেনের কামরায়। যে কামরায় একটু পরে উঠবেন জটায়ু। কুলিকে এক্সট্রা টাকা না দিয়ে বলবেন- 

তাং মাত করো। কাফি হোগায়া।

ফেলুদা সকালের ডিম অমলেটে কামড় দিতে দিতে তাকাবেন সেদিকে। দেখবেন জটায়ুর পাগলামি। পরিচিত হওয়ার পর তোপসেকে অটোগ্রাফসহ পূজোসংখ্যায় বের হওয়া বইটা উপহার দেবেন রহস্যরোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলী। আমি কামরার খুব পেছনের সারিতে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখবো সব। 

'সোনার কেল্লা'র সেই ট্রেন সিকোয়েন্স; বাঙ্গালীর চোখে লেগে থাকবে আমৃত্যু! 

এ জীবন অদ্ভুত। বয়স হতে হতে অনেক কিছু হারিয়ে যায়। হারিয়ে গিয়েছে রকি বীচ, স্যালভিজ ইয়ার্ড, তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা। হারিয়ে গিয়েছে শ্যাওড়াগাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা খোনাস্বরের মেছোপেত্মী, শুক্রবারের আলিফ লায়লা, মনে পড়েনা চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিঙ্কিকেও। হারিয়ে গিয়েছে কালো ধোঁয়া ওড়ানো ট্রেন, পিছিয়ে পড়েছে উটের পিঠে ফেলুদা। পিছিয়ে যেতে যেতে ফেলুদা মিলিয়ে গিয়েছে দিগন্তেই। আমরা ভাবি, একজন মানুষ মারা গিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত লাইনটা দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার হেডিং এ-ই উঠে এসেছে-

World Loses a Touch of Ray

মানিকের 'মানিক' ফিরে গিয়েছেন তার কাছেই। হয়তো আরেক সিনেমার শ্যুটিং শুরু হবে আবার! অন্তরীক্ষের ওপারে! কে জানে! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা