পাকিস্তানী শিল্পীদের পক্ষে কথা বলা, রয়্যালিটি নিয়ে মুখ খোলা, আজান নিয়ে মন্তব্য- সনু নিগমকে বারবার পড়তে হয়েছে তোপের মুখে। কিন্ত সবকিছু ছাপিয়ে এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে, সনুর যা প্রতিভা, তার তিন ভাগের একভাগও আবিস্কার করা যায়নি আজও...

গত তিন দশকে ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে আসা সেরা প্রতিভা কে- এই প্রশ্নটা করা হলে আমি চোখ বন্ধ করে সনু নিগমের নাম বলে দিই। অরিজিত সিং বা মোহিত চৌহানের মতো দুর্দান্ত শিল্পীদের কথা মাথায় রেখেও এই স্টেটমেন্ট দেয়া যায়, কারণ সাতচল্লিশে পা দেয়া এই ভদ্রলোক যে পরিমাণ মেধার ভাণ্ডার নিয়ে বসে আছেন, তার সঙ্গে কেবল তার নিজেরই তুলনা চলে, অন্য কারো নয়। সনু নিগম ভারতীয় সঙ্গীত ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম, সেই সঙ্গে বিশাল বড় একটা আফসোসের নামও। ইন্ডিয়ান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখতে গেলে, সেখানে বড়সড় একটা অধ্যায় থাকবে আফসোসে ভরা, সেই আফসোসের নাম- সনু নিগমের প্রতিভাকে ব্যবহার করতে না পারা!

চার্লি চ্যাপলিনের সঙ্গে সনু নিগমের দারুণ একটা মিল আছে। চার্লির মা একটা নাইটক্লাবে কাজ করতেন, কাজ বলতে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে রাতে মদ খেতে আসা শ্রমিকদের সামনে গান গাওয়া। একদিন হুট করে গলা বসে গেল। আওয়াজ বেরুচ্ছিল না কণ্ঠ থেকে। মানুষজন যখন হাসাহাসি শুরু করেছে, তখন মঞ্চ থেকে পালিয়ে গেলেন ভদ্রমহিলা। মায়ের দুরবস্থা দেখে ব্যাকস্টেজ থেকে ছুটে এলেন চার্লি, নিজেই ঘাড় দুলিয়ে শুরু করলেন গান গাওয়া, একটু আগেই গলা ছেড়ে হাসতে থাকা মানুষগুলো আচমকা শান্ত হয়ে গেল, মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো বাচ্চা ছেলেটার গান।

মহান শিল্পীদের জন্ম নাকি এমন হঠাৎ করেই হয়। সনু নিগমের আগমনটাও এরকম আচমকা হয়েছিল। বাবা ছিলেন গানের মানুষ, হরিয়ানার ফরিদাবাদ শহরে স্টেজ শো করে বেড়াতেন। সনুর বয়স যখন চার বছর, তখন বাবা তাকে তুলে নিলেন স্টেজে, বসিয়ে দিলেন মাইকের সামনে। বাবার সাথে অল্প কিছুদিন আগেই গানের রেওয়াজ শুরু করা সনু একটুও ভয় না পেয়ে গলায় তুললেন কিংবদন্তী গায়ক মোহাম্মদ রফির গান- 'ক্যায়া হুয়া তেরা ওয়াদা'! হাজার দুয়েক লোক ছিল সেদিন ফরিদাবাদের সেই লোকাল কনসার্টে, তিন-সাড়ে তিন মিনিট ধরে সেখানে পিনপতন নীরবতা, তারপর চিৎকারে ফেটে পড়লো সবাই। বাচ্চা একটা ছেলে এত সুন্দর করে গান গাইতে পারে, এটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না কারো।

ফরিদাবাদ ছোট্ট শহর, লোকের মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। এক সপ্তাহের মধ্যে শহরের বড়সড় তারকায় পরিণত হলেন চার বছরের সনু। বাবা চাইলেই পারতেন, ছেলের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে টাকা কামাতে। সেটা তিনি করেননি। ছেলেকে তিনি গায়ক হবার শিক্ষা দিয়েছিলেন, তারকা হবার নয়। এই শিক্ষাটা সনু নিগম তার গোটা জীবনেই কাজে লাগিয়েছেন। সেই কথায় পরে আসছি।

সনু নিগম

সনুর বয়স যখন আঠারো, তখন তার পরিবার মুম্বাইতে চলে এলো, উদ্দেশ্য একটাই, সনু যাতে গানের দুনিয়ায় নিজের অবস্থান তৈরি করে নিতে পারে, ভালো একটা ব্রেক পায়। সেই ব্রেকটা এলো মুম্বাইতে আসার ছয় বছর বাদে। টি সিরিজের গুলশান কুমার মোহাম্মদ রফিকে ট্রিবিউট দিয়ে একটা অ্যালবাম বানাবেন, সেখানে গান গাওয়ার সুযোগ পেলেন তরুণ সনু। রেকর্ডিং স্টুডিওতে হাজির ছিলেন গুলশান নিজেই, তিনি মুগ্ধ হয়ে শুনলেন সনুর গায়কী। হীরে চিনতে ভুল হয় না গুলশান কুমারের, তিনি সেখানেই বুঝে গিয়েছিলেন, আগামী কয়েক বছর সঙ্গীত জগতে এই ছেলের রাজত্ব চলবে।

টি সিরিজের ব্যানার থেকেই সনুর পপ ঘরানার অ্যালবাম 'দিওয়ানা' রিলিজ পেলো, তুমুল ব্যাবসা করলো সেটা। মুম্বাইয়ের অলিতে গলিতে, পাড়ায় মহল্লায় বাজতে থাকলো সনুর গান। ডাক এলো সিনেমাতেও। 'সন্দেশ আতে হ্যায়' সিনেমায় প্রথম প্লেব্যাক করলেন, একই বছর রিলিজ পেলো পরদেশ। এই সিনেমার 'ইয়ে দিল দিওয়ানা' গানটা সুপারহিট হয়ে গেল, তরুণদের মুখে মুখে ঘুরতে লাগলো লাইনগুলো, তারকাখ্যাতি যুক্ত হলো সনুর নামের পাশে।

পরের কয়েকটা বছর তিনি একটানা রাজত্ব করেছেন মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে, নিজের গলার কারুকার্য আর মাধুর্যে মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের। 'ইশক বিনা' 'সুরুজ হুয়া মাধ্যম', 'সাথিয়া', 'কাল হো না হো', 'কাভি আলবিদা না কেহনা', 'ম্যায় হু না', 'দো পাল রুকা', 'পিয়া বোলে', 'ম্যায় আগার কাঁহু' 'আভি মুঝ মে কাহি', 'ভগবান- হ্যায় কাঁহা রে তু'- একের পর এক চার্টবাস্টার গান উপহার দিয়ে গেছেন তিনি, ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছেন নিজেকে। ২০০০-২০০৭ সালের সময়টাতে তার যে জনপ্রিয়তা ছিল, সেটা যারা চোখে দেখেনি, তারা কল্পনাও করতে পারবে না।

তখন ইন্টারনেট ছিল না, লাইভ গান শোনার জন্য কনসার্টই ছিল ভরসা। একটা উদাহরণ দেই- সনু হয়তো কলকাতার বোলপুরে আসবেন, এক মাস আগেই টিকেট শেষ হয়ে গেছে অনুষ্ঠানের! নির্ধারিত দিনে পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য, রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, যেন বড়সড় কোন মেলা বসেছে। দূর্গাপূজার সময়ও এমন ভীড় দেখেনি বোলপুরের মানুষ। সনু স্টেজে উঠে দাঁড়াতেই যেন মঞ্চের সামনের অংশে একটা টর্নেডো বয়ে যেতে শুরু করলো, গান গাওয়ার সময় মাইকের আওয়াজ ছাপিয়ে শোনা যেতে থাকলো মানুষের গগনবিদারী চিৎকার, তারাও গলা মেলাচ্ছেন প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে! সনু নিগমের ক্রেজ এমনটাই ছিল।

সনু নিগম: গত ত্রিশ বছরে ভারতের সেরা সঙ্গীত প্রতিভা

কনসার্টে মঞ্চে উঠে সনু যা করতেন, সেটা ভারতের আর কোন শিল্পী করে দেখাতে পারেননি কখনও। জনপ্রিয় আর কিংবদন্তী সব শিল্পীদের অবিকল নকল করতে পারেন তিনি। মোহাম্মদ রফি, এসডি বর্মন, আরডি বর্মন, উদিত নারায়ণ- কাউকেই বাদ দিতেন না। মিমিক্রিটাকে অন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। নিজের গাওয়া গানের লাইন আর সুর বদল করে গাইতেন, হয়তো কাল হো না হো গানটা গাইছেন, কিন্ত সুরটা ম্যায় হু না-র! দর্শকের মুগ্ধতা বাড়তো সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। রাত ফুরিয়ে ভোর হয়ে আসতো, শ্রোতাদের পাগলামি কমতো না।

পনেরো বছর আগে সনু নিগম প্লেব্যাকের জন্য যে পারিশ্রমিকটা নিতেন, সেটা অরিজিত সিংরা এখনও পান না। গানের জন্য ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ফিল্মফেয়ার সবই জিতেছেন তিনি, গান গেয়েছেন নানা ভাষায়, অজস্র দেশে কনসার্ট করেছেন।কানাডা-জার্মানীর মতো দেশে প্রথম ভারতীয় শিল্পী হিসেবে সলো কনসার্ট আয়োজিত হয়েছে শুধু তার জন্য। ব্রিটনি স্পিয়ার্সের সঙ্গে এক মঞ্চে গান গেয়েছেন, মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর পরে তাকে যে ট্রিবিউটটা দিয়েছিলেন, সেটা তো ইতিহাসেরই অংশ হয়ে গেছে। এত কিছুর পরেও তারকাখ্যাতি আক্রান্ত করতে পারেনি তাকে, জুনিয়র আর্টিস্টদের কাছে তিনি প্রিয় মুখ, আইডল, ভরসার আরেক নাম।

সনুর সবচেয়ে বড় গুণ যেটা, সেটা হচ্ছে তার ভার্সেটাইলিটি। মেলোডিয়াস রোমান্টিক ট্র‍্যাকে তিনি যেমন স্বচ্ছন্দ, ঠিক তেমনই স্যাড ট্র‍্যাকেও অসাধারণ, আনন্দের গানও তিনি ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে করছেন। শাহরুখ খানের জন্য প্লেব্যাকে এক সনুর দেখা মিলছে, ঋত্বিক বা গোবিন্দ'র জন্য রেকর্ডিং স্টুডিওতে দেখা মিলছে একদম ভিন্ন এক সনু নিগমের। যে লোক জুবি ডুবি জুবি ডুবি গাইছে, তার কণ্ঠেই আভি মুঝমে কাঁহি শুনে সিনেমা হলে কাঁদছে দর্শক, ম্যায় হুঁ না'র স্লো ভার্সনটা শুনে জল জমছে কারো চোখে- নিজের এই ভিন্নমাত্রিক উপস্থাপনটাই সনু নিগমকে অনন্য করে তুলেছিল, অনন্য করে রেখেছে।

উপস্থাপক হিসেবেও তিনি দারুণ, আড্ডা মাতিয়ে রাখতে জানেন, অনুষ্ঠান জমিয়ে তোলেন মুহূর্তেই। রিয়েলিটি শোয়ের বিচারক হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর, সারেগামাপা'র সেই আসরগুলো যারা ফলো করেছেন, তারা জানেন সনু নিগম কি জিনিস! সুর-তাল-লয় নিয়ে তার যে প্রখর জ্ঞান, যে প্রজ্ঞা, সেটা গোটা ভারতবর্ষের ইতিহাসেই খুব বেশি শিল্পীর মধ্যে ছিল না। চার মিনিটে তিনি সাতাশটা গান গেয়ে ফেলেন, প্রতিটাই আবার একটা আরেকটার সাথে সংযুক্ত! পার্টি সংয়ের লিরিক দিয়ে কাওয়ালি বা গজলের সুরে গেয়ে দেখান- সাধে তো আর লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলের মতো কিংবদন্তী শিল্পীরা মুগ্ধ হয়ে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন না!

যা সত্যি তা বলতে কখনও ভয় পাননি সনু

আক্ষেপটা কোথায় জানেন? এই প্রতিভাবান শিল্পীটাকে ভারত, বলিউড ব্যবহার করতে পারলো না পুরোপুরি। এবং সেখানে সনুর বিন্দুমাত্র দোষ বা ভুল নেই। সনু প্রতিবাদী, অনেক আগে থেকেই। অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন, চুপ করে অন্যায় সয়ে নেয়াটা তার ধাতে নেই। যখন থেকে তিনি শিল্পীদের রয়্যালিটি সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো নিয়ে মুখ খোলা শুরু করেছেন, তাকে একঘরে করে রেখেছে বলিউডের প্রভাবশালীরা।

টি সিরিজের গুলশান কুমারের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ছিল বাবা-ছেলের মতো। কিন্ত গুলশানের মৃত্যুর পরে তার ছেলে ভূষণ কুমার টি সিরিজের দায়িত্ব নিলেন, সনুর ঝামেলাটা মূলত তার সঙ্গেই। মুম্বাইয়ের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে একরকমের একনায়কতন্ত্র জারী করে রেখেছেন ভূষণ, তারা যাকে চাইবেন তাকেই কাজ দেবেন, যাকে পছন্দ হবে না, সে প্রতিভাবান হলেও কাজ পাবে না। তারা যেভাবে চুক্তি করবেন, সেই চুক্তিই শিল্পীকে মানতে হবে, এমনকি সেটা তার ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকারক হলেও! সনু নিগম শুরু থেকেই এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, আর তাই মিউজিক মাফিয়ারা লেগেছে তার পেছনে। তার কাছে প্লেব্যাকের প্রস্তাব আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য থোড়াই কেয়ার করেছেন সনু।

ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমীকরণের কারণে পাকিস্তানী শিল্পীদের কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে মুম্বাইতে। আতিফ আসলাম বা রাহাত ফতেহ আলি খানের মতো প্রতিভাবান শিল্পীরা বলিউডি সিনেমায় কাজ করতে পারছেন না। সনু প্রতিবাদ করেছেন এই ঘটনারও। তার কথা হচ্ছে, 'নিজের দেশের একজন ধর্ষককে আমার ভাই ডাকতে হবে, অথচ পাকিস্তানের যে লোকটা আমার দেশের কোন ক্ষতি করেনি, তাকে আমি শত্রু বলব? এটা আমাকে দিয়ে হবে না।' তিনি ঠিকই দেশের বাইরে আতিফকে সঙ্গে নিয়ে কনসার্ট করেছেন, হাতে হাত ধরে সাম্যের গান গেয়েছেন। কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষেপেছে তার ওপর।

তবে লোকজনকে ক্ষ্যাপানোর ব্যাপারে সনু সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করেন না। আজানের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে তিনি কট্টর মুসলমানদের কাছেও চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছেন। এই ইস্যুতে তার নামে মামলা হয়েছে, তাকে বয়কট করার ডাক উঠেছে, এক মাওলানা তো ঘোষণা দিয়েছে, সনু নিগমের মাথাটা কেউ ন্যাড়া করে দিতে পারলে তাকে দশ লাখ রূপি পুরস্কার দেবেন। রসিক সনু নিজেই নাপিত ডেকে এনে চুল কামিয়ে ফেলেছেন, তারপর সেই ছবি আপলোড করে মাওলানাকে বলেছেন, দিন এবার আমাকে দশ লাখ রূপি!

সনুর বয়স এখন সাতচল্লিশ, গত সাত-আট বছর ধরেই গানে তিনি নিয়মিত নন। তার মতো একজন শিল্পী চল্লিশের আগে অনিয়মিত হয়ে গেলেন, ব্যাপারটা মানতেই কষ্ট হয়। সনুর যা প্রতিভা, তার তিন ভাগের একভাগও আবিস্কার করা গেছে কিনা সন্দেহ আছে। পুরোটা যদি ব্যবহার করা যেতো, ভারতীয় গানই অন্যরকম একটা উচ্চতায় চলে যেতো তার হাত ধরে। সনু নিগমকে আমার কাছে মনে হয় ডুবে থাকা আইসবার্গের মতো, যার সফেদ চূড়াটাই শুধু চোখে পড়ে। পানির নিচে ডুবে থাকা বিশালত্বের পরিমাণটা জানা হয় না কখনও, যেমন জানা হয়নি সনু নিগমের প্রতিভার গভীরতাও...

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা