আমেরিকার সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেশে ফিরে গবেষণা করছিলেন ক্ষতিকর প্লাস্টিকের ব্যবহার কিভাবে কমানো যায়, তা নিয়ে। আবিষ্কার করলেন 'সোনালি ব্যাগ।' কিন্তু আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় এ উদ্যোগ দেখলো না আলোর মুখ। সেই সাথে নিঃস্বার্থ এই বিজ্ঞানীও হারিয়ে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে।

এ বছরের মাঝামাঝি এক ভোরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে কয়েক মাইল ব্যাপী দশ-বারো টন বর্জ্য পদার্থের স্তুপ দেখতে পায় স্থানীয়রা। বোঝা যাচ্ছিলো, সমুদ্র থেকেই উঠে এসেছে এই বর্জ্যগুলো। এবং এই বর্জ্যগুলোর অধিকাংশই ছিলো পলিথিন! এই পলিথিনে শরীর আটকে প্রতিবছর কী পরিমাণ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়, তা কল্পনারও বাইরে। এবং শুধু জলজ জগতের কথাই বা বলা কেন, আমাদের চারপাশের প্রায় সবকিছুতেই আমরা পলিথিনের যে আগ্রাসী মনোভাব ও সর্বগ্রাসী চরিত্র দেখতে পাই, তা একই সাথে ভীতিজনক ও শঙ্কার।

পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে এক মিলিয়ন পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার হয়। পলিথিন ব্যাগের সবচেয়ে বড় সমস্যা, এরা কখনোই পুরোপুরি ধ্বংস হয় না৷ এটা পরিবেশ দূষিত করে, সে সাথে জীব-বৈচিত্র‍্য ধ্বংসেরও অন্যতম কুশীলব হিসেবে কাজ করে। নদী ভরাট করা, মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়া, খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশলে বিষক্রিয়া তৈরী করা... নানা গুনে সমৃদ্ধ এই পদার্থটি৷ কিন্তু তাও আমরা এর ব্যবহার কমাতে পারি না, এর সহজলভ্যতা ও বহুল প্রচলনের কারনে।

পলিথিনের আগ্রাসী ব্যবহার কমানোর জন্যে ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহারের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়৷ বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগের একটা প্রচলনও শুরু হয়েছিলো সে সময়ে। কিন্তু পাটের ব্যাগের ব্যবহার খুব একটা জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ হয় নি। মানুষজন আবারও হাত বাড়িয়েছিলো পলিথিনের দিকে। সে সময়ে বাংলাদেশের একজন মানুষ প্লাস্টিকের পলিথিনের ব্যাগের বিকল্প হিসেবে পাটের পলিথিন ব্যাগ 'সোনালি ব্যাগ' এর কথা বলেছিলেন। মানুষটির নাম ডাঃ মোবারক আহমদ খান। যাকে আমরা অনেকেই চিনি না।

মানুষটির পরিচয় অল্প করে বলে ফেলা যাক। ডাঃ মোবারক আহমদ খান বেশ অনেক বছর ধরেই গবেষণা করছেন প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটকে ব্যবহারের সুবিধা- অসুবিধা নিয়ে। কাজ করেছেন আমেরিকা,  জাপানে, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার বড় বড় প্রজেক্টে। এ পর্যন্ত ১৭ টি বই লিখেছেন। তাছাড়াও নিজের পেটেন্ট, ছয় শতাধিক গবেষণা প্রকাশনার সাথেও যুক্ত তিনি!  বাংলাদেশের এই গুণী মানুষটি অনেকদিন থেকেই আছেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, অথচ তাকে এদেশে কয়জন মানুষ চেনে, সেটা বড়সড় এক প্রশ্ন।

পাদপ্রদীপের তল খুঁজে না পাওয়া বিজ্ঞানী ডাঃ মোবারক আহমদ খান

যাক, তাকে না-ই চিনতে পারে মানুষ। সে আলোচনা বাদ দিলাম।  এই মানু্ষটি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন গত চার বছর ধরে, তাঁর আবিষ্কৃত সোনালি ব্যাগের বাজারজাতকরণ নিয়ে। সে নিয়েও আমাদের অনেকেরই কোনো ধারণা নেই। বিজ্ঞানী ডাঃ মোবারক সেলুলোজ ব্যবহার করে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের এই পলিথিন ব্যাগ তৈরী করেছিলেন৷ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন- সরকার পলিথিন নিষিদ্ধ করলে সেটা খুব একটা সুফল বয়ে আনবে না। যদি না, মানুষকে পলিথিনের বিকল্প কিছু একটা দেয়া যায়। এই চিন্তাভাবনা থেকেই তিনি পাটের এই ব্যাগ আবিষ্কার করেন।

এই ব্যাগের সবচেয়ে বড় সুবিধা, এটা বায়ো-ডিগ্রেডেবল। অর্থাৎ মাটিতে রাখলে একসময়ে মাটির সাথে মিশে যায় এটি। এছাড়া এটি খাবারে বিষক্রিয়াও তৈরী করে না। এবং মাটিতে ফেলে রাখলে ছয় মাসের মধ্যে এটি জৈব সারে পরিণত হয়। পানিতে ফেললে এক মাসের মধ্যে মাছের খাদ্যে পরিণত হয় এবং আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এই ব্যাগ উৎপাদন করতে প্লাস্টিকের পলিথিনের ব্যাগের চেয়েও খরচ কম হয়! এটি দেখতেও অনেকটা প্লাস্টিকের পলিথিন ব্যাগের মতন, হালকা।

সোনালি ব্যাগ

এতটুকু পড়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, এত ভালো একটি উদ্যোগ কেন এতদিনেও আলোর মুখ দেখলো না? এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছেও নেই। আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায়, সরকারি বিভিন্ন গলিঘুঁজির গোলকধাঁধায় হারিয়ে গিয়েছে এই অসাধারণ কাজের প্রয়াসটি। তিনি গত চার বছর ধরে তাঁর মত করে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন, যে সংগ্রামের ফলাফল আমরা জানি।

ডাঃ মোবারক আহমদ খান যেখানেই যান, হাতে করে একগাছি পাট নিয়ে যান। তিনি হেসে বলেন, পাট ভালো লাগে আমার। তাই সাথে করে এই 'সোনালি আঁশ'কে সঙ্গী বানিয়ে যান সবখানে। আমেরিকায় গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০০১ সালে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন। উদ্দেশ্য একটাই, যা আবিষ্কার করবেন, দেশের জন্যে করবেন। এরপরের প্রেক্ষাপট হতাশা, অপ্রাপ্তির, অস্বীকৃতির। তিনি রয়ে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। সে সাথে তার উদ্যোগও পেলো না কোনো স্বীকৃতি। এদিকে প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন পলিথিন উৎপাদন হয়ে জনজীবন ক্রমশই নাকাল হতে থাকলো। এই সমস্যার সমাধান হয়তো করা যেতো। সমাধান তো হাতের নাগালেই ছিলো। কিন্তু কিছুই করা হলো না।

অসাধারণ সব উদ্যোগগুলো এভাবেই মুখ থুবড়ে পড়ে বলেই কী মানুষ আজকাল স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়? জানি না। জানে না কেউ। দেশের 'হীরের টুকরো' মানুষগুলো'কে এভাবেই অবহেলা করি বলেই কী তারা একসময়ে মুখ ফিরিয়ে নেন দেশ থেকে? এ প্রশ্নের উত্তরও নেই আমার কাছে।



*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা