সোলায়মানের কালকের খাবারের বাজার না হয় আছে। এরপর?
সোলায়মান মিয়া একজন দিনমজুর। রাজমিস্ত্রির কাজ করে। প্রতিদিন ভোরে কারওয়ান বাজারের সামনে থেকে সরদারদের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে যায়। দিনশেষে কাজের পর টাকা হাতে পেলে বাজার সদায় করে ঘরে ফিরে। সোলায়মান গরিব অশিক্ষিত হলেও মূর্খ না। তাই সে আজ কাজ থেকে ফেরার সময়ে শুনেছে যে কাল থেকে দেশে করোনার জন্য লকডাউন। সরকারের নির্দেশে বাইরে যাওয়া নিষেধ। তাহলে রোগ আরও ছড়াবে। কালকের খাবারের বাজার না হয় আছে। এরপরের দিন থেকে কি হবে তা নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। সরকার যেহেতু মানা করেছে কাজে না যেতে, তাহলে সরকারই কি খাবার দিবে এই কয়দিন?
নাহ, এত মানুষের খাবার কিভাবে দিবে আমাদের সরকার? সরকারেরও তো এত ক্ষমতা নাই যে সোলায়মানের মত সবাইকে খাবার দিবে। তাহলে সমাধান কি? নাকি এমন গরিব হয়ে জন্মানোটাই সোলায়মানের সমস্যা? কোনভাবেই তো হিসাব মেলে না। এতসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে যায় সোলায়মান। পরশু কি হবে তার হিসেব মেলানোর জন্য কালকের দিনটা তো পড়েই আছে।
দি ডেইলি স্টারের মার্চ ২৮, ২০২০ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সোলায়মানের মত বাংলাদেশে এই মুহুর্তে কর্মক্ষম দিনমজুরের সংখ্যা প্রায় ৪৯.৫ মিলিয়ন বা ৪ কোটি ৯৫ লক্ষ। এবার বাকি হিসেবটা করার জন্য আমি অবাস্তবরকম কম কম সংখ্যা বিবেচনা করে হিসাবটা করছি কেবল আপনাদের সহজে বুঝার জন্য।
ধরা যাক, এরা প্রত্যেকে দৈনিক গড়ে ৫০ টাকার খাবার খায়। তাহলে, এদের দৈনিক মোট খাবার খরচ ২৪৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। দেশ ২০ দিন লক ডাউনে থাকলে এই ২০ দিনে এদের মোট খাবার খরচ দাঁড়াবে ৪৯৫০ কোটি টাকা। আমি ধরে নিলেম, এই ২০ দিনের ভেতর ১০ দিন এরা যথারীতি কাজ পাবে এবং এই ১০ দিনের খাবার খরচ উঠে যাবে। বাকি ১০ দিন যদি এরা কাজ না পায়, তাহলে মোট ২৪৭৫ কোটি টাকার যোগান কোত্থেকে আসবে তা আমার কাছে পরিস্কার না। আচ্ছা হিসাব আরও ছোট করে ফেলার জন্য ধরে নিলাম, অর্ধেক দিনমজুর এই লকডাউনের কারণে কোনই ক্ষতির সম্মুখীন হবে না, বিশেষ করে যারা গ্রামে ক্ষেতে কৃষিকাজ করে এমন দিনমজুরেরা ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। তারপরও ২৮৭৫ কোটি টাকার অর্ধেক ১২৩৭ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার হিসাব আমি কোন মতেই মেলাতে পারছি না।
তাহলে কি এরা না খেয়ে মরে যাবে?
আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি না। আমাদের চিন্তা ভাবনা হিসাব নিকাশ যেখানে শেষ হয়ে যায় সেখানেই মহান সৃষ্টিকর্তার খেলা শুরু হয় বলে আমার বিশ্বাস। কোন না কোন উপায় তিনি অবশ্যই বের করে দিবেন। এই আশায় বুক বেঁধে আছি।
এক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে কি আমাদের কিছুই করার নেই?
অবশ্যই আছে। চলুন, আরেকটা অংকের খেলা খেলি। ধরা যাক, ১৬ কোটির বেশি (মতান্তরে ১৮ কিংবা ২০ কোটি) মানুষের এই দেশে বর্তমানে অন্তত ৫ কোটি লোক আছে যারা এককালীন ২০০ টাকা করে ডোনেট করার ক্ষমতা রাখেন। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ডোনেশনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০০০ কোটি টাকা। এ তো গেল গড় হিসাব। অনেকে আছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে এর অনেকগুণ বেশি দান করছেন, করবেন। তাছাড়া সরকারি তহবিল এবং বেসরকারি কর্পোরেশনগুলো সামষ্টিকভাবে এগিয়ে এলে এই ক্ষুধা নামক মহামারিকে পরাজিত করা সম্ভব। বর্তমানে যে এই দান অনুদান চলছে না তা নয়। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ভাবে সমন্বয় না থাকার কারণে একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। আর তা হলো, কেউ কেউ একাধিকবার দানের টাকা বা মালামাল পাচ্ছেন, আবার কেউ একবারও পাচ্ছেন না। এই পুরো বিষয়টাকে সমন্বয় করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করলে এই মানবিক দূর্যোগটা সহজেই বোকাবিলা করা সম্ভব। এর জন্য সরকারি পর্যায়ে একজন শক্ত পরিকল্পনাকারী দরকার। আর দরকার টাকা সংগ্রহ আর বণ্টনে স্বচ্ছতা এবং শৃঙ্খলা।
এ কাজটি সহজ করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সহজ সল্যুশন বের করে দেয়ার জন্য এদেশে প্রচুর মেধাবী ছেলে মেয়েরা তৈরি আছে। যারা কেবল একজন যোগ্য পথপ্রদর্শক এর আশায় পথপানে চেয়ে আছে।
আমি জানি আমার উপরের পুরো বিশ্লেষণটা অনেকের কাছে অলিক অর্থহীন কল্পনা মনে হবে। কারণ, বহু বহু দিন কোন সৎ আর স্বচ্ছ নেতৃত্বের অভাবে বৃহৎ পরিসরে এই সুন্দর কাজগুলো করতে পারার ক্ষমতা যে আমাদের আছে তা আমরা বিশ্বাস করতে ভুলে গেছি।
(ফিচার্ড ইমেজটি প্রতীকী)