সখিনা বেগমের বোনের ছেলে মতিউর রহমান, যে ডাক নাম মতি, বসুর কথায় প্রভাবিত হন। যুদ্ধে যেতে চান। কিন্তু সখিনা বড় স্নেহ করেন মতিকে। তিনি বললেন, মতি না যুদ্ধে আমি যামু।

কিশোরগঞ্জের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা, নাম তাঁর সখিনা। ভাটি অঞ্চলের এই মুক্তিযোদ্ধার এক অনন্য জীবনের গল্প আছে। তিনি বধ করেছিলেন ৫ রাজাকার, রামদা দিয়ে! তাঁর ব্যবহার করা সেই রামদা এখন সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

কিশোরগঞ্জের নিকলী জন্ম এই যোদ্ধানারীর। একাত্তরের পাকিস্তানি ঘাতকদের তান্ডবলীলা চলেছিল কিশোরগঞ্জেও। একাত্তর অদ্ভুত সময়। নামকরা ডাকাতের মনে দেশপ্রেম জেগে ওঠে আবার সমাজে প্রতিষ্ঠিত তথাকথিত ভদ্রস্থ লোক হয়ে রাজাকার। এখানে তখনকার নামকরা বসু ডাকাত গড়ে তোলে বসু বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধে নামতে তিনি উদ্ভুদ্ধ করেন সবাইকে। সখিনা বেগমের বোনের ছেলে মতিউর রহমান, যে ডাক নাম মতি, বসুর কথায় প্রভাবিত হন। যুদ্ধে যেতে চান। কিন্তু সখিনা বড় স্নেহ করেন মতিকে। তিনি বললেন, মতি না যুদ্ধে আমি যামু। সখিনা বেগম সেই স্মৃতি মনে করে আজও আপ্লুত হন।

সখিনা বেগমের মুখ থেকে সেই উত্তাল দিনের গল্প শুনে আসা যাক।

সখিনা বেগম  

"আমি মুক্তিযুদ্ধে গেছিলাম মতির জন্য। মতি আমার বুকের ধন। আমার বইনের ছেলে। মতি, মানে মতিউর তখন ২৫ বছরের যুবক। আমাদের এলাকার কমান্ডার রসু এসে মতিউরকে বলল, ‘পাকিস্তানি বাহিনী আইসে পড়ছে। যুদ্ধে যাইতে হইব।’ এই কথা শুইনা আমার বুকের ভেতরডায় মোচড় দিয়া উঠল।

কন কী! বইনের একমাত্র ছেলে। যুদ্ধ করতে গিয়া যদি মইরা যায়! তখন কী হইব! আমরা বাঁচমু কেমনে! এইডা ভাবতে ভাবতে আমার মনের মইধ্যে কেমন য্যান দিশাহারা দিশাহারা লাগতাছিল। কী করমু ভাইবা পাইতাছি না। কিছু না ভাইবাই আমি কমান্ডাররে গিয়া কইলাম, মতি না, আমি যুদ্ধে যামু। তিনি কইলেন, ‘তুমি মাইয়া মানুষ, যুদ্ধে গিয়া কী করবা!’

আমি কইলাম, আপনারা যা কন তা-ই করমু। নইলে গোয়েন্দাগিরি করমু। কমান্ডার বললেন, ‘তুমি পারবা?’ আমার চোখের মইধ্যে মতির মুকডা ভাইসা উঠল। মতিরে বাঁচাইতে হইব। আমি কইলাম, পারমু না ক্যান! না পারার তো কিছু নাই। এইভাবে জড়াইলাম মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযোদ্ধাদের খবরাখবর আদান-প্রদান করতাম। কখনো পাট ক্ষেতের ভেতর দিয়ে নিকলীর বিলোবিয়া বাজার হয়ে যাইতাম পুবদা। কখনো করগাঁও, গাগলাই, কিশোরগঞ্জের দানা পাটনি, কইরাইল; কখনো সুগার মিল, ছড়ারচর হাইস্কুল। এভাবেই একাত্তরে গোয়েন্দাগিরির কাজ করতাম।

একদিন ছড়ারচর হাইস্কুলের কাছে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে ধরা পড়লাম। জানটা তখন হাতের মধ্যে চইলে আইল! মনে তবু সাহস হারাইনি। ওরা আমাকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল আর বলল, ‘তুম ঠেরউ।’ তখন আমি দাঁড়াইলাম। ওরা বলল, ‘তুম কিদার যাইগা খাটো খাটো বাঙালি?’ তখন আমি বললাম, আমি মুকাম যাই। ওরা বলল, ‘তুম উর্দু জানো?’

আমি বললাম, কুচ কুচ জানি। ওরা বলল, ‘আপ তোমারা বন্ধু হ্যায়’ এসব বলতে বলতে ওরা আমাকে স্কুলের কাছে নিয়ে গেল এবং বলল, ‘কী খাবে?’ আমি বললাম, গেলাসি খাব। ওরা বলল, ‘গেলাসি কাহা মিলেগা?’ আমি চুপ করে রইলাম। মাথাডা আউলা হইয়া গেছিলগা। তারপর…

আমাকে ওরা মাংস আর রুটি খেতে দিল। তখন ওরা ওদের ভাষায় কী কী বলছিল, সব বুঝতে পারিনি। খাওয়ার পর কী করে পালাব, চিন্তা করতে লাগলাম। মাথায় একটা বুদ্ধি এল। বললাম, পেট ব্যথা করছে। ওরা বলল, যাও। বাথরুম ছিল দূরে। আমি সুযোগ বুঝে জান নিয়ে পালিয়ে এলাম।"

একাত্তরের ১৯ অক্টোবর সখিনা বেগমের বোনের ছেলে মতি শহীদ হলেন যুদ্ধে। ততদিনে সখিনা বেগম যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন কিছু বসু বাহিনীর হাতে। মতির মৃত্যুর খবর তিনি সইতে পারলেন না। অক্টোবরের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্থানিদের উপর আক্রমণ চালায়। সেই যুদ্ধে রাজাকারও মরে। আর রাজাকার মারার ক্ষেত্রে সখিনা বেগম ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি, একাই তার রামদা দিয়ে ৫ রাজাকার বধ করেন। সেই রামদা এখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত।

প্রবীন এই যোদ্ধার চোখের ভাষা কি পড়তে পারছেন?

দেশ স্বাধীন হয়, বিজয় আসে। কিন্তু, সখিনা বেগমের জীবন বদলায় নি খুব একটা। ১৯৯৮ সালে একবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সখিনা বেগমকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। কিন্তু অসুস্থ সখিনা বেগমের চিকিৎসা ব্যয়ে সেই অর্থ খরচ হয়ে যায়। মানুষটা ভীষণ নিঃসঙ্গ। তিনি বলেন,

"আমার স্বামী-সংসার নাই। আমার স্বামীর ‘অভ্যাস’ ভালো ছিল না। তাই আমি তাকে নিজ থেকে তালাক দিছি। পরে আমি আর বিয়েথা করিনি। ঘৃণা ধরে গেছে পুরুষ মানুষের ওপর। তার কথা বলতে মন চাইছে না। আমার জীবনের কথা বলি। আমি বেঁচে আছি কোনোমতে। এইটা জীবন না।"

মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেতেন, কিন্তু এবছর কিশোরগঞ্জে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেন বন্ধ করা হয়েছিল, তার কোনো সদুত্তর দেয় নি কেউ। একাত্তরের সৈনিক সখিনা বেগম তার অবস্থা তুলে ধরে বলেন,

"প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টার্মে ক্ষমতায় আসার পর মাসে এক হাজার ৫০০ টাকা করে পেইছি। বিএনপি আইসা ৩০০ টাকা করে দিছে। প্রশিকা থাইক্কা এক হাজার টাকা করে পাইছি কিছুদিন। এসব দিয়ে কী আর জীবন চলে! কোনো রকমে চলছে। না চললে কী করমু? আমার বয়স হইয়া গেছে। মাঝে মাঝে অসুস্থ হইয়া পড়ি। আমার দেখাশোনার জন্য একটা বুয়া রাখছি। তাকে টাকা দিতে হয়। ১৫ দিনে সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এ জন্য সরকারের কাছে সম্মানীর টাকা আরেকটু বেশি করে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটা খড়ের ঘর তুলে দিছে। এর আগে হাসিনা সরকার জমির জন্য অর্ডার দিছিল। এরপর খালেদা সরকার এসে নিকলীতে একখণ্ড জমি দিছিল। কিন্তু সেটা অন্য লোকে গণ্ডগোল করে কেড়ে নিছে। আমি গরিব মানুষ। বয়সও হইছে। এই বয়সে আমি কী আর করতে পারি!"

এই হলো অবস্থা, প্রকৃত বীরদের সম্মান কিভাবে দিতে হয় তা এই দেশের লোক না জানলেও, মুক্তিযুদ্ধকে বেঁচে কিভাবে ফাঁপা চেতনার বুলি ঝাড়া যায় তা শিখে নিয়েছে অনেকেই...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা