সমাজের এক পার্সেন্ট জীবাণুর সাথে লড়াই করতে পারাটাই চ্যালেঞ্জ।

ডেটল সাবানের অ্যাড ক্যাম্পেইন এর কনসেপ্ট ছিল- ৯৯ পারসেন্ট জীবাণু মেরে ফেলে। অ্যাড দেখে বাঙালী ভাবল, 'কী ভাল প্রোডাক্ট! ৯৯টা জীবাণু মেরে ফেলে, মাত্র একটা জীবাণু মারতে পারে না, ওটা কোনো ব্যাপারই  না'৷

কিন্তু ফাঁকিটা আসলে ওখানেই, আপনি অসুস্থ  হলে দায়টা তখন ডেটল সাবানের না, ওরা তো বলেই দিয়েছে যে, একটা জীবাণু মারতে পারে না, আর সেই জীবাণুটার  দ্বারাই আপনি আক্রান্ত হয়েছেন। সুতরাং তাদের কোনো দায় নেই।

আজকের প্রসঙ্গ ডেটল না, আজকের প্রসঙ্গ এক পারসেন্ট জীবাণু। সেই ৯৯ পারসেন্ট জীবাণু মারার পরেও সমস্যা আসলে ঐ এক পারসেন্ট, যার দ্বারা আপনি-আমি আক্রান্ত, অথচ দোষ দেবার উপায় নেই। কারণ সমাজ ঐ এক পারসেন্ট জীবাণু থাকার বৈধতা দিয়ে দিয়েছে।

কঠিন মনে হচ্ছে? আচ্ছা সহজ করে বলছি.. খুব কমন কিছু প্রচলিত সামাজিক অভ্যাস হলো-

- সমাজের মুখ তো তুমি বন্ধ করতে পারবা না। মানে হলো আসলে সমাজ তো কথা বলবেই, বিষয়টাকে বৈধতা দেয়া। 

- মিডিয়াতে কাজ করলে মা* বে* এসব  শুনতেই হবে, মানে হলো মিডিয়ার মেয়েদের গালি দেয়াই যায়। 

- পুরুষ মানুষের রাগ থাকবেই কিংবা মেয়ে মানুষের এত জেদ ভাল না। 

- মেনে নিয়েই সংসার করতে হয়, ইত্যাদি ।

তাই যখনই কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তখন দোষ হয় ঐ এক পারসেন্ট জীবাণুর। কিন্তু সমস্যাটা যে সমাজ তৈরি করে রেখেছে, সেটা বলার উপায় থাকে না।

থাপ্পড় সিনেমাটা দেখেছেন? কী মনে হয়েছে? শুধুই একটি থাপ্পড়, কিন্তু মারতে পারে না। মাত্র এক পারসেন্ট জীবাণু, কিন্তু সেটাও থাকতে পারে না।

আমি এক অতি সাধারণ মেয়েকে চিনি,  যে দেনমোহর নিয়েছে ১ টাকা, তার কথা ছিল- স্বামী আমাকে পয়সা দিয়ে কিনবে কেন? বরং ভালবেসে জয় করবে।

অনেক বড় কোনো কথা না, খুব ছোট বিষয়,  কিন্তু সেই এক পারসেন্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে  লড়াই এটা।

লক্ষ্মী আগরওয়াল তার এসিড ঝলসানো মুখ নিয়ে, তাঁর মেধা, তাঁর কাজ দিয়ে সমাজের মুখ বন্ধ করে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরার সামনে নেচে গেয়ে অভিনয়ও করছে। সে এটা ধরে বসে থাকে নি যে,  ‘সমাজের মুখ তো বন্ধ করতে পারবা না’।

লক্ষ্মী আগারওয়াল-দীপিকা পাড়ুকোন

বাংলা সিনেমার প্রথম নায়িকা  ছিলেন লোলিটা বা বুড়ি নামের এক বারবনিতা,  কারণ সেই সময় তথাকথিত ভাল মেয়েরা সিনেমায় অভিনয় করত না! কিন্তু ঐ মেয়েটি সাহস করেছিল বলে অন্য মেয়েরা নিয়ম ভেঙে অভিনয়ে আসতে শুরু করে।

এরই ধারাবাহিকতায়,  আজকের  তিশা, মিথিলা, অপি করিম, জয়া, হালের বুবলি থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষিত নারীরা অভিনয় করছে। কারণ ‘মিডিয়াতে কাজ করলে বেশ্যা শুনতে হবে’ টাইপ সমাজ আরোপিত তত্ত্ব তারা মেনে নেয়নি। সেই এক পারসেন্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই এটা।

প্রভার মতো মেয়েরা, প্রাক্তন প্রেমিকের প্রতারণার স্বীকার হয়ে ভেঙে না পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলেই,  অসংখ্য মেয়ে তাদের প্রেমিকের প্রতারণা থেকে বের হয়ে বাঁচতে শিখছে।

সুবর্ণা তাঁর চেয়ে ১৬ বছরের ছোট এক পুরুষকে স্বামী হিসেবে গ্রহন করেছেন, ৫৬ বছর বয়সে গুলতেকিন খান দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এবং  তার সন্তানরাই মায়ের এই বিয়েতে আনন্দের সাথে সম্মতি দিয়েছে।

এসবই হয়ত আপাত দৃষ্টিতে খুব ছোট ঘটনা, কিন্তু সমাজকে জীবাণুমুক্ত করতে এসব উদ্যোগই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

‘মেনে নিয়ে সংসার করতে হবে’  এই ধারণার বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ না। কিন্তু এটা না করলে আপনি ঐ এক পারসেন্ট জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরের কথা মনে আছে, যিনি স্বামীর নির্যাতনের স্বীকার হয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন? উনি ঐ এক পারসেন্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে জিততে পারেননি, যেমন পারে না  অনেকেই। কারো  কারো ভাগ্য ভাল থাকে বলে, খুন না হয়ে,  আধ মরা হয়ে বেঁচে থাকেন।

প্রশ্ন হলো- কেন মানতে হবে? প্রথম যেদিন অপমানিত হয়েছেন, সেদিন কেন তাকে ছেড়ে চলে আসবেন না- এই প্রশ্ন করা জরুরী।

একটা গালি শুধু একটা গালি না, একবার এবিউস হওয়া শুধু একবার না, একটা  থাপ্পড় শুধু একটা থাপড় না, একটা অনিয়ম শুধুই একটা অনিয়ম না, এটা ঐ এক পারসেন্ট ভয়ংকর জীবাণু। যার বিরুদ্ধেই লড়াইটা করতে হয়, করতেই হবে।


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা