নারীরা জোট গড়েছে, লড়েছে, তারপর নিজের অধিকার আদায় করেছে। যুগ যুগ ধরে তাই করে আসছে। আমাদেরও প্রতিবাদ করতে হবে। হাত গুটিয়ে, মুখে তালা দিয়ে বসে থাকলে হাতের মুঠোয় এসে কিছু দিয়ে যাবে না।

সায়মা তাবাসসুমঃ এত সহজ ছিল না নারীদের এতদূর আসা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই আজ দাঁড়িয়েছে এই জায়গায়। প্রতিবাদ, মিছিল, সংগ্রাম একের পর এক চলেছে দিনের পর দিন, তারপরই না এসেছে আমাদের অধিকার! তবুও এখনো পদে পদে কত কিছু সহ্য করতে হয়, কত কিছু থেকে বঞ্চিত আমরা! আসবে না, এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে কিচ্ছু আসবে না। কোনো দিন আসেওনি। আমাদেরও প্রতিবাদ করতে হবে, চাইতে হবে- তবেই পাবো কিছু। পৃথিবীতে নারীদের ছয়টি কালজয়ী সংগ্রামের কথা আজ লেখা হলো মনে করিয়ে দিতে, আমরা যেন আমাদের অধিকারের লড়াই থেকে পিছিয়ে না যাই!

ভার্সাইয়ের মিছিল ও প্রতিবাদ সভা: ৫ অক্টোবর ১৭৮৯

১৭৮৯ সালের ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলেশনের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে তখন চাপা উত্তেজনা বিরাজমান। সেই গ্রীষ্মে, কারাকক্ষে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সেবার ফলন কম হওয়ায় খাদ্যাভাব দেখা দেয়, যার ফলে খাবারের মূল্য প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ৫ অক্টোবরে প্রতিবাদ জানাতে প্যারিসের অধিবাসী নারীরা ভার্সাইতে জমায়েত হয়, যেখানে রাজা চৌদ্দতম লুই’র কোর্ট বসতো। নারীদের এই আন্দোলনে পুরুষরাও যোগদান করে, যেখানে আন্দোলনকারীর সংখ্যা হাজারের ঘরে ছিল বলে শোনা যায়। এরা রাজার রয়েল এপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন এবং তাঁদের দাবী তুলে ধরেন। প্রতিবাদের মুখে রাজা রাজ পরিবারকে প্যারিসে, জনগনের সন্নিকটে সরিয়ে নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। তিনি আর ভার্সাইতে ফিরে আসেননি।

ওয়াশিংটন ডিসিতে মহিলাদের ভোটাধিকার প্যারেড: ৩ মার্চ ১৯১৩

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও নারী অধিকার আদায়ের জন্য নারীদের সংগ্রাম করতে হয়েছে। কোন কিছুই নারীরা সহজে পাননি। তেমনি ভোটাধিকারও! ১৯১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মহিলাদের ভোটাধিকার আন্দোলন একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছিল। নিউইয়র্কের সেনেকা ফলসে কয়েক দশক আগে ১৮৪৮ সালে নারী অধিকার সম্মেলন সংগঠিত হয়েছিল যেখানে নারীদের অনুভূতি, অধিকারের কথা তুলে ধরা হয়। তারপরেই মুলত নারীদের ভোটাধিকার নিয়ে বেশ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলনটি পরিকল্পনা অনুযায়ী ওয়াশিংটন ডিসিতে সর্বোচ্চ মনোযোগ পাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের অভিষেক হওয়ার আগের দিন কংগ্রেস লাইব্রেরীতে হয়েছিল।

সংবিধানের একটি সংশোধনী চেয়ে সেদিন হাজার হাজার মানুষ প্যারেডে অংশগ্রহন করেছিল। সেই আন্দোলনে প্রায় ১০০ জন সাধারণ মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। মহিলাদের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য বছরের পর বছর ধরে মিছিল এই আন্দোলনের অংশ ছিল এবং ১৯১৫ সালে নিউইয়র্কের একটি বেশ বড়সড় আন্দোলনের মাধ্যমে সেটি আরও একধাপ এগিয়ে যায়। অবশেষে ১৯২০ সালে সংবিধানের ১৯তম সংশোধনী অনুযায়ী ভোট দেওয়ার অধিকার পায় নারীরা।

প্রিটোরিয়ায় নারীদের মিছিল: ৯ আগস্ট ১৯৫৬

১৯৫৬ সালের ৯ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটেরিয়ায় ২০ হাজার নারী জমায়েত হন একটি আইন পাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে, যে আইনের উদ্দেশ্য ছিল কালো লোকদের (black people) প্রতিবাদের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এই আইনের বিরুদ্ধে পিটিশন করেন, যদিও প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহণ করার জন্যে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁরা সেখানে ৩০ মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তারপর একটি গান গেয়ে প্রতিবাদ জানান। “তোমরা নারীকে আঘাত করেছ, তোমরা পাথরকে আঘাত করেছ”।

এই আন্দোলন আরও অনেকদিন পর্যন্ত চলে। চার বছর পর ১৯৬০ সালের এক প্রতিবাদে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালায়। শেষ পর্যন্ত প্রবল দাবীর মুখে ১৯৮৬ এই আইন সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়। এই দিনটি এখন সেখানে জাতীয় নারী দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় এবং আগস্ট মাস women’s month হিসেবে পরিচিত। গত বছরের অক্টোবরে এই আন্দোলনের ৬০তম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়।

৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস

আইসল্যান্ডিক নারীদের ধর্মঘট: ২৪ অক্টোবর ১৯৭৫

‘In 1975, women were underpaid and underrepresented in government.’ Photograph: Loftur Ásgeirsson/Reykjavik City Museum[/caption] নারীরা বঞ্চিত ছিল সেই আইসল্যান্ডেও। তারপর তারা সংগ্রাম করেছে, নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য লড়েছে, এখনো লড়েই চলেছে। সেই আইসল্যান্ড আজ ২০১৬-তে World Economic Forum’s gender gap index এ শীর্ষ স্থান অধিকার করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে নারীরা ভীষণ কম মজুরি পেতো এবং সরকার তাদের দাবিয়ে রাখতো। ধীরে ধীরে তারা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। সমাজে যে তাদের তাদের গুরুত্ব প্রকট, তা তারা বোঝানোর জন্য ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিবিসি অনুযায়ী. ওই বছরের ২৪ অক্টোবর, ২৫০০০  নারী রিকজাভিকের রাস্তায় মিছিল করে এবং মহিলা জনসংখ্যার ৯০% কোনো কাজে অংশগ্রহন করেনি, এমনকি নিজের ঘরের কাজ যেমন- রান্নাবান্না, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, শিশুদের দেখভাল কিছুই করেনি! ২০০৯ সালে ভিগদিস ফিনবগাদত্তির জাতির প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর পচাত্তরের সেই আন্দোলনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং বলেন, তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সেখান থেকেই।

পোল্যান্ডে গর্ভপাত নিষেধাজ্ঞা বিক্ষোভ: অক্টোবর ২০১৬

২০১৬ এর অক্টোবর, পোল্যান্ডে রাজনীতিবিদরা গর্ভপাতের উপর সীমাবদ্ধতা স্থাপন করার লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের কাজ শুরু করেন। যেকোন অবস্থায় গর্ভপাত নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এই আইন অমান্য করলে ৫ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা হবে, এমন প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এমনকি বলা হয়, গর্ভপাতের সাথে জড়িতদেরকেও কঠিন শাস্তি পেতে হবে। গর্ভপাত বিরোধী জোট, রক্ষণশীল আইন ও জাস্টিস পার্টি; যারা মূলত আইনসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এই আইনকে যাচাই-বাছাই করার জন্য ২৩ সেপ্টেম্বরে তাদেরকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রাথমিক বয়কটটি আইসল্যান্ডে ১৯৭৫-এর আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

হাজার হাজার নারী, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ কালো পোশাকে তাদের কর্মস্থল এবং ক্লাস বয়কট করেন, ৩ অক্টোবরে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ ওয়ারস ক্যাসল স্কয়ারে জমায়েত হয়েছিলেন। প্রবল চাপের মুখে আইনসভায় এই আইন পুর্নরূপে বাতিল ঘোষিত হয়।

সহিংসতার বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার নারীদের প্রতিবাদ: অক্টোবর ২০১৬

২০১৫ সালের জুন মাসে আর্জেন্টিনায় নারীরা রাস্তায় নেমে আসে ১৪ বছর বয়সী শিয়ারা পায়েজকে হত্যার প্রতিবাদে, যিনি কয়েক সপ্তাহের গর্ভবতী ছিলেন এবং তার প্রেমিক তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল! বিক্ষোভকারীরা হ্যাশট্যাগ দিয়ে বলেছিলেন #NiUnaMenos যার অর্থ "আর একটিও না", আর একজন নারীকেও লিঙ্গ সহিংসতার বলি হতে দেয়া হবে না। Hinde Pomeraniec নামে একজন সাংবাদিক যিনি বুয়েন্স আয়ার্সে মিছিল সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিলেন।

পরের অক্টোবর ১৬ বছরের লুসিয়া পেরেজ অপহৃত, ধর্ষিত ও অত্যাচারিত হয়। প্রসিকিউটর এই আক্রমণকে "অমানবিক যৌন নিপীড়নতুল্য" বলে বর্ণনা করেন। ১৯ অক্টোবর, যা কালো বুধবার নামে পরিচিত, হাজার হাজার মানুষ বুয়েন্স আয়ার্সে জমায়েত হয়, সমবেত হয় দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন শহরেও। সবাই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পেরেজের মৃত্যু এবং সেই সাথে এইরকম বিভিন্ন নারীঘটিত দুর্ঘটনার প্রতিবাদে।

নারীরা জোট গড়েছে, লড়েছে, তারপর নিজের অধিকার আদায় করেছে। যুগ যুগ ধরে তাই করে আসছে। আমাদেরও প্রতিবাদ করতে হবে। হাত গুটিয়ে, মুখে তালা দিয়ে বসে থাকলে হাতের মুঠোয় এসে কিছু দিয়ে যাবে না। যা আমাদের লাগবে, যা আমাদের অধিকার কিন্তু আমরা তা থেকে বঞ্চিত সে সব কিছুর জন্য লড়তে হবে, তাদের বোঝাতে হবে আমরা দুর্বল নই। প্রতিটা সময় আমাদের মনে রাখতে হবে, "লড়তে হবে, তবেই জয়ী হবো আমরা"। 

 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা