পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই, অথচ সিরাজ নিজে কেঁদেছেন, সিরাজ কাঁদিয়েছেন কোটি মানুষকে, সিরাজ লিখেছেন আবেগী এক গল্প, সেই গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে জীবন সংগ্রাম আর সাফল্যের ব্যাপ্তি...

প্র‍্যাকটিস সেশনের মাঝখানেই বিরাট কোহলি এবং রবি শাস্ত্রী যখন একসঙ্গে এগিয়ে এসেছিলেন তার দিকে, তখনই মোহাম্মদ সিরাজ ধারণা করতে পেরেছিলেন, যে সংবাদটা তিনি শুনতে চাইছিলেন না মনেপ্রাণে, সেটা চলে এসেছে। তবু সিরাজ শুনলেন, কান খাড়া করেই শুনলেন। কোহলিই বললেন তাকে, 'সিরাজ, তোমার বাবা আর নেই।' সিরাজ রুমে ফিরে গিয়েছিলেন সেটা শুনে, যাওয়ার আগে তার কাঁধে হাত রেখেছিলেন কোহলি, শাস্ত্রী বলেছিলেন- আমরা সবাই তোমার সঙ্গে আছি সিরাজ! 

অনেক বছর আগে, ঘোর লাগা এক সন্ধ্যেবেলায় কোহলিও এরকম একটা খবর পেয়েছিলেন, স্কুল ক্রিকেট খেলতে তিনি তখন দিল্লির বাইরে। কোচ রুমে এসে জানালেন সংবাদটা, ব্যাগ গুছিয়ে নিতে বললেন, দলের এক্সট্রা একজন তাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে। কোহলি ফিরে যাননি সেই রাতে। তার দল তখন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে, ব্যাট হাতে দাঁতে দাঁত চেপে বাইশ গজে দাঁড়িয়ে থেকে পরদিন দলকে হারের মুখ থেকে বাঁচিয়েছিলেন কোহলি। সেই ঘটনারও কয়েক বছর আগে বাবাকে হারানোর পর কেনিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরী করে শচীন টেন্ডুলকার জন্ম দিয়েছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তগুলোর একটির। ভারতীয় ক্রিকেটে তাই বাবার মৃত্যুটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে থেকেছে বরাবরই। 

সিরাজ আজকে যা কিছু, সবটাই বাবার জন্য। অটো চালিয়ে অল্প কিছু টাকাই আয় করতেন, তাতে সংসারটা চলতো হামাগুড়ি দিয়ে। এরকম পরিবারের বড় ছেলেটা যদি ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখে, বাবা-মায়ের জন্য সেটা উপদ্রব ছাড়া আর কিছুই নয়। সিরাজকেও তাই বাবা-মা দুজনেই নিরাশ করার চেষ্টা করেছেন অনেক, বিশেষ করে মা। মারধর থেকে কিরা-কসম কাটানো, বাদ পড়েনি কিছুই। পরে একসময় খেলাটার প্রতি ছেলের ভালোবাসার মাত্রা বুঝতে পেরে আর বাধা দেননি বাবা মোহাম্মদ গাউস। আগে যেখানে বারো ঘন্টা অটো চালাতেন, সেখানে বাড়তি আরও দুটো ঘন্টা যোগ করে নিলেন, তাতে যদি দিনে দুশো টাকা কামানো যায়, ছেলেটাকে একজোড়া ভালো বুট কিনে দেয়া যাবে- এই আশায়। ভোরবেলায় একসঙ্গে বের হতেন বাপ-বেটা, ছেলেকে পাশে বসিয়ে মাঠে নিয়ে যেতেন গাউস। 

বাবা মোহাম্মদ গাউসের সঙ্গে সিরাজ

সেই লোকটা মারা গেলেন গত নভেম্বরে, সিরাজ তখন দলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া সফরে, কোয়ারেন্টাইন নীতি মেনে চলছেন। দেশে ফির‍তে হলে গোটা সিরিজটাই মিস যাবে। বাবা চেয়েছিলেন, ক্যারিয়ারে অন্তত একটা টেস্ট যাতে সিরাজ খেলেন, সাদা টেস্ট জার্সি পরে লাল কোকাবুরা বল হাতে ছেলে বোলিং এন্ড থেকে ছুটে আসছে আগুয়ান গতিতে-  সেটা দেখার স্বপ্ন ছিল গাউসের। পূরণ হয়নি সেই স্বপ্নটা। সিরাজ তাই থাকবেন বলে মনস্থির করলেন, যদি অস্ট্রেলিয়াতেই অভিষেকটা হয়ে যায়! হায়দরাবার থেকে ফোন করে তাকে সাহস দিলেন মা, যে ভদ্রমহিলা ছেলের মাথা থেকে ক্রিকেটের ভূত নামানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন, তিনিই ছেলেকে বললেন, আসার দরকার নেই, থেকে যাও! 

মেলবোর্নে অভিষেক হলো সিরাজের, তার ঠিক আগেই ছত্রিশের লজ্জায় ডুবেছে ভারত। নিয়মিত অধিনায়ক কোহলি নেই, ইশান্ত শর্মা, ভুবনেশ্বর কুমাররা ছিলেন না আগে থেকেই। ইনজুরি ছিটকে দিয়েছে মোহাম্মদ শামিকেও, এমন দুর্বল পেস আক্রমণ ভারতীয় দল সবশেষ কবে দেখেছে, সেটা নিয়েই গবেষণা হচ্ছিল। সেই দলটার কাছে নিজেদের মাঠে অস্ট্রেলিয়া পাত্তাই পেলো না, ব্যাটে বলে সমান দাপট দেখালো আনকোরা টিম ইন্ডিয়া, অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে সিরাজ নিলেন পাঁচ উইকেট। 

মেলবোর্নে ডেব্যু টেস্টের উত্তেজনা হয়তো অবশ করে দিয়েছিল সিরাজের স্নায়ুকে, মেলবোর্নে নিজের দ্বিতীয় টেস্টটা যখন খেলতে নামলেন, তখন আবেগাক্রান্ত না হয়ে পারলেন না এই তরুণ। ম্যাচ শুরুর আগে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বেজে ওঠামাত্রই খানিকটা নিয়ন্ত্রণ হারালেন, চোখের কোণে জমলো অশ্রু। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বুমরাহ কাঁধে হাত রাখলেন সিরাজের, শাস্ত্রীর কথাটাই যেন প্রমাণ করে দিলেন, সবাই তার সাথে আছেন। সিরাজের সেই কান্না ভাইরাল হলো অনলাইনে, বছরে তিনশো পঁয়ষট্টি দিন যে উগ্রপন্থী লোকটা সব মুসলমানদের ভারত থেকে পাকিস্তান নয়তো বাংলাদেশে পাঠাতে চায়, সেও স্বীকার করে নিলো, নাহে, এই ছোকরার মধ্যে দেশপ্রেম আছে! 

ওই কয়েকটা সেকেন্ড সময়ের মধ্যে মোহাম্মদ সিরাজ হয়তো তার গোটা ক্যারিয়ারটা একবার দেখে ফেলেছিলেন, কিংবা পুরো জীবনটাই! হায়দরাবাদের এক ঘিঞ্জি কানাগলি থেকে উঠে আসা ছেলেটা, ক্রিকেটে যে ঘর-সংসার পেতেছিল, রঞ্জিতে খেলাটাই যার কাছে স্বপ্নের মতো ব্যাপার ছিল, ক্রিকেট খেলে পাঁচশো রূপি পারিশ্রমিক পাওয়া ছেলেটাকে যখন আইপিএলে আড়াই কোটি রূপিতে কিনে নেয়া হয়েছিল, তখনকার আনন্দ থেকে মেলবোর্ন টেস্টে অভিষেকের উত্তেজনা- সবকিছুই সিনেমার মতো ভেসে উঠেছিল তার চোখের তারায়। 

জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় সিরাজের চোখে জল

মেলবোর্নে অভিষেক টেস্টে বর্ণবাদের মতো ঘৃণ্য অপরাধের শিকার হতে হয়েছে, সিডনিতেও বজায় ছিল সেই ধারাবাহিকতা। আম্পায়ার বাধ্য হয়ে সিকিউরিটি ডেকে দায়ী দর্শকদের বের করে দিয়েছেন মাঠ থেকে। সিরাজকে পিষে ফেলার সব চেষ্টাই করেছে অস্ট্রেলিয়ানরা, বাইশ গজে ব্যাটসম্যানরা করেছে, গ্যালারি থেকে করেছে অসভ্য দর্শকেরা। সিরাজ ভেঙে যেতে পারতেন, নুয়ে পড়তে পারতেন, খেই হারানোটা মুহূর্তের ব্যাপার ছিল। কিন্ত ঘায়েল হননি তিনি, বরং উমেশ যাদবও যখন চোটে পড়ে বিদায় নিয়েছেন, তখন বুমরাহ'র সঙ্গে মিলে ভারতের পেস ব্যাটারিকে টিকিয়ে রেখেছেন সিরাজই! মেরুদণ্ড সোজা রেখেছেন, লড়েছেন চোখে চোখ রেখে, ছুঁড়েছেন আগুনের গোলা, একটার পর একটা। 

আজ সিরাজ ইতিহাস লিখে ফেললেন। গ্যাবায় দ্বিতীয় ইনিংসে নিলেন পাঁচ উইকেট, যে কীর্তি এর আগে কেবল চার ভারতীয় বোলারের ছিল। অস্ট্রেলুয়ার হাতে থাকা ম্যাচটায় দারুণ প্রাণের সঞ্চার করেছেন তিনি, আদর্শ টেস্ট বোলারের মতো লাইন-লেন্থ বজায় রেখে একটানা বোলিং করে গেছেন, ফলও পেয়েছেন হাতেনাতে। ল্যাবুশেন-স্মিথ- দুজনই তার শিকার। তার কারণেই ব্রীসবেন টেস্টে শেষ দিনের নাটকটা জমে উঠেছে, সিরিজ ড্রয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে রেখেছে ভারতীয় দল; শেষদিনে রোমাঞ্চের পসরা বসানোর সব আয়োজন করে দিয়েছেন হায়দরাবাদের সেই অটোচালকের সন্তানই। 

জীবন সিরাজকে বারবার কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছে, দারিদ্র‍্য, পরিবারের নিষেধাজ্ঞা, ওয়ানডে কিংবা টি-২০ অভিষেকে বাজে পারফরম্যান্স, বাবার মৃত্যু, বর্ণবাদের শিকার হওয়া- সিরাজ প্রতিবার রুখে দাঁড়িয়েছেন, ফিরে এসেছেন প্রবল প্রতাপে। পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই, অথচ সিরাজ নিজে কেঁদেছেন, সিরাজ কাঁদিয়েছেন কোটি মানুষকে, সিরাজ লিখেছেন আবেগী এক গল্প, সেই গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে সংগ্রাম আর সাফল্যের ব্যাপ্তি। সিরাজ যেন নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার মতোই চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহাপ্রলয়ের নটরাজ; সিরাজ মানে সাইক্লোন, সিরাজ মানেই ধ্বংস! সেকথা অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতে ভালো এখন আর কে জানে! 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা