বাচ্চাদের জন্য আর কোনো পরীক্ষা নেই। মাধ্যমিক পর্যন্ত পাস-ফেল, প্রথম-দ্বিতীয় নির্ধারণেরও বালাই নেই। সিঙ্গাপুরে এখন থেকে শিক্ষা কোনো প্রতিযোগিতা নয়, কেবলই জ্ঞানার্জনই মূল উদ্দেশ্য!

শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য কী, এ প্রসঙ্গে যুগ যুগ ধরে বিতর্ক চলে এসেছে। কারও কাছে শিক্ষা মানে পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলের মাধ্যমে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা। আবার কারও কাছে শিক্ষা মানে জ্ঞানার্জন, নিজেকে ভবিষ্যৎ জীবনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে তোলা। আর তাই কারও কারও কাছে শিক্ষা হয়ে ওঠে গলার কাঁটার মতই অসহ্য ও অস্বস্তিকর। আবার কারও কাছে এই শিক্ষাই হয় বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। 

আমাদের দেশে শিক্ষাকে ঠিক কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়, সে-ব্যাপারে কমবেশি অবগত রয়েছেন সকলেই। এখানে শিক্ষা মানে আমি নতুন কী শিখলাম, কী জানলাম তা নয়। বরং শিক্ষা মানে হলো আমি কোন গ্রেড পেলাম, কার থেকে এগিয়ে বা পিছিয়ে থাকলাম। তাই তো কোনোরকমে টেনেটুনে মুখস্তবিদ্যা ঝেড়ে দিয়ে, অন্য কারওটা টুকে দিয়ে, কিংবা পরীক্ষার আগের রাতের প্রশ্ন ও সমাধান পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দিয়ে 'আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ' হওয়াতেই আমাদের যাবতীয় পার্থিব সুখ নিহিত। 

কিন্তু বিশ্বের মানচিত্রে এমন অনেক দেশ আছে যাদের কাছে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একেবারে ভিন্ন। তাদের সাথে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো তুলনাই হয় না। এমন দেশগুলোর তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হলো সিঙ্গাপুর। সে-দেশের সরকার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর তা হলো যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নিমিত্তে গড়ে তোলা 'র‍্যাংকিং সিস্টেম' এর বিলুপ্তি ঘটানো।

অর্থাৎ শিক্ষা যে একটি প্রতিযোগিতা বিশেষ, এ ধরণের ভ্রান্ত বিশ্বাসের গায়ে কুঠারাঘাত করে, মানুষের ধারণাকে খোলনলচে পাল্টে দেয়াই সিঙ্গাপুর সরকারের মূল উদ্দেশ্য। তার ফলে এখন থেকে কোনো শিক্ষার্থী তার নিজের ক্লাসে কততম অবস্থান অর্জন করল, সেটিও আর প্রকাশ করা হবে না। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় সিঙ্গাপুরের শিক্ষামন্ত্রী অং ইয়ে কুং বলেছিলেন, তিনি আশা করেন শিক্ষার্থীরা এবার বুঝতে পারবে যে 'জ্ঞানার্জন কোনো প্রতিযোগিতা নয়'।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীদের রিপোর্ট কার্ডে যে তথ্যগুলো থাকে না: - শ্রেণী বা ধাপ - সর্বোচ্চ ও ন্যূনতম নম্বর - ফেল করা নম্বরের নিচে দাগ বা রং দিয়ে নির্দেশ - বর্ষসমাপ্তির ফলাফলে পাস বা ফেল - কোনো বিষয়ে প্রাপ্ত গ্রেড - সামগ্রিক মোট নম্বর - L1R5 (ইংরেজি ও পাঁচটি প্রাসঙ্গিক বিষয়), L1R4 , EMB3 (ইংরেজি, গণিত, সেরা তিনটি বিষয়), এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের নিম্নতর ধাপসমূহের জন্য EMB1। এই পরিবর্তন প্রসঙ্গে সিঙ্গাপুরের শিক্ষা মন্ত্রণালয়য়ের বক্তব্য হলো: "এই পরিবর্তন আনা হয়েছে যাতে প্রতিটি শিক্ষার্থী তাদের জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ায় পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারে, এবং অন্যদের সাথে তুলনা নিয়ে তাকে যেন খুব বেশি চিন্তিত থাকতে না হয়।" 

এছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লাস ১ ও ২ এর শিক্ষার্থীদেরকে এই বছর থেকে কোনো পরীক্ষায়ই অংশ নিতে হচ্ছে না। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন বিষয়ে অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ অব্যহত রাখবেন, যেমন শ্রেণীকক্ষে আলোচনা, বাড়ির কাজ ও কুইজ। শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্কুলগুলো মার্ক ও গ্রেডের জায়গায় অন্য কোনো ব্যবস্থা নেবে, যেমন সেটি হতে পারে 'কোয়ালিটেটিভ ডেসক্রিপ্টর', এবং এর মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি মূল্যায়িত হবে।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, "আমি জানি ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া, ঐতিহ্যগতভাবেই শিক্ষার্থীদের অর্জনের একটি বড় স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তারপরও এগুলোকে তুলে ফেলা হচ্ছে একটি ভালো কারণে, যাতে করে বাচ্চারা খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারে যে জ্ঞানার্জন কোনো প্রতিযোগিতা নয়, বরং জীবনে আত্ম-শৃঙ্খলা অর্জনের একটি প্রক্রিয়া। তারপরও, শিক্ষার্থীদের রিপোর্ট বুকগুলোতে এখনও এমন কিছু তথ্য থাকবে যার মাধ্যমে পড়াশোনায় তাদের তুলনামূলক পারফরম্যান্স এবং শক্তি ও দুর্বলতার জায়গাগুলো মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়।" 

আর এভাবেই সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সে-দেশের সরকার। নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইতিমধ্যেই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়া দেশটির পরবর্তী প্রজন্ম তাদের বর্তমান প্রজন্মকেও গুণে-মানে বহুগুণে ছাড়িয়ে যাবে। আর তাই নিজ অঙ্গনে সিঙ্গাপুরকে শীর্ষস্থান থেকে টলাতে পারবে না কেউই। 

শুধু একটিবার কল্পনা করে দেখুন তো, আমাদের দেশেও যদি এমন একজন শিক্ষামন্ত্রীর আবির্ভাব ঘটতো, যার যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে পাল্টে যেত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা! ছয়-সাত বছরের বাচ্চারা নিজের ওজনের চেয়েও ভারি ব্যাগ ঘাড়ে বহন করতে গিয়ে মেরুদন্ড বাঁকিয়ে ফেলত না, কিংবা বাবা-মায়েরা কথায় কথায় বাচ্চাদেরকে 'অমুক তোমার চেয়ে বেশি পায় কীভাবে? ও ভাত খায়, আমরা কি তোমাকে ভাত খাওয়াই না?'- জাতীয় কথা বলত না! 

জানি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এগুলো আকাশ-কুসুম কল্পনা। তবু কোনো একদিন আমাদের দেশেও শিক্ষা বিষয়ক যাবতীয় ভয় দূর হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে শিক্ষা কোনো বিভীষিকা নয় বরং বিবেচিত হবে পরম আনন্দের বিষয় হিসেবে - এমন আশাবাদ তো ব্যক্ত করতেই পারি। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা