আপনি করোনা নিয়ে কেন আতংকিত বলেন তো? আপনিও তো দায়ী আজকের এই অবস্থার জন্য। আপনার-আমার; সকলের সমস্ত জমিয়ে রাখা নীরব পাপকেই দেখিয়ে দিতে এসেছে করোনা। আপনার সুবিধাবাদী আচরণ, নীরবতা, সেইফ থাকার বাসনার মূল্য দিতে হবে এখন।

ধরুন আপনি ডাক্তার মানুষ। কষ্ট করে পড়ালেখা করেছেন, পাশ করার পর টেবিলে মাথা গুঁজে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিয়েছেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লাল-হলুদ দাগ দিয়ে মাখামাখি করেছেন, কঠিন পোস্ট গ্রাজুয়েশন পার করে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত চাকরি।

চাকরি জীবনে আপনি চেম্বার করেছেন, সেবার বিনিময়ে নিয়েছেন টাকা। ফাইন এনাফ। সবই তো ঠিক আছে। তাহলে ডাক্তার হয়েও করোনায় আপনি বেঘোরে মরছেন কেন? কেন নিজের বাবা-মায়ের জন্য একটা আইসিইউ বেড চেয়ে হাহাকার করছেন?

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি    

কারণ, আপনি কেবল চাকরিই করেছেন; আপনি কেবল ডাক্তারিই করেছেন। রোগ ও রোগীর বাইরে আপনি কোনো কিছুই নিয়ে ভাবেননি। আপনি কথা বলেননি। আপনি সেফ থাকতে চেয়েছেন।

আপনি চাকুরে। অফিসে যাওয়া আসা করেছেন। সার্ভিসের বিনিময়ে পেয়েছেন টাকা। আপনার স্ত্রী-সন্তান বা স্বামীর অসুখে আপনি ডাক্তারের কাছে ছুটে গেছেন, বরাবরই টাকার বিনিময়ে সেবা পেতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। ভেবেছেন এভাবেই চলছে, এভাবেই চলবে।

তাহলে এখন চলছে না কেন? কেন ডাক্তার মিলছে না টাকা থাকার পরেও? কেন সামান্য জ্বরে ভুগেই নাভিশ্বাস ওঠে যাচ্ছে? ডাক্তারদের পিণ্ডি চটকে গালি দিচ্ছেন চেম্বার না করার জন্য...লাভ কি হচ্ছে? বিনা চিকিৎসায় মরছেন কেন?

কারণ আপনিও কথা বলেননি। নিজের অবস্থানকে ভীষণ সেইফ ভেবেছিলেন। নিজের জীবন ও স্বার্থের বাইরে কোনো কিছু নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেননি, বোঝার চেষ্টা করেননি। স্ট্যাবল ও নিরাপদ অবস্থানকে কথা বলে প্রতিবাদ করে নড়েবড়ে করতে চাননি একদিনও।

আপনি বুদ্ধিজীবী, আপনি শিক্ষক, আপনি লেখক কিংবা আপনি সমাজের সম্মানিত কেউ একজন। কই আগে তো এমন ঝামেলায় পড়েননি। প্রতিথযশা মানুষ হিসেবে আলাদা সম্মান ছিল সবখানে। শিক্ষক হলে কোনো হাসপাতালে গিয়ে পেয়েছেন ছাত্র, লেখক হলে ভক্ত, বুদ্ধিজীবী হলে গুণগ্রাহী। বিনা সিরিয়ালে ভক্তি সহকারে আপনাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে সব সময়। ভেবেছিলেন দেশের আর মানুষের যা খুশি হোক, আমার জীবন তো সেইফ। আমার চিকিৎসা পাওয়া কে বন্ধ করে?

আপনার নিরব থাকার চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে এখন

আপনি এখন সেইফ না কেন? কেন কোথাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না? কেন এম্বুলেন্সে করে এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে ওখানে ঘুরতে হচ্ছে? কেন কোনো ভক্ত, ছাত্র বা গুণগ্রাহী কোনো কাজে আসছে না?

কারণ আপনি কথা বলেননি, আপনি কথা বলাননি। দেশের চরমতম অবক্ষয়ের সময়েও চুপ ছিলেন। ফুল পাখি নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন, লাইলি মজনু নিয়ে রচনা করেছেন প্রেমের উপন্যাস। আপনি ছাত্রদেরকে গ্রিক মিথোলজি পড়িয়েছেন, পানিপথের যুদ্ধের গল্প শুনিয়েছেন...কিন্তু ছাত্রকে মূল্যবোধ শিক্ষা দেননি। সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছেন; কেন ও কীভাবে প্রতিবাদ করতে হয় এটা শেখাতে। ক্ষুদ্র হতে বৃহৎ সকল অন্যায়কে দেখেও না দেখার ভান করেছেন।

রাজনীতিবীদ বা সচিব শ্রেণীর মানুষদের কথা বাদ দিলাম। উনারা ঈশ্বরপল্লীর মানুষ। উনাদের বলা সাজে না। এই যে সকল শ্রেণী, সকল পেশার, সকল বয়সের মানুষ চুপ ছিলেন...এই চুপ থাকার ফলাফল আজকের ভোগান্তি। সেই নীরবতা আর সেইফ থাকাটাই আজকের দিনের মৃত্যু।

আপনি জানতেন না ৫০০০ টাকায় বালিশ কেন হচ্ছে? আপনি জানতেন না ১৭ লাখে কেনা হচ্ছে জানালার পর্দা, ৫ লাখে আসছে গাছের চারা। জানতেন, খুব জানতেন। ভেবেছেন তাতে আমার কী? আমার ঘরে চাল আছে, ব্যাংকে মাল আছে, ধরার মতো হাল আছে হাতে। আছে সম্মান-প্রতিপত্তি। বালিশের ৫০০০ টাকা তো আর আমার ঘর থেকে নেয়া হচ্ছে না।

আপনি জানতেন এয়ারপোর্টে সীমাহীন দুর্নীতি হয়, জানতেন ঘুষ দিলে পাওয়া যায় দুনিয়ার সকল সুবিধা। চামে ঘুষ দিয়েছেন, মেনে নিয়েছেন দুর্নীতি। আপনার টাকা আছে। ভাবেনও এসব কেন চলবে একটা দেশে? কখনো বলেননি। একটা লাইন লিখেননি কোথাও।

জানতেন প্রশাসনে যারা বসে আছে তারা কিছুই জানে না। গো মূর্খ ছাগল কেবল তেল দিয়ে দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছে বড় বড় পদ। বলা দূরে থাক, এসব নিয়ে এক বেলা মনটাও পর্যন্ত খারাপ হয়নি আপনার।

আজকের ডাক্তার, ফ্রন্টলাইন সোলজার...মারা যাচ্ছেন অকাতরে। বর্তমান ও সাবেক দুই স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে কখনো বলেছেন কিছু? মন্ত্রীকে দেখা মাত্র হইহই করে সেলফি অন করে দুইজনের বগলের চিপায় ঢুকে একটুখানি খোমা বের করে মন্ত্রীর সাথে একটা সেলফি তোলার চেষ্টা করেননি?
একবারও কি মনে পড়েনি লোকটা দুর্নীতিবাজ, নীরব প্রতিবাদ হিসেবে হলেও একটু দূরে থাকি?

কেউ কেউ সিস্টেমের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেছে, মার খেয়েছে, মরেছে কেউ কেউ। আপনি তাদের মতো কথা বলা দূরে থাক, মনটাও পর্যন্ত খারাপ করেননি। প্রতিবাদ করার অপরাধে আপনার বন্ধুকে যখন অন্যায়ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে, আপনি তখন চাকরির জন্য টেবিলে বসে সিনা টান টান করে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনী পড়ছেন, কলম দিয়ে দাগাদাগি করছেন আর আপনার বোকাসোকা বন্ধুটার বেআক্কেলির কথা ভেবে ফিক করে হাসছেন আপনমনে।

ধরেই নিয়েছিলেন দেশ লুটবে এক শ্রেণীর মানুষ, প্রতিবাদ করে মরবে খুবই ক্ষুদ্র আরেক শ্রেণী...প্রতিবাদ করা এদেরই দায়িত্ব। আপনি এসবে নাই। আপনার ভালো চাকরি দরকার, চাকরিতে প্রমোশন দরকার। আপনার দরকার নিরাপদ খ্যাতি। আপনার শরীরে কেন ফুলের টোকা পড়বে?

হ্যাঁ, সকলের সমস্ত জমিয়ে রাখা নীরব পাপকে দেখিয়ে দিতে এসেছে করোনা। করোনা দেখিয়ে দিয়েছে দুর্নীতির কারণে শীর্ষ পদে বসা লোকগুলোর মাথায় এই বিপদের স্বরূপ বোঝার মতো জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান থাকলেও মায়া ছিল না। এজন্য এয়ারপোর্টে থার্মাল মেশিন বসেনি। বর্ডার সিল হয়নি। আপনার জন্যই টাকার বিনিময়ে চেকিং ফাঁকি দেয়া গেছে। নীরবতার প্রতিমা হয়ে থাকা দুর্নীতির কারণে কোয়ারেন্টাইন ভেঙেছে প্রবাসীরা। কোনো জবাবদিহি নেই বলে কোথাও বাধায় পড়তে হয়নি তাদের।

সতের লাখ টাকার পর্দা আর ৫ হাজার টাকার বালিশ উত্তোলন দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র। দেখা গেল প্রতি সাত লাখ মানুষের বিপরীতে আছে মাত্র একটা মাত্র সরকারি আইসিইউ সিট। সেই সিটের অধিকাংশই আবার অকেজো। এই তো ঢাকা শহরের সাড়ে তিনশ সিটের মধ্যে নাকি কার্যকর আছে মাত্র ৬৭ টা।

এই খবর আগে কেউ জানতেন না? জানতেন, ভেবেছেন আমার তাতে কী? আমি তো সুবিধা সব সময় পাই। এবারও পাব।

কিন্তু পাচ্ছেন না। পাবেনও না। আগে মেডিকেল স্টুডেন্ট পরিচয় দিয়ে যে কোনো হাসপাতাল থেকে সর্বোচ্চ সেবা পাওয়া যেত। এখন এসিস্ট্যান্ট প্রফেসরদের অনুরোধেও একটা সাধারণ সিট পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সিলেটের মেডিসিনের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর সেই দুই মাস আগে এম্বুলেন্স পাননি। মাত্র ৫ দিন আগে মারা গেলেন পিজির ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি সিএমএইচ এ সিট পাননি।

এতদিন এত অন্যায় দেখে দেখে চুপ করে থাকা আপনি, এখনো চুপ করে থাকা ভদ্রলোক...বিপদ কিন্তু চলে এসেছে। বুঝতে পারছেন নাকি পারছেন না, রোজ কেয়ামত চলছে। আপনার সুবিধাবাদী আচরণ, নীরবতা, সেফ থাকার বাসনার মূল্য দিতে হবে এখন।

হ্যাঁ জানি, এখনো বেশিরভাগ মানুষই আসল অবস্থা বুঝতে পারছেন না। সেইফ মুডে আছেন। এখনো ভাবছেন আমার কী? এক লাখ মানুষই না হয় মরল, আমার পরিবারের কেউ কি মরবে নাকি? 

এত মানুষ মরে যাচ্ছে, তাও আপনাদের হুশ হচ্ছে না

হয়তো মরবে না, কিন্তু আপনি ভুগবেন। এখন দেশ অসুস্থ। অসুস্থ অবস্থায় মানুষ ঘোরের মধ্যে থাকে। প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারে না। বুঝতে পারে যখন অসুখ কেটে যায়। দেশ থেকে যখন করোনা চলে যাবে, তখন বুঝবেন কী ক্ষতিটা হয়ে গেল।

উন্নত বিশ্বের দুরাবস্থার উদাহরণ দিতে যাবেন না। তারা ফার্স্ট সেকেন্ড ওয়েভে পড়েছিল। প্রস্তুতির সময়ও পায়নি কেউ কেউ। কয়েকটা দেশ গোয়ার্তুমি করেছে সত্য, তেমনি অনেক দেশ শুরুতেই সফল হয়ে গেছে। 

আমরা তো সফলদের অনুসরণ কর‍তে পারতাম। তাছাড়া আমরা ফিফথ ওয়েভের শিকার হয়েছি। এর মধ্যে চারটা ওয়েভ গেছে দুনিয়া জুড়ে। প্রচুর সময় ছিল হাতে, প্রস্তুতি নেবার জন্য আমাদের চেয়ে ভালো সুযোগ অন্য কেউ পায়নি। কিন্তু আমাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না।

একটু কথা বলতেন, একটু আওয়াজটা ভারি করতে পারতেন। অতীতে না হয় কথা না বললেন, এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বলা জরুরি ছিল।

করোনা পরিস্থিতির জন্য সর্বাধিক দায়ী দুইটা পক্ষ। সরকার যারা আদতে কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। কিছু কিছু ওয়াজি চিয়ারলিডার যারা অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত এবং স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাঝে বিপুল প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ভুল ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছিল।

এই দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম পক্ষ নিয়ে কিছু বললে জেলে যাবার ভয় থাকে, ভয় থাকে চাকরি হারাবার। ২য় পক্ষ নিয়ে লিখলে ব্যাপক গালি খেতে হয় অনলাইনে। দুইটাই খারাপ, তাই কথা বললনে না মশাই।

নীরবতার মানে এখনো বোধহয় বুঝতে পারছেন না। মেক্সিকো ও ব্রাজিল থার্ড বা ফোর্থ ওয়েভে পড়েছিল, এখন বেসামাল অবস্থা। আমাদের ভোগান্তির দিন এখনো বাকি আছে। শীতকালের আগে করোনা বিদায় না হলে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে পারে। আমাদের পিক কবে আসবে কেউ জানে না।

করোনা আপনাকে আর কথা বলার সুযোগ দেবে কিনা কে জানে! তবে আবার যদি সুযোগ পান, প্লিজ কথা বলিয়েন। কথা বলা মানেই আক্রমণ না, বিদ্রোহ-বিপ্লব না। খোদা আপনাকে বিচার বিবেচনার এবং ভাবার যে ক্ষমতা দিয়েছে সেটার ঋণ অন্তত শোধ করুন।

নোবেল করোনা ভাইরাসের হিসেব শেষ হয়ে যায়নি। তারচেয়েও বড় কথা এবারের নোবেল করোনা ভাইরাসেই হিসেব শেষ না। মহামারী আরো আসবে, কোনো না কোনো অনুজীব হঠাৎ করে বিদ্রোহী হয়ে কেড়ে নেবে মিলিয়ন জীবন। 

সেই প্রস্তুতির জন্য প্রতিবাদ শুরু করা লাগবে। প্রতিবাদ মানে সরকার পতন না, হাসপাতাল বানানোর আবেদন না...প্রতিবাদ শুরু হতে পারে প্রতিবাদী কোনো লেখায় একটা লাভ ইমো কিংবা শেয়ারের মাধ্যমেও।

প্রতিবাদের প্রথম স্তর মন খারাপ এবং অনুধাবন। সেটা অন্তত করুন। প্লিজ...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা