এদেশে সংসদে দাঁড়িয়ে একজন নির্বাচিত সাংসদ ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করেন, শিক্ষিত লোকজনও ধর্ষণের ঘটনায় পোশাকের দোষ খোঁজেন। অথচ অশিক্ষিত এক রিক্সাচালক হয়েও শুক্কুর মামা বিশ্বাস করেন, ধর্ষণের জন্য পোশাক কোনোভাবেই দায়ী নয়...

ইউটিউবে একটা ভিডিও দেখছিলাম কয়েকদিন আগে, হোস্ট যে ছেলেটা, সে নানা শ্রেণী, পেশা আর বয়সের পুরুষদের জিজ্ঞেস করছিল, এই যে দেশে এত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, এসবের কারন কি বলে আপনারা মনে করেন? গোটা ভিডিওতে দশজনের মধ্যে নয়জনই ধর্ষণের একমাত্র বা অন্যতম কারন হিসেবে নারীর পোশাক, মেয়েদের চলাফেরাকে দায়ী করেছে, একজন তো নারী স্বাধীনতার কথাও বলেছে। মেয়েরা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার কারনে, রাতবিরাতে ঘরের বাইরে বের হবার কারনেই নাকি ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটছে। পুরো ভিডিওতে একজন তরুণকে শুধু পরিস্কার ভাষায় বলতে শুনলাম যে, ধর্ষণের জন্য পোশাক কোনোভাবেই দায়ী নয়, দায়ী ধর্ষকের বিকৃত চিন্তাভাবনা। 

ভিডিওটা দেখে অবাক হইনি। এটাই বাংলাদেশের আসল চেহারা। এদেশের শতকরা আশি থেকে নব্বইটা পুরুষ ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য মেয়েদেরই দায়ী করে, কেউ সরাসরি দোষ চাপায়, কেউ ইনিয়ে বিনিয়ে বলে যে ধর্ষকের দোষ আছে, কিন্ত মেয়েটাও দায় এড়াতে পারে না... ইত্যাদি। ফেসবুকে বিভিন্ন মিডিয়া হাউজে প্রকাশিত ধর্ষণের খবরগুলোর কমেন্টবক্সে গেলেই এসব অমানুষদের দেখা পাওয়া যাবে, যারা বীরদর্পে ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে বরং ভিক্টিমকেই আক্রমণ করে।

আপনি যদি ভেবে থাকেন যে এই লোকগুলো সবাই অশিক্ষিত, অল্প টাকায় মোবাইল ডাটা কিনে যা তা লিখে বেড়াচ্ছে, তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে আছে। এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি বুয়েটের ছাত্ররাও আছে, যারা মনে করে ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাকও একটা কারন! কখনও সময় থাকলে এরকম লোকজনের আইডিগুলো থেকে একটু ঘুরে আসবেন, দেখবেন পেশায় স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারী চাকরিজীবী, ব্যাংকার, নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা লোকজনও এই পোশাকতত্ত্বে বিশ্বাসী! শুধু ফেসবুক কেন, আপনার আশেপাশে কোথাও ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা হলে সেখানেও দেখবেন বড় একটা অংশ জঘন্য এই অপরাধের দায় নারীর ওপর চাপানোর চেষ্টা করছে। এরাই আসলে বাংলাদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা এদের মনের ভেতরের কাদা আর নোংরা ময়লাগুলো দূর করতে পারেনি। 

কিন্ত ব্যতিক্রমও আছে। যে ব্যতিক্রমগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখার সাহস যোগায়, আশায় বুক বাঁধতে সাহায্য করে। সেরকম ব্যতিক্রম একটা মানুষের গল্প শোনাবো আপনাদের আজ। মানুষটার নাম শুক্কুর, সবাই ডাকে শুক্কুর মামা নামে। পেশায় তিনি রিক্সা চালান। ঢাকা শহরের আর দশজন রিক্সাচালকের চাইতে তিনি আলাদা। অন্যদের রিক্সার পেছনে বাংলা সিনেমার পোস্টার বা নায়ক-নায়িকার ছবি আঁকা থাকে। শুক্কুর মামার রিক্সার পেছনে আঁকা দুজন নারীর ছবি। একজন পর্দানশীল, হিজাব পরিহিতা, অন্যজন সাধারন পোশাকে। দুজনের মাঝখানে পরিস্কার বাংলায় লেখা- "আমার পোশাক নয়, তোমার মানসিকতাই ধর্ষণের কারন।"

পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ নামের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই আর্টটা এঁকে দিয়েছে শুক্কুর মামার রিক্সার পেছনে। নানা রকমের সহযোগীতামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালান। তারই অংশ হিসেবে রিক্সাচালকদের অনুমতি নিয়ে তাদের রিক্সার পেছনে ধর্ষণবিরোধী এসব ছবি এঁকে দেন, লিখে দেন কথাগুলো। শুক্কুর মামা এই তরুণদের দেখে নিজেই আগ্রহ করে রিক্সার পেছনে আঁকিয়ে নিয়েছেন, তারপর সেই রিক্সা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে। 

শুক্কুর মামা ও তার রিক্সা

লোকজন রিক্সার পেছনে এমন জিনিস দেখে অবাক। আরও অনেক রিক্সাচালক আছেন, যারা পড়তে পারেন না। ত্রা জিজ্ঞেস করেছেন, কি লেখা আছে এখানে। শুক্কুর মামা গর্বে বুক ফুলিয়ে উচ্চারণ করেছেন লাইনটা। শুনে অনেকের আঁতে ঘা লেগেছে, অনাদিকাল থেকে পুষে রাখা পৌরুষ্যে আঘাত লেগেছে, তারা শুক্কুর মামাকে আজেবাজে কথা বলেছেন, তাতে তিনি পাত্তা দেননি। শুক্কুর মামার ভাষায়-

"এই লেখাডা রিক্সায় লাগানোর পর কিছু মানুষ আমারে গালি দিসে। কইসে, সব নাকি মাইয়াগো দোষ, ওগো কাপড়ের দোষ। আমি খালি একদিন একজনরে কইসি, তাইলে ভাই ছোড ছোড বাচ্চাগো ধর্ষণ করে কেন? ওগোরও কি কাপড়ের দোষ? শুইনা সে ক্ষেইপা গেলো, গালিগালাজ করলো। আমার তাতে সমস্যা নাই ভাই- হক কথা কমু না কেন? অনেকে আবার ভালো ভালো কথাও কইসে। জিগাইছসে কোইথেইকা লাগাইসি এই জিনিস। ছবিও তুলসে। আমার কিন্তু তখন ভালোই লাগসে।"

শুক্কুর মামা লেখাপড়া জানেন না। স্কুলে যাওয়ার কপাল তার হয়নি, সংসারের জোয়াল কাঁধে নিতে হয়েছে। এই মানুষটা আমাদের সমাজের ভাষায় 'ভদ্রলোক' নন, 'সংস্কৃতিমনা' নন। কিন্ত তার মতো প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষ তো এই দেশে হাতেগোনা! একজন রিক্সাচালক হয়েও যিনি বিশ্বাস করেন যে ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাকের কোন দায় নেই, যে মানুষটা যুক্তি দিয়ে বলেন যে- পোশাকই যদি ধর্ষণের কারন হতো, তাহলে ছোট বাচ্চারা, মাদ্রাসার ছাত্ররা ধর্ষণের শিকার হতো না। ভাবতে ইচ্ছে করে, শুক্কুর মামারাই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, এদেশের শহর-বন্দর, গ্রামে-গঞ্জে কোটি কোটি শুক্কুর মামারা ছড়িয়ে আছেন। তারপর বাস্তবতা মনে পড়ে যায়, শুক্কুর মামাকে তখন এলিয়েন বলে মনে হয়, স্রোতের বিপরীতে থাকা অল্প কিছু মানুষের মধ্যে একজন তিনি। 

এই বাংলাদেশের সংসদে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে একজন নির্বাচিত সাংসদ ধর্ষণের কারন হিসেবে মেয়েদের পোশাককে দায়ী করেছেন, নির্লজ্জের মতো তিনি দায়ী করেছেন নারীবাদকে, নারীর স্বাধীনতাকে। এই দেশে পিএইচডি ডিগ্রিধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাকের দোষ খুঁজে পান, বাকিদের কথা বাদই দিলাম। সেই দেশে শুক্কুর মামার মতো মানুষ তো ব্যতিক্রমই। তবু শুক্কুর মামা আমাদের সাহস যোগান। নিজের জায়গা থেকে যে প্রতিবাদটা তিনি করছেন, সেটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। 

ধন্যবাদ জানাই পাশে আছি ইনিশিয়েটিভকেও। তাদের হাত ধরে এদেশের আনাচেকানাচে এই বার্তাটা ছড়িয়ে পড়ুক যে- ধর্ষণের জন্য ধর্ষক দায়ী, তার বিকৃত মানসিকতা দায়ী, ক্ষমতা প্রদর্শনের আদিম স্বভাব দায়ী, বিচার বিভাগের ধীরগতি দায়ী, আইনশৃঙ্খলার অবনতি দায়ী, নারীর পোশাক ধর্ষণের জন্য কোনোভাবেই দায়ী নয়...

ছবি কৃতজ্ঞতা- পাশে আছি ইনিশিয়েটিভ

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা