'শুভ মঙ্গল জ্যাদা সাবধান' ও আমাদের অদ্ভুত হিপোক্রেসি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সিনেমায় দেখানো সমকামিতা হারাম, তা বাপু তোমার জন্যে সিনেমা দেখাটা আরাম করেছে কে? ইসলামের কোথায় বলা আছে যে বিনোদনের জন্যে তুমি নাটক-সিনেমা দেখতে পারবে?
আয়ুশমান খুরানার ‘শুভমঙ্গল জ্যাদা সাবধান’ দেখলাম, মুগ্ধও হলাম। কন্টেন্ট বাছাইয়ে তো প্রশংসা পাবেই এই ছবি, কমার্শিয়াল সিনেমার বিচারে নির্মাণ, অভিনয়, সংলাপ- সবটাই মন কেড়ে নেয়ার মতো। যে বার্তাটা দিতে চেয়েছে, সেখানে কোন কার্পণ্য করেনি সিনেমাটা, আপোষের পথে হাঁটেনি মোটেও। লাউড এন্ড ক্লিয়ার মেসেজ- সমকামীতা কোন অপরাধ নয়, শারীরিক বা মানসিক কোন অসুখও নয়। সমকামিতা ভালোবাসারই একটা ধরণ, অন্যরকম একটা প্রকারভেদ।
সমকামিতা নিয়ে বলিউডে কাজ হয়েছে খুব কম, ঠাট্টা-তামাশা হয়েছে বেশি। মাঝেমধ্যে আলিগড় টাইপের সিনেমা এসেছে, কিন্ত তাতেও সমলিঙ্গের সম্পর্ককে জোরগলায় ‘ভুল কিছু নয়’ বলার সাহসটা ছিল না পুরোপুরি। কমার্শিয়াল সিনেমায় তো সমকামী মানেই হাস্যকর একটা চরিত্র- এরকমই ধারণা ছিল কিছুকাল আগে। তবে বদলে যাওয়া বলিউড মেইনস্ট্রিম সিনেমায় প্রেমের গল্প শোনাতে গিয়ে এখন নারী-পুরুষ বাদ দিয়ে একই লিঙ্গের মানুষকে বেছে নিচ্ছে- এরচেয়ে বড় বিপ্লব আর কী হতে পারে?
যাকগে, সিনেমা ভাল লেগেছে, তবে সেটা নিয়ে প্যাঁচাল পাড়তে আসিনি আজ। সিনেমার গল্প অন্যদিন হবে, আজ বরং মনের আগল খুলে দুটো কথা বলি। আয়ুশমান খুরানার এই সিনেমাটার ঘোষণা যবে থেকে এসেছে, তখন থেকেই বাংলাদেশের ফেসবুক কেন্দ্রিক সিনেমা গ্রুপগুলোতে একশ্রেণীর লোকজনের ফতোয়া জারীর মচ্ছব দেখছিলাম। সিনেমা মুক্তির আগেই তারা শুভ মঙ্গলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিচ্ছিল, আয়ুশমানের ক্যারিয়ারের এপিটাফ লিখে ফেলছিল।
সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, প্রথম দিনে ভালো ব্যবসাও করেছে বক্স অফিসে। তবে এই লুজারদের চিৎকার-চেঁচামেচি থামেনি, বরং খানিকটা বেড়েছে মনে হচ্ছে। কেউ শুভ মঙ্গল দেখে দুটো কথা গ্রুপে লিখতে পারছে না, এরা হাজির হয়ে যাচ্ছে ধর্মের বয়ান শোনাতে। ইসলামে সমলিঙ্গের প্রেম নিষিদ্ধ, এগুলো ফেতনা, হোমোসেক্সুয়ালিটি মানেই কঠিণ অপরাধ- একটার পর একটা মন্তব্য আসতেই থাকে।
বাঙালি মুসলমানের নানাবিধ কর্মকাণ্ড আমার কাছে প্রায়শই ভীষণ বিনোদনমুলক মনে হয়। এরা নিজেরাও জানে না, সবকিছুর সাথে ধর্ম মেশাতে গিয়ে কখন যে আলাপটাকে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত করে ফেলে। সিনেমায় দেখানো সমকামিতা হারাম, তা বাপু তোমার জন্যে সিনেমা দেখাটা আরাম করেছে কে? ইসলামের কোথায় বলা আছে যে বিনোদনের জন্যে তুমি নাটক-সিনেমা দেখতে পারবে? যেখানে তোমার জন্যে পুরো প্যাকেজটাই হারাম, সেখানে তুমি কন্টেন্ট নিয়ে ফতোয়া জারী করো কোন মুখে?
আয়ুশমান খুরানা সিনেমায় তার সঙ্গী জিতেন্দ্র কুমারকে চুমু খেয়েছেন, বাঙালি ফতোয়াবাজদের দৃষ্টিতে সেটা ভীষণ নিন্দনীয় কাজ। তাহলে আয়ুশমান যখন অনস্ক্রিনে ভূমি পেদেনকর বা ইয়ামি গৌতমকে চুমু খায়, তখন সেটা হালাল হয় কী করে? কোন ধর্ম কি বিয়ে ছাড়া দুজন নর-নারীকে দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্যে প্রকাশ্যে চুমু খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে?
এই হিপোক্রেসিটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। শুভ মঙ্গলের কন্টেন্ট হারাম, আর নোরা ফতেহির বেলি ড্যান্স খুব আরাম? আয়ুশমান-জিতেন্দ্র’র চুমু দেখে লজ্জায় ঘেন্নায় মাথা কাঁটা যাওয়া লোকগুলোকেই তো ‘আশিক বানায়া আপনে’র সেই বিখ্যাত চুম্বনদৃশ্য গোগ্রাসে গিলতে দেখেছিলাম, সেটা তবে হালাল হয়েছিল কী করে? সেই ফতোয়া কে জারী করেছিল? কোন এন্টার্কটিক মাওলানা?
আত্মীয় বা বন্ধুর গায়ে হলুদের রাতে হিন্দি গানের সাথে কোমর দুলিয়ে ইচ্ছেমতো নাচবেন, আইটেম নাম্বার ইউটিউবে রিলিজ পেলে সেটা দেখার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন, আবার গলার রগ ফুলিয়ে বলবেন সমকামিতা নিয়ে সিনেমা হারাম- এটা কেমন হিপোক্রেসি? ধর্ম মানতে চাইলে নাটক-সিনেমা-মিউজিক ভিডিও-আইটেম সং সব কিছুই হারাম, সেটা সানি লিওন হলেও হারাম, বাইসেক্সুয়াল রিলেশনের ওপর বানানো সিনেমা হলেও হারাম। আপনার যেটা ভালো লাগবে সেটা লুকিয়ে দেখবেন, আর যেটা ভালো লাগবে না সেটাকে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করবেন- এটা গর্ধভের মতো আচরণ, ধর্মের নাম ভাঙিয়ে ব্যবসা করার শামিল।
অনেক কথা বলে ফেললাম। বলা দরকার ছিল আসলে এগুলো। সমকামিতা ব্যাপারটাকে ট্যাবু বানিয়ে রেখেছি আমরা এখনও, আমাদের অনেকের চোখে এটা খুন বা ধর্ষনের চেয়েও বড় অপরাধ বোধহয়। এই ধারণাটা ভাঙা খুব প্রয়োজন। গায়ে চর্বি বেশি জমে গেলে শুভ মঙ্গলের বিরুদ্ধে কমেন্টবক্স গরম না করে ধর্ষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন, দেশে হাজারটা সমস্যা আছে সেগুলোর প্রতিকার চান। ফালতু টপিকে সময় নষ্ট করে অযথাই নিজেকে গরু-গাধার পর্যায়ে নামিয়ে আনার কোন দরকার দেখি না।