এয়ারফোর্সের বিমানে চড়ে ঝটিকা সফরে ঢাকায় এসেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব, যিনি এর আগে বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবী অনুযায়ী, এই সফরের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কী সেই তাৎপর্য?

আগাম কোন সংকেত না দিয়ে আচমকাই বাংলাদেশ সফরে এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। দুই দিনের ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন তিনি, অফিসিয়ালি বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো জোরদার করতেই হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাকে ঢাকায় পাঠিয়েছে নয়াদিল্লি। তবে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশকে দেয়া চীনের অর্থায়ন প্রতিশ্রুতিতে নয়াদিল্লি দুর্ভাবনায় পড়েছে, একারণেই তড়িঘড়ি করে মোদি সরকার শ্রিংলাকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে নতুন গতি আনার জন্য। এখানে বলে রাখা ভালো, হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা কিন্ত বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। 

ভারতীয় এয়ারফোর্সের বিশেষ এক বিমানে চড়ে ঢাকায় নেমেছেন শ্রিংলা। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই কেন তাকে বাংলাদেশে আসতে হলো- এই নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। শ্রিংলার এই সফর নিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দিনের এই সফরে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা ‘দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করতে ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এগিয়ে নিতে চেষ্টা করবেন।’

তবে গোটা ব্যাপারটা এই বিবৃতির মতো সহজ সরল নয় মোটেও। কূটনীতি ব্যাপারটাই তো জটিলতায় ভরপুর। তার ওপর গত এক-দেড় মাসে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে ঘন ঘন বদলেছে, ভারত বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এই অঞ্চলে। দীর্ঘদিনের বন্ধু নেপাল হাতছাড়া হয়েছে, ভারতের ক্রমাগত বঞ্চনার কারণে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বটাও আগের মতো নেই আর। অবস্থা এমনই পর্যায়ে চলে গেছে যে, ভারতের জাতীয় দৈনিক দ্য হিন্দু তো খবর প্রকাশ করেছে এই বলে যে- বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রিভা দাস গাঙ্গুলী নাকি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চেয়েও পাচ্ছেন না! কাজেই শ্রিংলার এই সফরটা যে ক্ষতে প্রলেপ দেয়ার একটা মাধ্যম, সেটা বলে না দিলেও চলছে। 

ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছেন হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা

ইস্যু অবশ্য আরও আছে। বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বের ইতিহাস অনেক পুরনো, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দুই দেশ একে অন্যের পাশে থেকেছে বরাবরই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সেই বন্ধুত্বে চিড় ধরেছে খানিকটা হলেও, আর তাতে দায় পুরোটাই ভারতের। বন্ধুত্ব কখনও একপেশে হয় না, ভারত সরকার বাংলাদেশের বন্ধুত্বটাকে 'টেকেন ফর গ্র‍্যান্টেড' হিসেবে নিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদির জমানায় বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ভারতের। গত বছরে নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে বিজেপি নেতাদের মন্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছিল। এখন লাদাখে চীন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। আর পুরনো সুসম্পর্কের জেরে বাংলাদেশের সঙ্গে ক্রমেই ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে চীনের।

ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি আটকে রয়েছে। কিন্তু শুষ্ক মরসুমে তিস্তার পানি ধরে রাখার প্রকল্পে বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। করোনার সম্ভাব্য টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা বাংলাদেশে চালানোর ছাড়পত্রও চীন পেয়েছে। এদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি হাসিনাকে ফোন করে করোনা ও বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, ঢাকার সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় ইসলামাবাদ। এই ঘটনাটা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছে উপমহাদেশেএ রাজনৈতিক অঙ্গনে। নেপালের মতো বাংলাদেশও ভারতকে ছেড়ে চীনা বলয়ে যুক্ত হবে কিনা- উঠেছে এমন প্রশ্নও। 

ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ইস্যু হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। সিকিমে উত্পত্তি হওয়া তিস্তা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসামে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে ও বাংলাদেশে যমুনা নদীর সঙ্গে মিশেছে। বাংলাদেশের দাবি, প্রতি বছরের ডিসেম্বর-মার্চ সময়ের মধ্যে ভারতকে নদীটির পানিপ্রবাহের পঞ্চাশ শতাংশ বাংলাদেশকে দিতে হবে। বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ভারত সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। কখনও কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা, কখনও বা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের আপত্তির কারণে সম্ভব হয়নি পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করা। দ্য প্রিন্টা জানাচ্ছে, মোদি সরকার চুক্তি চূড়ান্ত করতে ব্যর্থ হওয়াতেই তিস্তা প্রকল্পে চীনের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যেটা ভারতের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে। 

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব আর আগের মতো নেই- বলছে গণমাধ্যম

চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ভারতের আশংকার আরও কারণ আছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ অনেকাংশে বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সব প্রোজেক্ট হচ্ছে চীনের অর্থায়নে, অন্যদিকে ভারতীয় অর্থায়নে বা ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত প্রজেক্টগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, শ্লথ হয়ে গেছে গতি। যেটা ভারতের জন্য দুশ্চিন্তার। সিলেটের এমএজি ওসমানী বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে চীনা একটা কোম্পানীকে, এটাও ভারতের জন্য মাথাব্যথা, কারণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে চীনের নজরদারী বেড়ে যাওয়ার আশংকা আছে এর মাধ্যমে, সীমান্তের এত কাছে চীনা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান দেখতে চায় না ভারত। কিন্ত বর্তমান বাস্তবতায় তারা না পারছে কিছু রইতে, না পারছে সইতে। 

হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার এই সফরে এসব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হবেই- এটা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশকে হারানোর ভয় যে ভারতের মধ্যে চেপে বসেছে, সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। নইলে এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সফরের কোন কারণ নেই। ভারত চাইলে আরও উচ্চপদস্থ কাউকেও এই সফরে পাঠাতে পারতো, তা না করে তারা শ্রিংলাকে পাঠিয়েছে, কারণ তিনি এর আগে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করে গেছেন, এদেশের সঙ্গে তার একটা যোগাযোগ আছে। তিনি বিষয়গুলো যত সহজে সমাধান করতে পারবেন, সেটা অন্য কেউ না'ও পারতে পারে। 

বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রিংলা যতটা গুরুত্ব দিয়ে ঢাকায় উড়ে এসেছেন, আমরা আশা করব ভারতও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ততটাই গুরুত্ব দেবে, সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধ করবে, তিস্তার পানির ভাগ বুঝিয়ে দেবে। বন্ধুত্ব দেনা-পাওনায় হয়, শুধু দিয়ে গেলে যেমন বন্ধুত্ব হয় না, শুধু কেড়ে নিতে থাকলেও সেই বন্ধুত্ব টেকে না বেশিদিন... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা