সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা ভুল পথে হেঁটেছেন, শপিং মল খোলার মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্ত আমাদের দোকান মালিকেরা ভুল পথে পা বাড়াননি। জীবিকার চেয়ে জীবনের নিরাপত্তাকে বড় করে দেখা এই মানুষগুলোকে স্যালুট জানাতে চাই একটাবার...

নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি জিম্মি হয় যে পেশাজীবিদের কাছে, তারা সম্ভবত ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। বিপদের সমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী করে তুলতে তাদের জুড়ি নেই। পেঁয়াজের দাম আড়াইশো টাকা ছুঁয়েছিল খুব বেশিদিন হয়নি কিন্ত এসব নিয়ে আগেও প্রচুর সমালোচনা আমরা করেছি, ভবিষ্যতেও করব। তবে আজ ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটা দলকে মন থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সেজন্যেই এই লেখার অবতারণা। 

১০ই মে থেকে শপিং সেন্টার এবং মার্কেট খুলে দেয়ার যে সিদ্ধান্ত সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা নিয়েছিলেন, তার সঙ্গে একমত হননি বসুন্ধরা সিটি এবং যমুনা ফিউচার পার্কের দোকান মালিক সমিতি। তাই ঈদের আগে তারা দোকান খুলবেন না। নিউমার্কেট এবং চন্দ্রিমা বিপনী বিতানের দোকান মালিকরাও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জীবিকার চেয়ে জীবনের নিরাপত্তাকে বড় করে দেখা এই মানুষগুলোকে স্যালুট জানাতে চাই একটাবার। 

শুরুটা করেছিল বসুন্ধরা সিটির দোকান মালিক সমিতি। সরকার ১০ই মে থেকে সীমিত আকারে শপিং মল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা অনুধাবন করে মার্কেট বন্ধ রাখার ব্যাপারে একমত হয় বসুন্ধরার দোকান মালিকরা। বসুন্ধরা শপিং মল দোকান মালিক সমিতির সভাপতি এম এ হান্নান বলছিলেন- 

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল

"করোনার কারণে ঈদের আগে বসুন্ধরা শপিং মল খোলা হবেনা বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। অধিকাংশ দোকানদার সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে চলতে পারবে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব কীভাবে মানবে? ক্রেতারা যখন আসবে তাদের মধ্যে তো তেমন দূরত্ব থাকবে না। আবার ক্রেতারা কোনো পণ্যই হাত দিয়ে স্পর্শ ছাড়া কেনে না। জিনিসপত্রে ক্রেতার হাতের স্পর্শ লাগবেই। আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেটে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

আমাদের কোনো কোনো দোকানে ২০ থেকে ২৫ জন করে কর্মচারীও রয়েছে। এদের কেউ যদি একজন আক্রান্ত হয়, তাহলে তো ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। বেশিরভাগ দোকানদার বলছেন লকডাউন যদি আরও কিছুদিন বাড়ে, তারা সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চায়। কারণ জীবিকার চেয়ে জীবন বড়।" 

বসুন্ধরার এই খবরটা তাজা থাকতে থাকতেই সংবাদ এসেছে, রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কও খুলবে না ঈদের আগে। এই শপিং সেন্টারটির মালিকপক্ষ বলেছেন, ঈদের আগ মুহূর্তে ক্রেতাদের ভিড় বাড়বে এটিই বাস্তবতা। ক্রেতা-বিক্রেতার অতি ব্যস্ততার কারণে মার্কেটে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের নিয়ম লঙ্ঘন হতে পারে। এরকমটি হলো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়বে। তাই যমুনা ফিউচার পার্ক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ঢাকায় মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের কেনাকাটার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা নিউমার্কেট। সাধ্যের মধ্যে প্রায় সব পণ্যই এখানে পাওয়া যায়, একারণে রোজার মাসে অবিশ্বাস্য রকমের ভীড় হয় নিউমার্কেট, গাউছিয়া, ধানমন্ডি হকার্স এবং চন্দ্রিমা মার্কেটে। মানুষের ভীড়ে হাঁটা যায় না- এমন ভীড় লেগে থাকে সারাক্ষণ। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার কোন ব্যবস্থাই নেই এসব মার্কেটে। তাই নিউমার্কেট এবং চন্দ্রিমা মার্কেটের দোকান মালিকেরাও সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঈদের আগে তারা দোকান খুলবেন না। করোনাভাইরাসের এই প্রকোপ কমলেই তারা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করবেন, নিজের, পরিবারের আর সঙ্গে আরও হাজার হাজার মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চান না তারা। 

নিউমার্কেটে ঈদ শপিংয়ে মানুষের ভীড়

বসুন্ধরা বা যমুনা ফিউচার পার্কের দোকান মালিকদের কথা বাদ দিলাম। এমন সিদ্ধান্ত নিতে নিউমার্কেট বা চন্দ্রিমার দোকান মালিকদের নিশ্চয়ই বেগ পেতে হয়েছে। তাদের মূল ব্যবসাটাই হয় রোজার ঈদে। এরা কেউই খুব বেশি পয়সাওয়ালা নন, দুটো দিন দোকান বন্ধ থাকলে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। গত দুই মাস ধরে একটা টাকাও আয় করেননি তারা, ঈদে দোকান খুললে হয়তো বিশাল এই ক্ষতিটা একটু পুষিয়ে নিতে পারতেন, ক'টা কাঁচা টাকার মুখ দেখতেন, পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরতো একটু, বাসা ভাড়াটা বাকী পড়তো না, ঈদের দিনটা খোশ মেজাজে কাটাতে পারতেন, অনাগত দিনগুলোর দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম নষ্ট করতে হতো না। 

সেই পথে তারা হাঁটেননি, নিজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের পরিবার, দোকানের কর্মচারী, আর দেশের হাজার হাজার, কিংবা লাখো মানুষকে নিরাপদ রাখার চিন্তায় দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই মানুষগুলো। সরকারের নীতি-নির্ধারকেরা ভুল পথে হেঁটেছেন, শপিং মল খোলার মতো আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আমাদের এই দোকান মালিকেরা ভুল পথে পা বাড়াননি। এই মানুষগুলোর জন্যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। ডাক্তার আর পুলিশের পাশাপাশি করোনার বিরুদ্ধে তাদের এই যুদ্ধটার কথাও যেন আমরা ভুলে না যাই কখনও...  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা