ত্রিশ বছরের রাজত্ব: দ্য রাইজ এন্ড ফল অফ আহমদ শফি!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একদিন যে আহমদ শফি শাপলা চত্ত্বরের জনসভায় সরকার ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, 'নাস্তিক-মুরতাদ' রব তুলে কিছু নিরীহ ব্লগারের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন, তিনিই অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে রাতের আঁধারে ত্রিশ বছরের রাজত্ব ছাড়লেন পরাজিত সৈনিকের মতো...
সপ্তাহখানেক আগেও হেফাজতে ইসলাম বা হাটহাজারী মাদ্রাসায় আহমদ শফীর একচ্ছত্র নেতৃত্ব নিয়ে কারো কোন সংশয় ছিল না। কিন্ত কয়েকদিনের ব্যবধানেই ভোজবাজির মতো পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে হেফাজতের মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরীর সমর্থিত গ্রুপটি, মাদ্রাসার কর্তৃত্ব এখন তাদের হাতে। ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে দফায় দফায়, ভাংচুর চালানো হয়েছে মাদ্রাসায়, ছাত্রদের হাতে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন শফীপন্থী শিক্ষকেরাও।
আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী, যাকে হেফাজত এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার পরবর্তী নেতা হিসেবে ভাবা হচ্ছিল, তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বিক্ষোভের মুখে, আহমদ শফী নিজেও মাদ্রাসার পরিচালকের পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, এই মাদ্রাসায় তার ত্রিশ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান হলো এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে। প্রগতিশীল ব্লগারদের ফাঁসির দাবীতে রাজপথে নেমে যে আহমদ শফী একসময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলোর একটি হয়ে উঠেছিলেন, নারীদের তেঁতুল হিসেবে বর্ণনা করে বা মেয়দের ক্লাস ফাইভের বেশি পড়তে না দেয়ার ফতোয়া দেয়া সেই আহমদ শফীর শেষ পরিণতিটা হলো এমনই করুণ।
হেফাজত নেতাদের উত্থান এবং আজকের বিরোধের কারন জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়া হেফাজতের নেতৃত্বে ছিলেন আহমদ শফি এবং জুনাইদ বাবুনগরী। এদেশের মানুষের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে এবং অপপ্রচার চালিয়ে তথাকথিত 'নাস্তিক ব্লগার'দের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারা, ৫ই মে ঢাকার শাপলা চত্বরে লাখো মানুষের সমাবেশ করে জানান দিয়েছিল নিজেদের শক্তিমত্তা, এমনকি সরকার পতনের হুমকিও উচ্চারিত হয়েছে সংগঠনটির নেতাদের মুখে!
একটা সময় আহমদ শফি এবং জুনায়েদ বাবুনগরী ছিলেন হরিহর আত্মা, গুরু-শিষ্যের মতোই সম্পর্ক ছিল দুজনের মধ্যে। আহমদ শফির বয়স হয়েছে, মাঝেমধ্যেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। বাবুনগরী হয়তো ভেবে রেখেছিলেন, শফির পরে তিনিই হতে যাচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা। কিন্ত সেই আশায় গুঁড়েবালি ঢেলে দিয়ে আহমদ শফি তার ছেলে আনাস মাদানীকে ক্রমেই ক্ষমতাধর করে তুললেন। হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক ও মাদ্রাসার পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো আনাস মাদানীকে; বাবুনগরী হয়ে গেলেন ব্রাত্য, তাকে সরিয়ে দেয়া হয় মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকের পদ থেকেও। আহমদ শফির 'সেকেন্ড ইন কমান্ড' এর পক্ষে সেটা মেনে নেয়া সহজ কিছু ছিল না।
তাছাড়া এখানে রাজনৈতিক কিছু সমীকরণও আছে। আহমদ শফী এবং তার ছেলের নেতৃত্বাধীন অংশটা সরকারের সঙ্গে লিঁয়াজো করেছিল, কওমি ডিগ্রির মান বাড়ানো, রেলওয়ের জমির ভাগ পাওয়া সহ বেশ কিছু সুবিধার বিনিময়ে তারা সরকারের বিরোধিতা করবে না- এরকম একটা অবস্থানে গিয়েছিল বলে বাবুনগরীর পক্ষের দাবী। অন্যদিকে শফিপন্থীরা বলছেন, বাবুনগরীর পক্ষাবলম্বনকারীরা বিএনপি জামায়াতের মদদপুষ্ট, সরকারের সঙ্গে হেফাজতের ভালো সম্পর্ক তারা মেনে নিতে পারছে না, একারণেই বিরোধের সূত্রপাত ঘটেছে। হেফাজতকে যারা ইসলামের রক্ষাকর্তা ভাবতেন, তারা বুঝতেই পারছেন আশা করি, ধর্ম নয়, রাজনীতি আর সুবিধা প্রাপ্তিই এই লোকগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সবসময়।
তিনদিন ধরে সেই সংঘর্ষই চলছে। একদিকে বাবুনগরী গ্রুপ, অন্যদিকে আহমদ শফী এবং আনাস মাদানী সমর্থিত গ্রুপ। বাবুনগরীর দল ছিল এখানে পাল্লায় ভারী। তারা শফী সমর্থকদের রুমে ভাংচুর চালিয়েছে, মারধর করেছে এক শিক্ষককে, বিচ্ছিরু ভাষায় গালিগালাজ তো আছেই। এতকিছুর পরে আবার পুলিশ যাতে তাদের বাধা না দেয়, সেজন্য মাদ্রাসার বাইরে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছে, সেই প্ল্যাকার্ডে লেখা- এটা মাদ্রাসার আভ্যন্তরীণ বিষয়, পুলিশ যাতে হস্তক্ষেপ না করে! এদের কথাবার্তা শুনলে যেন হাটহাজারী মাদ্রাসাটা বাংলাদেশের অংশ নয়! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি হলে যদি পুলিশ যেতে পারে, হাটহাজারী মাদ্রাসায় যেতে পারবে না কেন?
আহমদ শফীর কাছে ফিরে আসি। ত্রিশ বছর ধরে তিনি দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজ করেছেন হাটহাজারী মাদ্রাসায়। এই মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল এবং একইসাথে পরিচালকের দায়িত্ব তিনি পান ১৯৮৯ সালে। এর আগে ২০ বছরেরও বেশি সময় তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। আহমদ শফী যখন প্রধানের দায়িত্ব পালন শুরু করেন, তখন মাদ্রাসার বেশিরভাগ শিক্ষকই তার ছাত্র ছিলেন। ফলে তারা আহমদ শফীর কোন সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ড কখনও চ্যালেঞ্জ করতেন না।
আহমদ শফির ছেলে আনাস মাদানী হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নব্বইয়ের দশকে। একদিকে বেশিরভাগ শিক্ষকের পক্ষ থেকে কোন চ্যালেঞ্জ ছিল না, অন্যদিকে ৯০-এর দশকের শেষদিকে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়তে থাকায় দেশের সবচেয়ে বড় মাদ্রাসার প্রধান হিসাবে আহমদ শফীর একটা গুরুত্ব এবং আলাদা ভাবমূর্তি তৈরি হয়। এসবের সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতির কারণে মাদ্রাসাটিতে আহমদ শফী এবং তার ছেলে আনাস মাদানীর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব গড়ে ওঠে।
মাদ্রাসা পরিচালনার যে শূরা কমিটি রয়েছে, ২০০০ সাল থেকে ১৬ বছর সেই কমিটির কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। আহমদ শফীর নিজের মতামত অনুযায়ীই ছাত্র ভর্তি এবং শিক্ষক নিয়োগ ও অপসারণসহ সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সে কারণে কর্তৃত্ব বা মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল দীর্ঘ সময় ধরে। এগুলোর কারণেও অসন্তোষ বেড়েছে। তবে আহমদ শফির পতনের পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে হেফাজত নেতাদের সরকারপন্থী এবং সরকারবিরোধী অবস্থানে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়াটাই, আর সেই কৃতিত্ব আওয়ামী লিগ সরকার ভালোভাবেই পাবে। ধর্মের নাম তুলে হেফাজত যে আসলে ধর্ম ব্যবসার আসর জমিয়ে রেখেছিল, সেটা এই দ্বন্দ্বটা প্রকাশ্যে আসায় আরো ভালোভাবে প্রমাণীত হলো।
গতকাল রাতে মাদ্রাসার পরিচালকের পদ ছেড়েছেন আহমদ শফি, নিজের ছেলেকে শিক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন একদিন আগেই। হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চট্টগ্রামের এক হাসপাতালে। একদিন যে আহমদ শফি শাপলা চত্ত্বরের জনসভায় সরকার ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, 'নাস্তিক মুরতাদ' রব তুলে কিছু নিরীহ ব্লগারের জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলেন, তিনিই রাতের আঁধারে ত্রিশ বছরের রাজত্ব ছাড়লেন পরাজিত সৈনিকের মতো। কে জানে, এটাই হয়তো প্রকৃতির প্রতিশোধ! এই অপমানটা আহমদ শফির ভাগ্যে বিধাতাই লিখে রেখেছিলেন হয়তো...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন