জাতীয় পতাকার ডিজাইনার তিনি, অস্ত্র হাতে করেছেন মুক্তিযুদ্ধও। অথচ দেশের ইতিহাস তাকে মনে রাখেনি, দেয়া হয়নি কোন স্বীকৃতি। অভিমানে শিব নারায়ণ দাস বা তার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা গীতশ্রী চৌধুরী- কেউই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেন না...

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ডিজাইনার কে? আমরা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি আমাদের জাতীয় পতাকার নকশা করেছেন কামরুল হাসান। কিন্তু, এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি আছে। বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটি যে পতাকায় আমরা বাংলাদেশের মানচিত্র দেখেছি, সেই পতাকাটির নকশাকার ছিলেন শিব নারায়ণ দাশ। পরবর্তীতে মানচিত্রের অংশটুকু বাদ দিয়ে শুধু লাল সবুজের পতাকাটির ডিজাইন হয় কামরুল হাসানের হাত ধরে। সে সূত্রে কামরুল হাসানেরও ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না তবে শিব নারায়ণ দাশকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটির নকশাকার যে এই মানুষটি!

পেছনে ফিরি একটু। ১৯৭০ সাল। জুন মাস। এই মাসের ৭ তারিখ পল্টন ময়দানে ছাত্রদের একটি সামরিক কুচকাওয়াজে অংশ নেয়ার কথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সিদ্ধান্ত হয় এদিন বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়া হবে। সেই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় জয়বাংলা বাহিনী। এই বাহিনী একটা পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। দ্রষ্টব্য যে, এই পতাকাটিই পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পতাকার মর্যাদা লাভ করে৷ যাহোক, কুচকাওয়াজের আগের দিন ৬ জুন কতিপয় ছাত্রনেতা হাজির হন সার্জেন্ট জহরুল হক হলে, অবশ্য তখন হলটির নাম ছিল ইকবাল হল।

সেই ইকবাল হলের ১১৬ নাম্বার রুমে (বর্তমান ১১৮ নং রুম) তখনকার ছাত্রলীগ নেতা আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ, হাসানুল হক ইনু, মনিরুল ইসলাম মনি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারা আলোচনা করতে লাগলেন নিজেদের মধ্যে কেমন হবে পতাকার রুপ। মনিরুল মনি মতামত দিলেন, পতাকার জমিন হবে ব্যাটল গ্রিন। শাহজাহান সিরাজ বললেন, রক্ত লাল একটা কিছু যেন থাকে পতাকায়। কাজী আরেফ বললেন, পতাকার মাঝখানে রক্ত লাল প্রভাত সূর্যের মাঝে সোনালি রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা থাকবে। পতাকার থিম মোটামুটি তারা ঠিক করে ফেললেন আলোচনা করে।

পতাকার ডিজাইন করছেন শিব নারায়ণ দাস

সেইসময় তো আজকের দিনের মতো এত শিল্পী, নকশাকার ছিলেন না। তাই স্মরণ করা হলো শিব নারায়ণকে। এই মানুষটি নিজেও ছাত্রলীগ করতেন। ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতির লাইনে পদার্পন তার। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন করে কারাবরণ করার অভিজ্ঞতাও আছে তার। কুমিল্লা নিবাসী এই শিব নারায়ণকে ডাকা হলো সেদিন ১১৬ নাম্বার রুমে। সবাই জানে আঁকাআঁকিটা ভাল পারে শিব নারায়ণ। 

শিব নারায়ণকে নির্দেশনা জানানো হলো। বুঝিয়ে বলা হলো থিম কি হবে। নিপুন শিল্পী খুবই দক্ষতার সাথে নকশা করে দিলেন পতাকার। এই পতাকাটিই একাত্তর সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে মুজিবনগরেও ওড়ানো হয় এই পতাকাটিই। উইকিপিডিয়াতেও শিব নারায়ণকে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকার মূল ডিজাইনার হিসেবে। কিন্তু, বাস্তবিক অর্থে শিব নারায়ণ দাশ কতটুকু স্বীকৃতি পেয়েছেন আসলে? আমরা কতজনই জানি শিব নারায়ণের কথা? অথচ, বিস্মৃত এই মানুষটিই যে আমাদের প্রাণের জাতীয় পতাকার ইতিহাসে জড়িয়ে!

শিব নারায়ণ দাশ পিতা সতীশচন্দ্র দাশ। সেই ভদ্রলোক কুমিল্লা জেলায় আয়ুর্বেদ চিকিৎসা প্র‍্যাকটিস করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণে বাঁচলেন না সতীশচন্দ্র। সেইসময় তো এমনিতেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছিল জামাতি রাজাকার, পাকি বর্বররা। সেই ধাক্কা থেকে রেহাই পাননি সতীশচন্দ্রও। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে ওরা।

সেই পিতা হারানোর ক্ষত তো আছেই এর বাইরে যোগ হয়েছে স্বীকৃতি না পাওয়ার অভিমান। স্বাধীনতার পর পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিয়ে লাল সবুজের বর্তমান পতাকার রুপটি নির্ধারণ হয়। এই কাজের দায়িত্ব পান আরেক শিল্পী কামরুল হাসান। আর তাতেই আড়ালে পড়ে যান শিব নারায়ণ দাশ। পাঠ্যপুস্তক সহ সমস্থ জায়গায় জাতীয় পতাকার ডিজাইনার হিসেবে স্বীকৃতি পান কামরুল হাসান। বিস্মৃত হয়ে যান শিব নারায়ণ দাশ। ফলে অভিমান জমা হয় তার মনে। সব কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।

দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্ত দেশের ইতিহাস শিব নারায়ণ দাসকে মনে রাখেনি

শিব নারায়ণ যে শুধু পতাকার ইতিহাসের সাথেই জড়িত তা নয়। তিনি একজন গেরিলা যোদ্ধাও বটে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তারও কোনো স্বীকৃতি মেলেনি ওভাবে৷ হয়ত স্বীকৃতির আশাও করেননি, কোন মুক্তিযোদ্ধাই কি করে? তবে যখন দেখেন, এই যুগে এসে যখন অমুক্তিযোদ্ধারাও সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সাজেন, রাজাকাররাও মন্ত্রী মিনিস্টার হয় তখন অভিমান জমাটাই কি স্বাভাবিক নয়! শিব নারায়ণের স্ত্রী গীতশ্রী চৌধুরীও একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু অভিমানের পাহাড় এত ভারী হয়েছে দুজনার যে, এই দম্পতি রাষ্ট্র থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন।

উনপঞ্চাশটি বছর পার হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির খুব কাছাকাছি আমরা। নিশ্চয়ই অনেক গালভরা প্রোগ্রাম হবে, কর্পোরেট আবেগী বিজ্ঞাপনে ডুবে যাবে টেলিভিশন। কিন্তু সত্যিকারের আবেগ কি লালন করছি কেউ? করলে নিশ্চয়ই শিব নারায়ণ দাশও থাকতেন আমাদের মনে, তার কাজেরও খানিকটা স্বীকৃতি মিলতো! আমাদের দেওয়ার কিছু নেই আজ, আপনারাই দিয়ে গেছেন সব অকাতরে জনমভর, শুধু একটা ধন্যবাদ দিয়ে যাই আপনাকে প্রিয় শিব নারায়ণ দাশ, সাহসী মুক্তিযোদ্ধা...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা