"আমি যেদিন দেশ ছেড়েছিলাম, সেদিন আমাকে বিদায় দেয়ার জন্যে কামাল, জামাল, ওদের স্ত্রীরা, রাসেল- সবাই ছিল। আমি যখন ফিরে এলাম, তখন হাজার হাজার মানুষ, কিন্ত সেই মানুষের ভীড়ে যে মুখগুলো আমি দেখতে চাচ্ছি, সেগুলো কোথাও ছিল না..."

"আমার একটা ভয় হতো সবসময়, আব্বা এভাবে দেশটা স্বাধীন করে ফেললেন, কখন কি ঘটে, কারণ স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা তো চুপ করে বসে ছিল না, তারা সবসময়ই সক্রিয় ছিল, একটা চক্রান্ত সবসময় করার চেষ্টা করতো। আমার স্বামী যেহেতু নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট ছিলেন, দেশের বাইরে একটা ইউনিভার্সিটিতে তিনি গেলেন একটা রিসার্চের কাজে। কয়েকদিন পরে তিনি ফোনে আমাকে বললেন বাচ্চাদের নিয়ে ওখানে যাওয়ার জন্যে। 

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, বঙ্গবন্ধুর তো তখন যাওয়ার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি খুব দোমনায় ছিলাম যে, বঙ্গবন্ধু যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর আমি সেখানকার ছাত্রী হয়েও তখন থাকতে পারব না, এটা কেমন দেখায়।" "আমি ভিসি স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, মতিন চৌধুরী স্যার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। আমার স্বামী আবার উনার সরাসরি ছাত্র ছিলেন। উনি শুনে বললেন, এই সময়ে তুমি চলে যাবা এটা একটা কথা হলো নাকি! আমি বললাম, স্যার আপনার ছাত্র তো ভীষণ চাপ দিচ্ছে, কি করব? আপনি আপনার ছাত্রকে বলেন আমি এখন যাব না, পনেরো তারিখের পরে যাব। তখন উনি বললেন, তুমি আমার কথা বলে ফোন করো।" 

"তখন তো এতসব মোবাইলের ব্যবস্থা নেই, আমাদের টেলিফোন আব্বার রুমে, সেখান থেকে ফোন করলাম, ফোনে খেলাম বকা। আব্বা তখন সামনে বসা, উনার সামনে তো কিছু বলতেও পারছি না, রাগও দেখাতে পারছি না। অন্য সময় হলে হয়তো আমিও পাল্টা বকাটকা দিতাম, তখন তো চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া কিচ্ছু বলতে পারছি না। আব্বা তার কথা না শুনেও বুঝতে পারলেন যে সে কি বলছে। আমাকে বললেন, ওয়াজেদ যেতে বলেছে? আচ্ছা, তাহলে তুমি তাহলে যাও। আমার তো খুব মন খারাপ। আব্বার সাথে আমার একটা ছবি আছে, আমি আব্বাকে জড়িয়ে ধরে আছি, আব্বার পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি, সেটা কিন্ত আমাদের শেষ ছবি, আমার দেশ ছাড়ার আগে তোলা।"

প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি সময় কাটান রান্নাঘরে

"যাওয়ার সময় মনটা খুব খারাপ ছিল। কয়েকদিন আগেই আর দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে, বাড়িতে একটা খুশির পরিবেশ, সেটা ছেড়ে যেতে একদমই মন চাইছিল না। বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার সময় মানুষ যেমন খুশি মনে থাকে, সেরকম কিছুই ছিল না৷ বিদায় দেয়ার সময় আমার মা'ও আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন।" 

"আমরা তখন বেলজিয়ামে, হঠাৎ সকাল বেলা একটা ফোন এলো। ওখানকার অ্যাম্বাসেডর আমাদের বললেন যে বাংলাদেশে 'ক্যু' হয়েছে৷ ওই কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার মনে হলো যে, তাহলে তো আমার আর কেউ নাই। তখনও কিন্ত আমরা কেউ কিচ্ছু জানি না। ওদের টিভি চ্যানেলগুলোতে শুধু আব্বার ছবি দেখানো হচ্ছে, কিন্ত ওদের ভাষায় কি লেখা কিছুই বুঝতে পারছি না। সেখান থেকে আমরা সেদিনই জার্মানীতে ফিরে এলাম।"

"জার্মানীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যিনি ছিলেম, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, তিনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তখন, তিনি, তার ওয়াইফ সবাই আমাদেরকে খুব স্বান্তনা দিলেন। একসময় আমাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বললেন, 'আমি বিভিন্নভাবে খবর নিয়েছি, মনে হয় কেউ বেঁচে নাই।' খবরটা শোনার পরে কিছুক্ষণ কি হয়েছিল আমি বলতে পারব না, স্মৃতি থেকে আমার ওই সময়টা হারিয়ে গেছে। রুমে এসে দেখি রেহানা শুয়ে আছি, আমিও ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকলাম, কিন্ত বলতে পারলাম না কিছুই। ওকে আমি কিছু বলিনি, আবার ও যখন জানতে পারলো তখন আবার আমাকে কিছু বলেনি, আমরা নিজেদের মধ্যে লুকোচুরি খেলছিলাম, এরকম একটা অবস্থা।" 

"এরপর নানা জায়গা থেকে ফোন। ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি থেকে যোগাযোগ করা হলো, কারণ মিসেস গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) খোঁজ নিচ্ছিলেন আমাদের, মার্শাল টিটো ফোন করেছিলেন৷ জার্মান সরকারও যোগাযোগ করলো। আমাদের তখন একটাই চিন্তা, কোনভাবে দেশে ফেরা যায় কিনা। সেজন্যেই আমরা চলে এলাম দিল্লিতে। তখনও একটা আশা ছিল যে মা বা রাসেল বেঁচে আছে, আমার রাসেলকে হয়তো ওরা মারেনি। ভারতে এসে জানলাম, মিসেস গান্ধীর সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন তিনি বললেন যে না, সত্যিই কেউ আর নাই। তোমরা এখন এখানেই থাকো, আমার শেল্টারে।" 

দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি উঠে পড়েন রিক্সা ভ্যানে

"ছয়টা বছর ওই অবস্থায় থাকতে হলো। প্রথম কয়েকটা বছর বিশ্বাসই হয়নি, বিশ্বাস করতে চাইনি। নামাজ পড়তাম, মোনাজাত ধরতাম, কিন্ত বাবা-মা যে মারা গেছেন, এই কথাটা কখনও ভেতর থেকে বের হতো না, বলতে পারতাম না। পঁচাত্তরের পরে ওই তিন-চার বছর খুব অন্ধকার একটা সময় ছিল। সারাদিন একটা বাসায় আমরা বন্দি, সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ ছিল না, এমনকি আমরা নিজেদের নামও নিতে পারতাম না, একটা ছদ্ম নাম দেয়া ছিল, সেই পরিচয়টাই আমরা ব্যবহার করতাম।"

"বাড়ির বড় মেয়ে ছিলাম, আদরে আহ্লাদে বড় হয়েছি, নিজে কাজ খুব একটা করিনি কখনও। চা-কফি খেতে ইচ্ছে হয়েছে, মা বানিয়ে খাইয়েছে। রাতে ভাত না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি, বাবা এসে ঘুম থেকে তুলে ভাত মেখে খাইয়েছে, এরকম আলসে ছিলাম। সেখান থেকে এমন একটা জায়গায় যেতে হলো, ঘর ঝাড়ু থেকে শুরু করে সব কাজই নিজেদের করতে হতো, নতুন করে সবকিছু শিখতে হয়েছিল। আমাদের জীবনটা তখন ছিল, বেঁচে থাকার জন্যে শুধু যতটা করা যায়, যতটা খাওয়া যায়, সেটুকুই। সেই জীবনে বিলাসিতা বলে কোনকিছুর অস্তিত্বও ছিল না।" 

"আমি যখন দেশে ফিরতে চাইলাম, তখন সরকারের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হলো। আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও বললো দেশে না ফিরতে, এয়ারপোর্টেই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে৷ বাবা-মা-ভাই-ভাবী সবই তো হারিয়েছি, আমার তো তখন হারানোর কিছু নাই আর। হারালে হারাবো, সেজন্যে বসে থাকতে তো পারব না, আর মরার আগে মরতেও আমি রাজী না। মে মাসের ১৭ তারিখে যখন এয়ারপোর্টে নামলাম, ওই সময়টা ছিল আমার জন্যে খুবই কষ্টের। কারণ আমি যেদিন দেশ ছেড়েছিলাম, সেদিন আমাকে বিদায় দেয়ার জন্যে কামাল, কামালের স্ত্রী, জামাল, ওর স্ত্রী, রাসেল- সবাই ছিল। আমি যখন ফিরে এলাম, তখন হাজার হাজার মানুষ, কিন্ত সেই মানুষের ভীড়ে যে মুখগুলো আমি দেখতে চাচ্ছি, সেগুলো কোথাও ছিল না..."

এই লৌহমানবীর কথাগুলো শুনতে শুনতে চোখ ভিজে আসে। কোন এক ভোরে ঘুম ভেঙেই শেখ হাসিনা শুনতে পেয়েছিলেন, একমাত্র বোন ছাড়া পরিবারের বাকী সব সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, সাজানো পৃথিবীটা চোখের পলকে বদলে গিয়েছিল তার৷ ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে যখন জমাট রক্তের স্রোত কালচে রঙ ধারণ করছে, তখন সুদূর ইউরোপে শেখ হাসিনাকে ছুটতে হয়েছে আশ্রয়ের খোঁজে। বঙ্গবন্ধু যে দেশটার জন্ম দিয়েছিলেন, সেই দেশে তার মেয়েকে পা রাখতে দেয়া হয়নি দীর্ঘ ছয় বছর, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না- এই মর্মে জারী করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। 

সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলোর কথা তবুও তাকে বলতে হয়। বুকে পাথর বেঁধে সেই গল্পগুলো শোনাতে হয় শ্রোতাদের। কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে জল জমে, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে, তবুও তিনি বলে চলেন। সাড়ে চার দশক পরেও প্রিয়জন হারিয়ে ফেলার সেই বেদনার ক্ষতগুলো তার বুকের ভেতরে দগদগে ঘা হয়ে জেগে রয়। সেই ব্যাথা চেপে রেখেই তিনি পথ চলেন, আলোর মশাল হাতে নিয়ে, পুরো দেশের নেতৃত্বের পাহাড়সম ভার কাঁধে বয়ে তিনি এগিয়ে যান... 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা