যে মানুষটা ত্রিশ বছর ধরে প্রতিদিন গাছ লাগিয়েছিলেন!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সামাদ শেখ মনে করতেন গাছ লাগানোটা পূণ্যের কাজ, এতে সওয়াব মেলে, মানুষের উপকার হয়। আর তাই সারাটা জীবন ধরে ছুটেছেন গাছ লাগানোর পেছনে। তাঁর লাগানো গাছে ফল ধরেছে, অন্ন যুগিয়েছে মানুষের। কিংবা ঔষধি গাছের ছালবাকল বা পাতা কারো চিকিৎসায় কাজে লেগেছে।
নাম তাঁর শেখ আবদুস সামাদ, এলাকার লোকে ডাকতো গাছ পাগলা সামাদ। একটাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান- গাছ লাগানো। পেশায় তিনি রিক্সাচালক, অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, চালডালের খোঁজ নেই, অথচ নিজের সামান্য উপার্জনের সবটুকু দিয়ে এলাকাজুড়ে লাগিয়েছেন হরেক রকমের গাছ। প্রায় চল্লিশ বছর ধরেই এই 'পাগলামী' সামাদের নিত্যসঙ্গী ছিল, শেষ ত্রিশ বছরে দিনে অন্তত একটি গাছ লাগাননি, এমনটা হয়নি কখনও।
ফরিদপুর শহরতলীর ভজনডাঙ্গা গ্রাম, সেখানেই থাকতেন শেখ সামাদ। রিক্সা চালিয়ে সারাদিনে অল্প ক'টা টাকাই উপার্জন করতেন মানুষটা, সেই টাকার বড় একটা অংশ চলে যেত গাছ কেনা আর পরিচর্যার পেছনে। রিক্সা চালানোর ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে ফিরতেন এলাকার কোথায় কোথায় গাছ লাগানোর মতো ফাঁকা জায়গা আছে। জায়গা পছন্দ হলেই ছুটতেন নার্সারীতে। মাঠ-ঘাট-কবরস্থান-শ্মশ্মান থেকে শুরু করে রাস্তার ধার পুকুর পাড় কোথায় নেই সামাদের লাগানো গাছের সারি! বন বিভাগের লাগানো গাছগুলোর পাশে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সামাদের লাগানো গাছ।
মূলত ফলজ আর ঔষধি গাছই রোপন করতেন সামাদ শেখ, সবচেয়ে বেশী লাগিয়েছেন কাঁঠাল গাছ। জীবদ্দশায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার গাছ তিনি লাগিয়েছেন নিজের হাতে। নিজের লাগানো গাছগুলোকে কেউ পরিচর্যা করছে দেখলে ভীষণ খুশী হতেন। অনেকের ব্যক্তিগত জায়গাতেও তাদের অনুমতি নিয়ে গাছ লাগিয়েছেন সামাদ। শুধু ফরিদপুর সদরই নয়, পাশের এলাকা চরভদ্রাসন, সদরপুর, মধুখালী, এমনকি রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য বৃক্ষরোপণ করেছেন তিনি। ফরিদপুর-চরভদ্রাসন সড়কের দুপাশে এখন শুধু সবুজের মেলা, সেটার একক কৃতিত্ব তো সামাদ শেখ নামের মানুষটার।
সামাদের কাজ নিয়ে গর্ব ছিল স্ত্রীর, আবার অপ্রাপ্তির হাহাকারও ছিল নিত্যসঙ্গী। ঘরে খাবার আছে কি নেই, সেদিকে গৃহকর্তার মনোযোগ থাকতো না কখনোই, মানুষটা পড়ে থাকতেন তার গাছগাছড়া নিয়ে, হাতে টাকা এলেই ছুটতেন নার্সারীতে। ঘরে চাল লাগবে না তেল লাগবে সেসবের খবর নেয়ার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না সামাদের। সংসার সামলেছেন স্ত্রী ঝর্ণা বেগমই। মাটি কেটে রোজগার করেছেন, দুই ছেলে, স্বামী আর নিজের পেটের অন্নের যোগান দিয়েছেন দিনের পর দিন। ঝর্ণা বেগম আর কী'ইবা করতে পারেন, তাঁর স্বামীর সবটুকু ভালোবাসা তো সবুজ বাংলাদেশের জন্য সংরক্ষিত ছিল!
সামাদের এই কার্যক্রম সাড়া জাগিয়েছে এলাকাজুড়েই। শুরুতে সবাই এটাকে পাগলামী ভাবলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে এলাকার মানুষজনের ধ্যানধারনা। তারা নিজেরাই সামাদের লাগানো গাছের যত্ন করেছেন, গাছে ফল ধরলে কেউবা নিজেই সেই ফলের একটা অংশ পৌঁছে দিয়েছেন সামাদের বাড়ীতে। সামাদের লাগানো গাছের সবুজ পাতায় ছেয়ে গেছে এলাকা, সেই গাছের ছায়ায় ঢেকেছে পথঘাট। পেশা ছিল রিক্সা চালানো, অথচ নার্সারী থেকে বাকী করতেও আপত্তি ছিল তাঁর।
বেশীরভাগ সময় নগদ টাকা দিয়েই কিনতেন গাছ। আর একেবারেই অপারগ হলে হাতে টাকা আসা মাত্রই শোধ করতেন গাছ কেনার টাকা। সামাদ শেখ মনে করতেন গাছ লাগানোটা পূণ্যের কাজ, এতে সওয়াব মেলে, মানুষের উপকার হয়। আর তাই সারাটা জীবন ধরে ছুটেছেন গাছ লাগানোর পেছনে। তাঁর লাগানো গাছে ফল ধরেছে, অন্ন যুগিয়েছে মানুষের। কিংবা ঔষধি গাছের ছালবাকল বা পাতা কারো চিকিৎসায় কাজে লেগেছে।
গাছপাগল এই মানুষটা না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন, নার্সারী থেকে চারা কিনে ফাঁকা জায়গা খুঁজে সেটা লাগাতে তাঁকে দেখা যাবে না আর। কিংবা নতুন লাগানো কোন চারাগাছের যত্ন নিতে নিয়ম করে ছুটে যাবেন না সামাদ। দেড় বছর আগে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। লিভারে টিউমার ধরা পড়ায় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ভর্তি হয়েছিলেন সেখানে, প্রিয় গাছগুলোর কাছে আর ফেরা হয়নি তার, নতুন করে গাছ লাগানো কিংবা জায়গা খুঁজে বেড়ানোর গল্পটাও ফুরিয়ে গেছে এর মধ্যে দিয়ে। চলে গেছেন সেই মানুষটা, নিজের চাইতে, দুনিয়ার যে কোন কিছুর চাইতে গাছ লাগানোর কাজটাকে বেশী ভালোবাসতেন যিনি!