কোনো কোনো দিন মন অবাধ্য হয়ে যায়, বশে থাকতে চায় না। তখন সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে হুট করে নিজেকে সারপ্রাইজ করার জন্য একটা সারপ্রাইজ উইকেন্ড ট্যুর তো দেয়াই যায়...
কয়েক সপ্তাহ টানা ব্যস্ততার পর যখন আর কোনো কিছুই ভাল লাগে না, তখন দরকার হয় একটা মাইন্ড রিফ্রেশিং ট্যুরের। কিন্তু, নাগরিক ব্যস্ততায় অনেক সময় ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেও বাতিল করতে হয়। কিন্তু, কিছু কিছু জায়গা থাকে ঘুরার যার জন্য কোনো পরিকল্পনা করতে হয় না। কোনো কোনো দিন মন অবাধ্য হয়ে যায়, বশে থাকতে চায় না। তখন সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে হুট করে নিজেকে সারপ্রাইজ করার জন্য একটা সারপ্রাইজ উইকেন্ড ট্যুর তো দেয়াই যায়। আগে থেকে কোনো পরিকল্পনার বালাই নেই, শুধু পকেটে অল্প কিছু টাকা থাকলেই হলো।
উইকেন্ড ট্যুর দেয়ার জন্য অনেক জায়গাই আছে। কিন্তু, এখন এই সিজনটায় কিছু কিছু জায়গা আছে যেখানে যাওয়ার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়, পরে গেলে জায়গাগুলোর আসল সৌন্দর্য পাওয়া যাবে না। বরিশালের উজিরপুরে শাপলা ফুলের সাতলা বিল তেমনই একটা জায়গা। এই সময়টা সাতলা বিল তার সেরা সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষা করে।
বরিশালে এমনিতেও আগে গিয়েছি। লঞ্চের একটা বড় যাত্রা, জলের উপর ভাসতে ভাসতে রাতের নদী উপভোগ করা, ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আনন্দের। সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত বরিশালের উদ্দেশ্যে কয়েকটা লঞ্চ ছেড়ে যায়। সদরঘাটে লঞ্চে চড়বার আগে খিচুড়ি কিনে নিলাম। রাতে লঞ্চেও খাওয়া যায়, তবে লঞ্চে দাম বেশি বলে বাইরে থেকে খাবার কিনে নেওয়া ভাল। যদিও খিচুড়ি কিনেছি, তবুও আমি জানি রাতে আবার ক্ষিদে লাগবে। লঞ্চের ফেরিওয়ালাদের বুট চানাচুর মাখা, ঝালমুড়ি, ডিম সিদ্ধ দিয়ে সেই ক্ষিদে মিটানো যাবে।
উইকেন্ড রিফ্রেশমেন্ট ট্যুরে যত হালকাভাবে যাওয়া যায় ততই ভাল। বাড়তি বোঝা রাখিনি। সাথে কোনো ব্যাগ ট্যাগ নেই৷ হাফ প্যান্ট, আর টি শার্ট পড়েই লঞ্চে চড়ে বসেছি। একবারে সামনের দিকে সার্চলাইটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মৌনতা পালন করছি। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগছে। অদ্ভুত প্রশান্তি লাগছে কেন যেনো! একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রাতের নদী দেখছি। ধীরে ধীরে আলোর শহর পেছনে ফেলে লঞ্চ বুড়িগঙ্গা ছাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ বাদেই নিচে ডেকে নামলাম চা খেতে। আমার এমনিতেও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। কেবিন ভাড়া নেয়া যেতো চাইলেই। কিন্তু ভাড়া নিলাম না কেবিন, কোথাও শুয়ে পড়বো যদি ঘুম পেয়ে যায়। এতো বড় লঞ্চে ঘুমানোর জায়গার অভাব হবে না। চায়ের কাপ দশ টাকা। এ দিকটায় বেশ ভীড়। চা খেতে খেতে ভাবছি, এই যে মানুষগুলো দিনের পর দিন এই লঞ্চেই থাকছে, খাচ্ছে, প্রতিদিন একবার এই নদীর উপর দিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে তারা কি এখন নদীর সৌন্দর্য ধরতে পারে, তারা কি লঞ্চে ভ্রমণের অনুভূতি আমার মতো পাচ্ছে? জিজ্ঞেস করলাম লঞ্চের একজনকে। তার হাসি মলিন। অন্য কোনো কাজ না পেয়ে এই লাইনে এসেছে সে। অনেক বড় একটা লাইফ লেসন পেলাম এই ঘটনায়। সৌন্দর্য খুব ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার, অভ্যস্থ হয়ে গেলে অনুভূতি ভোতা হয়ে যায়। আর তাছাড়া, আমাকে যা রোমাঞ্চিত করছে আরেকজনকে সেটাই নির্লিপ্ত বানিয়ে দিয়েছে। জীবন যেখানে যেরকম!
আকাশ পরিষ্কার। লঞ্চের একদম উপরের ছাদে উঠেছি মই দিয়ে। শুয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশ দেখছি। মনে হচ্ছে যা কিছু দুঃখ সব ভেসে যাচ্ছে আমার সাথে। মনটা খুব হালকা লাগছিল৷ মাথাটা হালকা দুলছে, একটা ঘোর লাগা সময়। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিচে নেমে আসলাম। আরেক দফা চা সিগারেট পোড়ানো হলো৷ এক গ্রুপ টুয়েন্টি নাইন খেলছে, আমি দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখছি। কয়েক রাউন্ড পর একজন উঠে চলে গেল। তার জায়গায় আমি বসে পড়লাম। সময়টা অসাধারণ কাটছিল।
ভোরের দিকে লঞ্চ ঘাট করা হলো বরিশাল লঞ্চ ঘাটে। বরিশাল লঞ্চ ঘাট থেকে বের হয়ে সাতলার বাজারে যাওয়ার জন্য ভাড়া করতে হবে মাহিন্দ্র। বাসেও যাওয়া যায়। তবে এত ভোরে বাস পাওয়াটা দুষ্কর। আবার দেরি করলে সাতলা বিলের রুপের মাহাত্ম্যটাও ঠিক ধরা পড়বে না। তাই মাহিন্দ্র নেয়া হলো। গ্রুপ করে যারা যাবেন তাদের জন্য মাহিদ্র বেশ ভাল অপশন। ৭/৮ জন একসাথে গেলে ভাড়া ভাগাভাগি করলে খরচ কমে আসবে অনেক। মাহিন্দ্র চালককে বলবেন ইচলাদি, উজিরপুর এই রুট ধরে যেতে, ভাড়া একটু বেশি নিলেও আপনার সময় বেঁচে যাবে অনেকটা। সকালের বরিশাল, একদম শান্ত স্নিগ্ধ। মাহিন্দ্রতে দুইধারের দৃশ্য যতটা দেখা যায় দেখে মন ভরিয়ে নিচ্ছি। আর এভাবেই কেটে গেল ঘন্টাখানেক সময়।
সাতলা বিলের কাছাকাছি চলে এসেছি। এখন নৌকা ভাড়া করতে হবে। ৬/৭ জন বসার মতো নৌকার ভাড়া ৫০০/৬০০ টাকার মতো নেয় তারা। এই সময়ে এসে এটাই এই বিলের মাঝিদের উপার্জনের উপায়। আপনাকে দরদাম করে নিতে হবে। তবে দাম যা’ই হোক, একবার নৌকায় চড়ে সাতলার বিল ভ্রমণ শুরু হলে আপনি ভাবতে শুরু করবেন অমূল্য একটা সময় পার করছেন আপনি! ছবি তুলার বাতিক থাকলে দুই নৌকা ভাড়া নেয় অনেকে। এক নৌকা থেকে আরেক নৌকার যাত্রীদের ছবি তোলা হয়। সাতলার বিল ছবি তোলার জন্য অপূর্ব সুন্দর জায়গা। এতো কালারফুল বৈচিত্র্যময়ী একটা জায়গা যে মনের ভেতরের জমে থাকা ক্ষোভ টোভ সব হারিয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি চলে আসে তাতে।
এই সাতলার বিলকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার সবচাইতে বড় শাপলার বিল। এমন কি, পুরো পৃথিবীতেই এর চেয়ে বড় শাপলার বিল আছে বলে মনে হয় না। মাত্র হাজার বারোশ টাকা খরচ করে সপ্তাহের শেষ দিনে সাতলা বিলে ঘুরে আসা স্বার্থক, গ্রামীণ পরিবেশ, নির্মল আবহাওয়া, প্রকৃতির অদ্ভুত সুন্দর কম্বিনেশন। আর সব মিলিয়ে সাতলার বিলে গিয়ে নৌকায় বসে চারধারের শাপলার মাঝে হারিয়ে যাওয়া- জীবনে সুখী হতে কি খুব বেশি কিছু লাগে?
যেহেতু খুব বেশি সকালে গিয়েছি সাতলার বিলে, তাই দুপুরের আগেই মোটামুটি শাপলার রাজ্য ঘোরা শেষ। চাইলে বাসে ফিরে আসা যেতো দিনে দিনে, কিন্তু বরিশাল শহরে ফিরে এসে শহরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যার পর লঞ্চ ঘাটে গেলাম। আর এভাবেই জলে ভাসা শাপলার দেশে মন সতেজ করে আসলাম, নিয়ে আসলাম আরো কিছুদিন বেঁচে থাকার রসদ..
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন