এই মানুষ দুইজন 'শিশুসদন' চালানোর জন্যে নিজেদের জমি দান করে দিয়েছেন। নিজেদের জমি বিক্রিও করেছেন। খাবারের জন্যে ভিক্ষে করেছেন। একপর্যায়ে এসে নিজেদের একমাত্র আবাসস্থলকেও বিক্রি করে দিয়ে হয়ে গিয়েছেন বাস্তুহারা...

শো-অফ, প্রচারের ও প্রসারের এ পৃথিবীতে আমাদের চারপাশে এখনও এমন সব মানুষ আছেন, যারা কেন যেন অন্যের জন্যে নিঃশেষে বিভাজ্য হতেও ভয় পান না। এও এক নেশা হয়তো। যে নেশায় সর্বস্ব খুইয়ে হলেও মানুষের উপকার করতে হবে। মানুষের জন্যে কাজ করে যেতে হবে। মাঝেমধ্যেই যখন এই মানুষগুলো সম্পর্কে জানি, ভেতর থেকে শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসে। মনে হয়, এরা আছে বলেই সবকিছু এখনো হয়তো নিয়মের মধ্যে চলছে। এরা আছে বলেই এখনো 'মানুষ' শব্দটি হয়তো ততটা কদর্য হয়ে যায়নি। আজকে জানাবো সেরকমই এক মানুষের গল্প। ভুল বললাম। জানাবো দুইজন মানুষের গল্প।

এই গল্প শুনতে হলে যেতে হবে সরেরহাট কল্যানী শিশু সদনে। রাজশাহী জেলার পঞ্চাশ কিলোমিটার পূর্বে বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের সরেরহাট গ্রামে এই শিশু সদনের অবস্থান। সোজা বাংলায় এটি একটি এতিমখানা। তবে শুধু এতিমখানা বললে ভুল হবে। এতিমখানার সাথে সাথে এটি বৃদ্ধাশ্রমও। যেখানে বর্তমানে  ১৮২ জন শিশু কিশোরের সাথে আছেন আশ্রয়হীন ৪৫ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও। সরেরহাট কল্যানী শিশু সদনের যাত্রা শুরু যে দুটি মানুষের মাধ্যমে, তাঁরা নিজেরাও থাকেন এই শিশু সদনে। সবাই যা খায়, তারাও তা খান। সবাই যা পড়ে, তারাও তাই পড়েন।

এই দুই মানুষের মধ্যে একজনের চেহারায় এখন অজস্র বলিরেখার আনাগোনা। মানুষটির নাম শামসুদ্দিন সরকার। যাকে এলাকাবাসী জানে 'শমেস ডাক্তার' নামে। তিনি একজন পল্লী চিকিৎসক। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধাও। একাত্তর সালে যুদ্ধ যখন শেষ হয়, রণাঙ্গন ছেড়ে নিজের গ্রামে এসে তখন তিনি দেখতে পান এক ভিন্ন চিত্র। তার সাথের অনেক সহযোদ্ধারাই তো শহিদ হয়েছেন রণাঙ্গনে। সেই প্রয়াত যোদ্ধাদের এতিম সন্তানেরা ফ্যালফ্যাল করে এসে তাকিয়ে আছে শমেস ডাক্তারের দিকে। শমেস ডাক্তার যেন অকুলপাথারে পড়লেন। এই বাচ্চাগুলোর জন্যে কিছু তো করা দরকার। কিন্তু কী করবেন তিনি? কী করার আছেই বা তার?

তিনি তখন তার স্ত্রী মেহেরুন্নাসার সাথে পরামর্শ করলেন। স্ত্রী মেহেরুন্নেসার পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ১২ শতাংশ জমি নিয়ে শুরু করলেন শিশু সদন বানানোর কাজ। প্রথমে ৫৬টি শিশু'কে নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। কিন্তু শুধু জমি আর টিনের চালার ঘর থাকলেই তো হবেনা। এই শিশুদের খাবার দরকার, শিক্ষা দরকার, চিকিৎসা দরকার। কীভাবে করা যাবে সব? শমেস ডাক্তার তখন  পল্লীচিকিৎসা শুরু করলেন। ডাক্তারি করে যা পেতেন সবই খরচ করতেন এই শিশু সদনের পেছনে। এরপরেও টাকায় হচ্ছিলো না। পরবর্তীতে নিজের সতেরো বিঘা জমি তিনি বিক্রি করে দেন শিশুসদনের খরচ চালানোর জন্যে। একপর্যায়ে এসে যে বাড়িতে তিনি থাকতেন স্ত্রী'কে নিয়ে, সেটিও বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর তিনি নিজে স্ত্রী'সহ এসে থাকা শুরু করেন এই শিশুসদনে।

২৩৫ জনের বড় পরিবার এখন এই শিশুসদন! 

তবে তাতেও সব খরচ মিটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছিলো না। এই শিশুদের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্যে শমেস ডাক্তারের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা জীবনের এক পর্যায়ে এসে ভিক্ষেও করেছেন। এভাবেই কায়ক্লেশে চলেছে সব। তারা কষ্ট করেছেন কিন্তু হার মানেননি। ধাক্কা খেয়ে, হড়কে গিয়ে, আবার সোজা হয়ে চলতে চলতে এখন এই শিশু সদনের মোট সদস্যসংখ্যা ২৩৫ জন! সরকারের কাছ থেকে বার্ষিক কিছু অনুদান আর স্থানীয় কিছু মানুষের সহায়তায় চলছে সরেরহাট কল্যানী শিশু নিকেতনের বর্তমান কাজ। শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০০ শিশু এসেছে এই শিশু নিকেতনে। যাদের মধ্যে অনেকেই এখন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, যারা চাকরী করছেন, ব্যবসা করছেন। সমাজে যাদের মধ্যে অনেকেই এখন বেশ প্রতিষ্ঠিত।

বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি'র সাম্প্রতিক পর্বে যখন এই দুই বৃদ্ধ মানুষের নিঃস্বার্থ ত্যাগের গল্পটুকু দেখছিলাম, কেন যেন ভেতর থেকে একপশলা শ্রদ্ধা চলে এলো। নিখাদ শ্রদ্ধা। পবিত্র শ্রদ্ধা। এই মানুষগুলোর থেকে আমরা কোনোদিন কিছু শিখবো কী না, আমি ঠিক জানিনা। তবে এই মানুষগুলোর জন্যেই নিজেকে মাঝেমধ্যে 'মানুষ' বলে পরিচয় দিতে ভালো লাগে। গর্ব হয়। ইত্যাদি এবং হানিফ সংকেতকে ধন্যবাদ, এমন মানুষগুলোকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার জন্য।

মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন সরকার ও তাঁর স্ত্রী মেহেরুন্নাসার জন্যে রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। স্রষ্টা আপনাদের শতায়ু করুক, এটাই প্রার্থণা।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন




 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা