একজন পুরুষের জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

যে পুরুষ নিজেকে নির্ভরতার আশ্রয় হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যথাযথ প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে পুরুষ প্রমাণ করে চলেছে তারা সকলেই কোন না কোনভাবে বুকের ভেতর পুষে রাখে ভয়ঙ্কর ধর্ষকাম।
আমার একটা সমস্যা আছে। আমি তীব্র বীভৎস কিছু নিতে পারি না। বীভৎস কোন ছবি, নৃশংসতার কোন দৃশ্য, গল্প, সিনেমাও আমি নিতে পারি না। আমি রাজন নামের শিশুটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য কিংবা বিশ্বজিৎ নামের ছেলেটিকে কুপিয়ে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখতে পারি নি। আমি 'স', 'হোস্টেল' বা 'ফাইনাল ডেস্টিনেশন' নামের সিনেমাগুলোও দেখতে পারি না। আমার বুক ধরফর করে, গলা শুকিয়ে যায়। ওঅর মুভির বীভৎস দৃশ্যগুলোও আমি স্কিপ করে করে দেখি।
ছোটবেলায় আমার দাদী আমাকে মুরগীর কলিজা খেতে দিতেন না। তার ধারণা ছিল মুরগীর কলিজা খেলে আমার কলিজা হয়ে যাবে মুরগীর মতন ছোট। সেই ছোট কলিজা নিয়ে আমি দুঃসাহসী কিছু করতে পারব না। কঠিন কিছুর মুখোমুখি হতে পারব না, আমার ভয় করবে, বুক ধরফর করবে, গলা শুকিয়ে আসবে। সমস্যা হচ্ছে দাদীর চেষ্টা কাজে লাগে নি। আমার ভয় কমে নি, বরং বেড়েছে। আমি বেড়ে উঠেছি ভীতু মানুষ হয়ে। আমি আজকালকার বেশিরভাগ জিনিষই নিতে পারি না। ভেতরে ভেতরে ভয়ে সঙ্কুচিত হয়ে যাই। আমি ধর্ষণ শব্দটাও নিতে পারি না। আমার শরীর গুলিয়ে ওঠে। বমি পায়। এই শব্দটা আমি শুনতে পারি না। পড়তে পারি না। রেডিও টিভি'র ধর্ষণ সংক্রান্ত সংবাদ আমি শুনতে পারি না। উঠে চলে যাই, বা চ্যানেল বদলে দেই। পত্রিকার নিউজও পড়তে পারি না।
এটি কী এক ধরণের ফোবিয়া? এই ফোবিয়ার নাম কি? সকল ধরণের ভীতিরই টার্ম আছে, এই ভীতির টার্ম কী? সকল ধরণের ভীতির যেমন টার্ম আছে, প্রীতিরও নিশ্চয়ই টার্ম রয়েছে। আচ্ছা, ধর্ষণ প্রীতির কী কোন টার্ম রয়েছে? ধরুন যারা শুধুমাত্র ধর্ষণের খবর জানার জন্য বা শোনার জন্য এই সংক্রান্ত খবর শুধু পড়ে বা শোনেই না। বরং এই খবর পাঠের সময়ে এক ধরণের বিকৃত যৌন আনন্দ লাভ করে? কথাটা কী আপত্তিকর হয়ে গেল!
না আপত্তিকর হয় নি! এইধরনের লোকজন রয়েছে। আমাদের আশেপাশেই রয়েছে। শুনেছি, ধর্ষণ মামলাগুলোতে উকিল যখন জেরা করেন, সেইসকল জেরাজুড়ে অপ্রাসঙ্গিক বিকৃত রুচির যৌন সুড়সুড়িমুলক প্রশ্ন থাকে! একজন ধর্ষিতা নারী, এই প্রক্রিয়ায় আবারও ধর্ষিত হন! বারবার! বারবার! এই প্রসঙ্গের মানে কী? মানে আছে। মানে এই যে ধর্ষণ, এই বিষয়টিকে কি আমরা নানান উপায়ে লালন করে আসছি কি না! সেদিন এক মেয়ের সাথে কথা হচ্ছিল, সে নানান প্রসঙ্গে তার বাবার প্রশংসা করছিল। জগতের আর সকল পুরুষের নানান দোষের কথা বলছিল। আমি তাকে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে বললাম, 'ধরুন যদি এমন হয়, আপনার বাবা, ঠিক আপনার বয়সি কোন একটি মেয়ের শরীরে বাসের ভিড়ে হাত দেয়!' মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে উঠে বলল, 'ইউ ইন্সেইন! ইউ ম্যাড! হাউ ডেয়ার ইউ আর! আমার বাবাকে নিয়ে!' আমি হাসলাম।
হেসে বললাম, 'বিবিসি'র বা কাদের (স্পষ্ট মনে নেই) একটা গবেষণা প্রতিবেদন দেখলাম, ঢাকা শহরে বাসে যে পরিমাণ যৌন নিগ্রহের ঘটনা ঘটে, তার শতকরা ৭৩ ভাগ বা তারও বেশি ঘটে চল্লিশোর্ধ পুরুষের দ্বারা! তো আপনার বাবার বয়স আমার জানা মতে চল্লিশের বেশিই'। মেয়েটা এবারও চেঁচাল। আমি বললাম, 'চেঁচানোর কিছু নেই। আমার কথা শুনুন। এই যে এতো এতো পুরুষ, এই নিগ্রহে যুক্ত, এরা কী কারো বাবা নন? কারো ভাই নন? কারো সন্তান নন? নিশ্চয়ই তাদেরও আপনার মত কন্যা রয়েছে। যেই কন্যার কাছে তিনি ফেরেশতা তুল্য। যে বোনের কাছে তার ভাই, বাবা মায়ের কাছে তার সন্তান দুধের বাচ্চা, নিরাপদ আশ্রয়, নিরীহ শিশু, তাহলে? তাহলে তারাও তাদের বাবা, সন্তান, ভাই, স্বামীকে আপনার মতই ভালোবাসে, আপনার মতই ভাবে, তার বাবা জগতের শ্রেষ্ঠতম বাবা, কারো ভাই, জগতের শ্রেষ্ঠতম ভাই, কারো সন্তান জগতের নিস্পাপতম সন্তান! তাহলে?'
মেয়েটি এবার চুপ করে রইল। আমিও। তবে আমার ভাবনারা চুপ করে রইল না। তনু নামে মেয়েটির সংবাদটি যেদিন দেখেছিলাম, সারা শরীর ভয়ে, আতংকে, কষ্টে আড়ষ্ট হয়ে ছিল। বারবার মেয়েটির মুখ ভেসে উঠছিল, ওই মুহূর্তের মুখ! কী তীব্র আতঙ্ক, কী তীব্র আর্তি, কী তীব্র কষ্ট নিয়ে মেয়েটা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। কাঁদছিল, হাত পা ছুঁড়ছিল। সবকিছু শেষে যখন তার গলা কাঁটা হচ্ছিল, তখন মেয়েটি কী করছিল? আর ওই মানুষগুলো? তারা কী করছিল? ওই তারা! কারো বাবা, কারো ভাই, কারো সন্তান ওই মানুষগুলো! কী করছিল? এক মুহূর্তের জন্য ভাবে নি, এই মেয়েটি তার মেয়ে হতে পারত, তার বোন হতে পারত, তার মা হতে পারত!

ঠিক এভাবেই তাদের জায়গায় অন্য কোন পুরুষ তার মা, বোন, সন্তানকে এভাবে ধর্ষণ শেষে গলা কেটে রেখে যেতে পারত! মনে পড়ে নি? এক মুহূর্তের জন্যও না? এক মুহূর্তের জন্যও না? তারা কী ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরে গিয়ে মা বলে কোন নারীকে ডেকেছে? বোনের সামনে দাঁড়িয়েছে? সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়েছে? স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে? সে ঘুমের ভেতর একবারও তনুর চিৎকার, তনুর ভয়ার্ত, আতঙ্কিত মুখ ভাসে নি? ভাত খেতে গিয়ে শরীর গুলিয়ে ওঠে নি! একবারও না? যদি না উঠে থাকে, তবে এটি নিশ্চিত! এমন মানুষে গিজগিজ করছে আপনারও চারপাশে। শুনেছি, সেদিন ১ বছর ৮ মাসের শিশুকে ধর্ষণ করতে গিয়েছিলেন একজন! তিন বছরের শিশু, আশি বছরের বৃদ্ধাও ধর্ষিত হয়েছে!
শুনেছেন? কেন এমন হচ্ছে? পোশাক ছোট বলে? বোরকা পরছেনা বলে? বোরকা কী? পোশাক কী? আব্রু? যদি সেটি আব্রু হয়, সেই আব্রু পুরুষের কেন নেই? পুরুষ কী কুকুর কিংবা মাংসাশী জানোয়ারের মতন? উন্মুক্ত মাংসপিণ্ড দেখলেই তার লোলুপ জিভ বেরিয়ে আসে, সে ছুটে আসবে হায়েনার মত? এই-ই সে? তাহলে এখানে কী তার? এই মানুষের পৃথিবীতে? এবারের বইমেলায় 'নিঃসঙ্গ নক্ষত্র' নামে এক বই লিখেছিলাম, সেই বইয়ের সমাপ্তি নিয়ে হাজারো মেয়ে পাঠকের অভিযোগ, এমন কেন হলো? এমন হয়? আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জবাব দেই নি। আমার বলতেই ইচ্ছে করেনি, হ্যাঁ, এমনই হয়, এমনই।
এমন বাস্তবতায় বসবাস করে আমার কোন কল্পিত, ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, ফুল পরি, নীল পরি, লাল পরিদের স্বপ্নপুরীর ফ্যান্টাসাইজড গল্প লিখতে ইচ্ছে হয় নি। ইচ্ছে হয় না। সেই বই পড়ে অনেক পুরুষই আমাকে বলেছেন, পুরুষ কী এমনই? আমি বলেছিলাম, আমি জানি না। তিনি বলেছিলেন, আমিতো এমন নই, আপনিওতো নন! আমি দীর্ঘসময় চুপ করে ছিলাম, আসলেই কী আমি কিংবা আমরা এমন নই? তাহলে অমন কারা? কোন সে পুরুষ? তারা কোথা থেকে আসে? তারপর আবার কোথায় মিলিয়ে যায়? অন্য কোন গ্রহ থেকে? অন্য কোথাও তাদের বসবাস? যদি তা-ই না হবে,তাহলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না কেন? সেই যে তনু, তনু কে যারা ওভাবে ধর্ষণ করলো, খুন করলো, এই যে দিন কয়েক আগের বিউটি, ধর্ষিতা হবার পরে বিচার চাইতে গিয়ে, মামলা করলো বলে এবার আবার ধর্ষিতা হলো, তারপর একদম খুন? কারা করলো?
আপনি, আমি, আমরা কেউই না হলে কারা? অন্য কোন গ্রহের পুরুষ? অন্য কোন পৃথিবীর পুরুষ? আমি জানি না! আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। একটা দেশ ক্রমশই এমন হয়ে যাবে কেন? কেন এমন হয়ে যাবে? কেন? আশেপাশে পুরুষরূপে কী রয়েছে! কারা রয়েছে? তারাও কেবল সুযোগের অপেক্ষায়, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার স্ত্রী, সন্তানও মুহূর্তে হয়ে উঠতে পারে একেকজন বিউটি কিংবা তনু। তারা সুযোগ পায় না বলে বাসে ট্রেনে, রাস্তায় শিষ কাটে, টোন করে, ফেসবুকে ইনবক্সে অশ্লীল ছবি পাঠায়। তারা অপেক্ষায় আপনার মতই ওঁত পেতে আছে! ধূর্ত নেকড়ের মতন ছিঁড়ে খুঁড়ে খাবার অপেক্ষায়। কিন্তু তনুদের তাতে লাভ কী?
সেইতো মেয়ে, মেয়ে শরীর! হ্যাঁ, শরীর! ওই মাংসের দলা শরীরটুকুইতো সব? আপনাকে মাংসাশী করে তোলে! তাহলে আর কী! হিংস্রমাংসাশী পশুর শরীরজুড়েও মাংসের খিদে। আপনার শরীরেও। তাহলে? জানি কোন তফাৎ নেই, একজন ধর্ষক আর হিংস্র মাংসাশী পশুতে। তাহলে বিচারে কেন তফাৎ থাকবে? বিচার চাই, বিচার! বিচারটাও হোক পশুর মতই, পাশবিক, জান্তব! মাংস খুবলে খাওয়া এইসব মাংসাশীপশুদের বিচারটাও হোক প্রকাশ্যে, ভয়ংকর যন্ত্রণায়, ভয়াবহ কষ্টের, আর্তনাদের। সেই বিচার মানুষ দেখুক, ভাবুক। ভেবে ভেবে নিজের ঘরে যে তনুরা রয়েছে তাদের জন্য বুকের ভেতর হাহাকার উঠুক। বোধ উঠুক। আর বোধ না উঠলে চোখের সামনের ওইসব জান্তব বিচার দেখে কেঁপে উঠুক ভয়ে! কিন্তু বিচারটা হয় না। কোন এক অদ্ভুত কারণে এই দেশে ধর্ষণের বিচারে তীব্র অনীহা। কেন? এই কারণটা আমার কাছে বোধগম্য নয়।
নাকি এই দেশে ধর্ষণ কোন অপরাধ নয়? যেখানে সামান্য চুরির জন্যও গ্রাম্য সালিস থেকে শুরু করে পাড়া মহল্ললায় বাসস্ট্যান্ডে, রাস্তায় গণধোলাইয়ে চোর ছিনতাইকারী মরে, সেখানে সেই গ্রাম্য সালিস থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ধর্ষকদের বাঁচানোর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখা যায়, কেন? নাকি আমরা পুরুষেরা সমাজের সকল পর্যায়েই বুকের ভেতর চেপে রাখি একেকজন অবদমিত ধর্ষক? আমি জানি না। এ এক বীভৎস রহস্য। না হলে তনু হত্যার, ধর্ষণের ভয়াবহ শাস্তি হত, বিচার হত, সেই বিচার এমন হত যে বনানীর রেইন্ট্রি হোটেলে সাফাত-নাঈমদের মত ধর্ষকদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত আরেকটি ধর্ষণের কথা ভাবতে! বিউটির লাশ অমন সবুজ ঘাসের ওপর স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের সত্যিকারের মানচিত্র এঁকে দিতে পারত না! হায় বিচার! রেললাইনের ট্রেনের চাকার নিচে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়া পিতা ও কন্যার লাশের বোবা কান্না হয়েই থাকবে।
কারণ কন্যার বাবারা এখানে অসহায়, তারা এখানে কন্যার ধর্ষণের বিচার পাননা বলে কন্যাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দেন। আর পুত্র সন্তানের বাবারা? তারা কী করেন? তারা ধর্ষক সাফাতের বাবা দিলদার হোসেনের মতন হয়ে যান? নির্বিকার, আয়েশি, কিংবা তারা বুকে, মগজে পুষে রাখেন ধর্ষকাম? তাদের জিভও সুযোগের অপেক্ষায় লকলক করে? কে জানে? নিশ্চয়ই করে। কিন্তু তারা সকলেই কী কেবলই পুত্রসন্তানের পিতা? তাদের কারোরই কী কন্যা নেই? স্ত্রী নেই? স্নেহ, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসার কোন নারী নেই? নাকি তাদের ভেতরের অবদমিত লালসা ছড়িয়ে থাকে সর্বত্র, সকল নারীতেই।
নারী মানেই শরীর কেবল, সেখানে মায়া নেই, ভালোবাসা নেই, স্নেহ, শ্রদ্ধা নেই, যা আছে, তার নাম লালসা আর কাম কেবল, আর কেবলই সুযোগের অপেক্ষা? কে জানে কী! তবে পৃথিবীর সকল বাবা জানুক, সকল স্বামী জানুক, সকল ভাই জানুক, সকল পুত্রসন্তান জানুক, তাদের মায়েরা, মেয়েরা, বোনেরা, স্ত্রীরাও তাদের ভয় পায়, তীব্র ভয়, আতঙ্ক। তারা তাকে সন্তান, ভাই, স্বামী এমনকি মানুষ ভাবার আগেও ভাবে একজন পুরুষ। কেমন পুরুষ? ধর্ষক পুরুষ। যে পুরুষ নিজেকে নির্ভরতার আশ্রয় হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যথাযথ প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যে পুরুষ প্রমাণ করে চলেছে তারা সকলেই কোন না কোনভাবে বুকের ভেতর পুষে রাখে ভয়ঙ্কর ধর্ষকাম। পুরুষের জন্য এর চেয়ে লজ্জার আর কী আছে!