এ এক অবিশ্বাস্য জীবনযুদ্ধের গল্প! ক'টা টাকার জন্য নিজেদের পিষে ফেলছি, জীবন থেকে আনন্দগুলো পাঠিয়ে দিচ্ছি নির্বাসনে! অথচ একটা মানুষ তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তা জেনেও কি মমতা নিয়ে ভালোবাসছে নিজের জীবনকে! কীভাবে সম্ভব?

১৯৯৫ সাল। বয়স তখন কতই হবে আর! মাগুরার কুমার নদের তীর ধরে হেঁটে যায় একটি ছেলে। তার নাম শাহীন রেজা রাসেল। প্রকৃতির সৌন্দর্য ভীষণরকম আকর্ষণ করে তাকে। এই নদী, এই চিরচেনা বৃষ্টির অবিরাম ধারা, ঝির ঝির বাতাস, আকাশে ভেসে বেড়ানো কিছু পাখি, পাতালের সবুজ পল্লবের জামা গাঁয়ে দেয়া বৃক্ষগুলো বড় আপন তার। বড় মায়া করেন এগুলোকে। 

ক্লাস ফাইভে থাকতে বন্ধু পল্লবকে নিয়ে একটা বার্ড ক্লাব করেছিলেন। দুই বন্ধু মিলে বাইনোকুলার নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। সেটি দিয়েই গ্রামের সবুজ গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ঝোপে ঝাড়ে জঙ্গলায় পাখি দেখে বেড়াতেন। ঐ সময়েই তিনি রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি, লালন সাঁইজির আখড়া, ষাট গম্বুজ মসজিদ, সুন্দরবন ঘুরে এসেছেন। 

একটা ফিনিক্স সাইকেল ছিল তার। মাইলের পর মাইল ফিনিক্স ছুটে চলতো। চষে বেড়াতেন তেপান্তরের মাঠ। ৩০-৩৫ কিলো পেরিয়ে মাগুরা থেকে রাজবাড়িতে চলে যেতেন মীর মশাররফ হোসেনের কবর দেখতে। ভ্রমণ ছিলো নেশার মতো তার কাছে। এ বড় স্বাস্থ্যকর নেশা। আচ্ছা, ভ্রমণের প্রতি এই তীব্র ভালবাসা কীভাবে তৈরি হলো আপনার? জানতে চাইলাম তার কাছে।

ছোটবেলা থেকেই আমি একটু অন্যরকম ছিলাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি নানা ধরণের বই পড়তাম। তার মধ্যে ছোটদের উপযোগী ভ্রমণের বইও থাকতো। ফুল পাখি নদী আর গাছপালার প্রতিও অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করতো। নদীর পাড় ধরে হাটতে খুব ভালো লাগতো শৈশব কৈশোরে। আম্মা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষক সমিতির শিক্ষাসফরে সেই ছোটবেলা থেকেই অংশ নিতাম। এভাবেই ভ্রমণের প্রতি তীব্র ভালবাসা তৈরি হয়ে যায়।

প্রকৃতির সন্তানের সবচেয়ে বড় লড়াই বোধহয় প্রকৃতির সাথেই। পৃথিবীতে কত কোটি মানুষ। যাদের কত রকমের নেশা। কিন্তু স্রেফ ঘোরার নেশা কয়জনের! শাহীন রেজা রাসেল বিরল এই নেশা পেয়েছিলেন। সাথে পেয়েছিলেন প্রকৃতির দেয়া অদ্ভুত এক রোগ। ক্লাস নাইনে থাকতে শরীরটায় বাসা বাঁধল “বেকার মাসকুলার ডিসট্রফি” নামক ভয়াবহ এক অসুখ। কোথাও চিকিৎসা করে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা কী। তখন ভারতের প্রখ্যাত নিউরোলজিস্ট ডাক্তার অভিজিৎ চ্যাটার্জী তাকে ডেকে বললেন,

যদিও তুমি এখনো অনেক ছোট। তবু সত্যটা তোমাকে বলতেই হবে। তোমার শরীরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আস্তে আস্তে অকার্যকর হয়ে যাবে। প্রথমে আক্রান্ত হয়েছে তোমার পা, এখনো কোন উপসর্গ দেখা না দিলেও আস্তে আস্তে তোমার পায়ের শক্তি কমে যাবে, তুমি আগামী ১০ বছর পর সম্পূর্ণ পঙ্গু হয়ে যাবা, তারপর শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়াবে এটা। ঘটনাটা খুব ধীরে ধীরে ঘটবে। পৃথিবীর কোথাও এর কোনো চিকিৎসা নেই। মানসিকভাবে তোমাকে প্রচন্ড শক্ত হতে হবে।

তারপর একটা বছর অসহায়ের মতো শুধু চিন্তাই করে গেলেন রাসেল। কী করবেন? করবেনটা কী? কিন্তু তারপর অনেক ভেবে টেবে নিজেকে শুধালেন, আমি আমার এই অসুখের সাথে যুদ্ধ করবো। পঙ্গুত্বকে মানসিক শক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখবো যতদিন পারি। আর পঙ্গু হবার আগেই সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরে দেখবো। যে মানুষটাকে শুনতে হলো দশ বছর পর তাকে হুইলচেয়ারে বসে থাকতে হবে, সে হতাশ না হয়ে এই দশটা বছর অন্তত উপভোগ করার চিন্তা করলো। নতুন জীবন শুরু হলো তার।

যখন শুনলেন- দশ বছর পর তাকে হুইলচেয়ারে বসে থাকতে হবে, তিনি হতাশ না হয়ে এই দশটা বছর উপভোগ করার চিন্তা করলেন

জীবনকে উদযাপন করতে ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা, সাইক্লিং, মোটরবাইকিং, নদীতে সাঁতার কাটা, ভ্রমন, লেখালেখিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরলেন। সাথে পড়ালেখাটাও বেশ চালিয়ে নিচ্ছেন। 

২০০৬ সালের কথা। শাহীন রেজা রাসেল ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, তখনকার সময়ে এডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষের সংখ্যা এতটা বেশি ছিলো না। পর্যটনের অবস্থাও এখনকার মতো ছিলো না। তিনি তখন যাযাবর নামে একটি ভ্রমণের দল করলেন। সুযোগ পেলেই দলটাকে নিয়ে দেশের নানান প্রান্তে ঘুরতে চলে যেতেন। বাংলাদেশে সব জায়গাই রাসেলের চোখে ভিন্ন ভিন্নভাবে সুন্দর। তবে ছেড়াদ্বীপ আর টাঙ্গুয়ার হাওড় তাকে সবচেয়ে বেশি টানে।  

ট্যুর করতে গিয়ে কতশত অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। এক সন্ধ্যায় গারো পাহাড় সংলগ্ন শেরপুরের নালিতা বাড়ির এক প্রত্যন্ত গ্রামে আটকা পড়েন রাসেলরা। বুনো হাতি দেখার লোভে গিয়েছিলেন সেখানে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ায় সেখান থেকে ফেরার কোন বাহন পাওয়া যায় না। আবার রাস্তায় হাঁটতেও সাহস হচ্ছে না। এই বুঝি বুনোহাতিরা দল বেঁধে আসে এই ভয়ে।

তখন, এক অবস্থাপন্ন কৃষক পরিবারের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন তারা। পরিবার প্রধান তাদের আশ্রয় দেন। তাদের জন্য রাতে জাল ফেলে পুকুর থেকে বিশাল আকৃতির মাছ ধরা হলো। রান্না করা হলো প্রায় ১০-১২ টি পদ। এমন আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেন সবাই। গ্রামের কৌতূহলী অনেক মানুষ এলো তাদের সাথে পরিচিত হতে। সেই রাতে রাসেলরা গ্রামের সেইসব মানুষদের মুখে শুনলেন বুনো হাতির নানা গল্প। আড্ডা, গান, পাহাড় আর বনের লোমর্হষক নানা গল্পে স্বপ্নের মতো একটা রাত ছিলো সেদিন।

কিন্তু কি আশ্চর্য! সকালে যখন গ্রাম ছেড়ে তারা চলে আসেন তখন গ্রাম থেকে কয়েকশ মানুষ তাদের ৬ জনকে বিদায় দিতে আসে। ভালো লাগায় ভরে যায় বুকটা। এমন কতবার কত বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা হয়েছে রাসেলের, সেসব দিয়ে চাইলে বেশ কয়েকটি বই লিখে ফেলা যায়। তিনি বলেন,

মানুষের জীবনটা খুব ছোট, অথচ সারা পৃথিবীজুড়ে দেখার মতো কত বিস্ময় ছড়িয়ে আছে। এক জীবনে তার সব দেখা সম্ভব না। কিন্তু যতটা পারা সম্ভব তা দেখা উচিত প্রতিটি মানুষের।
২০১৬ সালের শেষ দিকে এসে তাকে হুইলচেয়ার ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে

**** ডাক্তারের হিসেবেমতে তাকে হুইলচেয়ার নিতে হতো ২০০৯ সালেই। কিন্তু শুধু ইচ্ছা শক্তি আর নিজের সাথে যুদ্ধ করে তিনি সময়টাকে দীর্ঘায়িত করতে পেরেছেন। তবুও হুইলচেয়ার তাকে নিতে হয়েছে। ২০১৬ সালের শেষ দিকে এসে এই ভ্রমণ পাগল মানুষটার হুইলচেয়ার ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। তবুও নেশাটা ছাড়তে পারেননি। এবছর এপ্রিলেও ৮ দিনের সফরে গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও কুয়াকাটায় গিয়ে ঘুরে এসেছেন। কেমন ছিলো সে যাত্রা?

“আমার স্ত্রী, ছোটভাই, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো ৩ জন কাছের ছোটভাই ছিল আমার সফরসঙ্গী। ওদের সাহায্য ছাড়া এ ভ্রমণ সম্ভব ছিল না। কুয়াকাটায় তো এর আগেও দুবার গিয়েছি। কিন্তু তখন পায়ে হেঁটে গেছিলাম। আর এবার হুইল চেয়ারে। বালিয়াড়ি ঠে লেহুইল চেয়ার নিয়ে সমুদ্র ছুঁতে পারাটা বেশ সংগ্রামের। সে সংগ্রাম করতে আপত্তি নেই। কিন্তু দুঃখ পাই একটা কথা ভেবে যে, বাংলাদেশের কোন পর্যটনস্পট, রেস্ট হাউজ, হোটেল, যানবাহন কোনো কিছুই শারীরিকভাবে অসুবিধাগ্রস্থদের জন্য প্রবেশগম্য নয়। বিষয়টা নিয়ে কেউ হয়তো ওভাবে ভাবেও না। সমাজের ধারণা, প্রতিবন্ধীদের আবার ট্রাভেলিং কিসের?”

মানুষটার জীবনের গল্প যেরকম মুগ্ধ করেছে, একইরকম মুগ্ধতা ছুঁয়ে গিয়েছে তার স্বপ্নগাঁথা শুনেও। তিনি বলেন,

হুইল চেয়ারে বসার আগে আমি বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষ করতে পারিনি। ৫৪টি জেলা শেষ করেছি। আরো ১০টি বাকি। সেগুলিও শেষ করবো। আর ভ্রমণ থামবে না। পায়ের উপর ভর করে যে ভ্রমণের শুরু তা এখন চলছে হুইলচেয়ারে। অ্যাম্বুলেন্স বা স্ট্রেচারে গিয়েও সে ভ্রমন চলবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডাক্তার আমাকে বলেছেন আমার আয়ু চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী আর ৫ বছর। আমি বলেছি, বাহ্ অনেক সময়। আরো কিছু জায়গা ঘোরা যাবে। একটা সুপ্ত ইচ্ছে আছে, জানি না পূরণ হবে কিনা। সুযোগ পেলে মরার আগে হুইলচেয়ারে বিশ্বভ্রমণ করবো।

তবে ভ্রমণের সময় প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা তৈরীর কাজটাও করে যাবেন বিশ্বজুড়ে। সারা বিশ্বের হেরে যাওয়া হতাশ মানুষদের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে কাজ করে যাওয়ার স্বপ্ন যে তার!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা