শহীদ মতিউর রহমান: ষোলো বছরের অকুতোভয় এক বঙ্গশার্দুল!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
"মাগো, মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি মা, মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়ে গেছে। ইতি- মতিউর রহমান, দশম শ্রেণি, নবকুমার ইনস্টিটিউট।"
রাজপথে নামলেই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু। তবু সেসব তুচ্ছ করে রাজপথ উত্তাল। মৃত্যুর পর যেন পরিবার লাশ খুঁজে পায় বা নিহতের পরিচয় পাওয়া যায় তাই ছাত্ররা পকেটে নিজের নাম ঠিকানা লিখে রাখে। আর ছেলেটির বুকপকেটে চিরকুট- ‘মাগো, মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি মা, মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের জন্য জীবন দিয়ে গেছে।’ ইতি— মতিউর রহমান, দশম শ্রেণি, নবকুমার ইনস্টিটিউট।
বলছি মতিউর রহমান নামের এক কিশোরের কথা। সময়টা ১৯৬৯। মাত্র ষোল বছর বয়সের কিশোর মতিউর তখন নবম শ্রেণি পাশ করে সবে দশম শ্রেণিতে উঠেছে। যে বয়সে কোন এক কিশোরির প্রেমে পড়ার কথা সেই বয়সে পুরোনো ঢাকার বকশিবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মতিউররের বুকের মধ্যে দেশপ্রেম।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা গেল আসাদ। সেই মৃত্যু স্পর্শ করে গেল মতিউরকে। আসাদ হত্যার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সারা দেশে তিন দিনের কর্মসূচি দিল। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশাল মিছিল আর ২৪ তারিখ ২টা পর্যন্ত হরতাল।
২৪ তারিখের সেই হরতালে উত্তাল রাজপথ। মিছিলের সামনে কিশোর মতিউর। পুলিশ বেপরোয়া। যত্রতত্র গুলি চলছিল। সেই গুলিতেই মিছিলের সামনে থাকা মতিউরসহ আরও চারজন নিহত হলেন। কিন্তু ১৬ বছরের এক কিশোরের মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দিল।
আসাদের মৃত্যুর পর ছাত্ররা রাজপথে নামলে পকেটে ঠিকানা লিখে নিয়ে আসত যাতে মৃত্যুর পর তাদের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়। শহীদ মতিউরের বুক পকেটে পাওয়া গেল চিরকুট। তবে তাতে ঠিকানা নয় নিখাদ দেশপ্রেম। তাতে লেখা, "মাগো, মিছিলে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি মা, মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য জীবন দিয়ে গেছে। ইতি- মতিউর রহমান, দশম শ্রেণি, নবকুমার ইনস্টিটিউট।"
মতিউরের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে ঢাকার মানুষ বিক্ষোভে নেমে আসে রাজপথে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। সেই আগুনে পুড়তে থাকলো দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিস,এমএনএ এনএ লস্করের বাড়ি।আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিশেষ আদালতের বিচারকের বাড়ীতে আক্রমন হলে বিচারপতি এস এ রহমান লুঙ্গি পরে প্রাণ নিয়ে পালালেন।
সরকার পরিস্থিতি শান্ত করতে বিকাল ৩টার পর সান্ধ্য আইনের সময়-সীমা ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু জনতা সেসব উপেক্ষা করে বানের স্রোতের মতো নেমে এলো রাজপথে। সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিউরের লাশ গেল তার মায়ের কাছে। এর আগে লাশ গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান জহরুল হক হলে।
সমবেত হাজারো ছাত্র-জনতার সামনে মতিউরের বাবা বলেছিলেন, ‘আমার ছেলে দেশের স্বাধিকার ও মুক্তির চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আমার চোখের সামনে। এক মতিউরকে হারিয়ে আমি হাজার মতিউরকে পেয়েছি! সেই দিন বেশি দূরে নয়, যখন এ দেশের ছাত্রসমাজই এই দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে।’
আমার বারবার মনে হয় বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে ষাটের দশকে। কী একটা দুর্দান্ত সময়! আসাদ মতিউরের রক্তের ধারা বেয়েই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান তুঙ্গস্পশী হলো। সত্যি সত্যি স্বাধীনতা এলো। শহীদ মতিউর ২০১৮ সালে পেলেন স্বাধীনতা পুরস্কার। কিশোর এই বীরের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। প্রকৃতির কী খেলা! ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারিতেই শহীদ হলেন তিনি। আর সেই থেকে ২৪ জানুয়ারি আমরা পালন করছি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস।
আজ সেই দিবস, মতিউরকে স্যালুট। শুভ সকাল মতিউর। শুভ সকাল বাংলাদেশ। যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে ততোদিন তোমরা থাকবে। থাকবে সেই অমর চিঠি যা পড়ে আমাদের চোখ ভিজে যাবে- "মাগো, মিছিলে যাচ্ছি। যদি ফিরে না আসি মনে কোরো তোমার ছেলে বাংলার মানুষের জন্য জীবন দিয়েছে। জয় বাংলা।"