এক 'হায়দার' সিনেমাতেই শহীদ যা করেছেন, সেটার পুনরাবৃত্তি বলিউডে আর কেউ করে দেখাতে পারবেন না কখনও। উড়তা পাঞ্জাবের ওই পাগলাটে গায়ক টমি সিং, কিংবা হাল আমলের কবীর সিং- এই চরিত্রগুলোতেও শহীদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

পঙ্কজ কাপুর আর নীলিমা আজিমের ছেলে তিনি, তাই সবার ধারণা সোনার চামচ মুখে দিয়ে বুঝি তার জন্ম। তার জীবনে বুঝি স্ট্রাগল নেই কোন, স্টারডম জিনিসটা বুঝি তিনি সঙ্গে করে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন! ব্যাপারটা মোটেও সেরকম কিছু ছিল না। শহীদ কাপুরকেও স্ট্রাগল করতে হয়েছে, সফলতার জন্যে নামতে হয়েছে সংগ্রামে, পাড়ি দিতে হয়েছে কণ্টকাকীর্ণ পথ। বাই বর্ন সুপারস্টার তিনি ছিলেন না, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পার হয়ে, যুদ্ধ জয় করেই আজকের অবস্থানে এসেছেন শহীদ কাপুর।

জন্ম দিল্লিতে, মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। তিন বছর যখন বয়স, তখন পঙ্কজ কাপুর এবং নীলিমার ডিভোর্স হয়ে গেল, পঙ্কজ চলে এলেন মুম্বাইতে, নতুন সম্পর্কে জড়ালেন, বিয়েও করলেন। দশ বছর বয়স পর্যন্ত দিল্লিতেই ছিলেন শহীদ, দাদার সঙ্গে তার দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল, দাদার খুব ন্যাওটা ছিলেন তিনি। সংসারে টাকা-পয়সার যোগান প্রায় বন্ধ, শহীদের হাত ধরে মা নীলিমা চলে এলেন মুম্বাইতে, কাজের খোঁজে। থিয়েটারে অভিনয় করতেন নীলিমা, নাচেও পারদর্শী ছিলেন, কিন্ত দিল্লিতে থিয়েটার করে সংসার চালানোর মতো টাকা আয় করার অবস্থা ছিল না। সেজন্যেই মুম্বাই গমন, এক রুমের ছোট্ট একটা ঘরে শুরু হলো জীবনের অন্যরকম একটা অধ্যায়।

নীলিমা এরইমধ্যে বিয়ে করেছেন আবার, অভিনয় আর নাচটাও চালিয়ে যাচ্ছেন। ছোট্ট শহীদ মজলেন নাচে, মাইকেল জ্যাকসনের গানের তালে তালে তাকে অনুকরণের চেষ্টা করেন তিনি। ক্লাসে বিরতির সময়টায় সহপাঠীদের নিজের নাচ দেখান, ছেলে-মেয়েরা গোল হয়ে ঘিরে ধরে তাকে, মাঝখানে ছোট্ট জায়গা নিয়ে এক মনে নেচে চলেন শহীদ। গল্পগুলো শুনতে হয়তো ভীষণ সমতল লাগে, কিন্ত সেই জার্নিটা ছিল বন্ধুর পথে। স্কুলে টিফিন নেয়ার বিলাসিতাও করতে পারতেন না একটা সময়ে, পকেট পড়ে থাকতো ফাঁকা। সপ্তাহে দু'দি হাতখরচা পাওয়া গেলে বাকি চারদিন হাত থাকতো খালি। 

ঐশ্বরিয়ার পেছনে এই ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সারকে চেনা যাচ্ছে?

সামান্য সেই হাতখরচের টাকা থেকেই অল্প কিছু জমিয়ে নাচের ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেলেন শহীদ। তার যে ইন্সট্রাক্টর ছিলেন। তিনি আবার বেশ নামীদামী লোক, বলিউডি ফিল্মে কোরিওগ্রাফির ডাক পান। শিয়ামক দাভার নামের সেই ভদ্রলোকের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন শহীদ, গুরুর কারণেই সুযোগ মিললো 'দিল তো পাগল হ্যায়' আর তাল সিনেমায়। সেখানে শহীদ ছিলেন ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার, নায়ক-নায়িকাদের পেছনে নেচেছেন, ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন হয়তো, কিন্ত কারো নজরে পড়েননি। তাল সিনেমার সেটে ঐশ্বরিয়া রাইকে সামনাসামনি দেখে থ হয়ে গিয়েছিলেন, নাচের স্টেপ ভুল হয়ে যাচ্ছিল বারবার। এরই ফাঁকে শাহরুখ, কাজল আর রানী মুখার্জীর সঙ্গে পেপসির বিজ্ঞাপনেও অভিনয় করেছেন, তবুও শিকে যেন ছিঁড়ছিল না ভাগ্যের। 

নাচ-গান-পড়ালেখা যাই করুন, দিনশেষে স্বপ্ন ছিল একটাই- সিনেমার নায়ক হওয়া। টুকটাক কাজ করে বেড়াচ্ছিলেন, কিন্ত লক্ষ্যের ধারেকাছে থাকা হচ্ছিল না। কয়েক জায়গায় অডিশনও দিয়েছেন, পাশ করতে পারেননি। হ্যাঁ, যে শহীদ কাপুরের 'চকলেট বয়' ইমেজের জন্যে মেয়েরা পাগল, সেই শহীদ কাপুরকেই বারবার বাতিলের খাতায় ফেলে দেয়া হয়েছে। কখনও চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয় বলে, কখনও বা নায়কসুলভ নন এই অজুহাতে! একটা মিউজিক ভিডিও করে প্রযোজক রমেশ তৌরানির নজরে পড়লেন, সেখান থেকেও রিজেক্ট হলেন বয়সের কারণে, রমেশ যে বয়সের নায়ক খুঁজছিলেন, শহীদের বয়স তার চেয়ে অনেকটাই কম ছিল। 

তবে শহীদকে ক্যারিয়ারের প্রথম বড়সড় ব্রেকটা রমেশ তৌরানিই দিয়েছিলেন। টিনেজ রোমান্স নিয়ে বানানো সিনেমায় নায়ক হিসেবে অভিষেক হয়েছিল শহীদের, সিনেমার নাম 'ইশক ভিশক'। প্রথম সিনেমাতেই বাজীমাত, নিজের দারুণ একটা ক্রেজ তৈরী করতে পেরেছিলেন শহীদ। সেই সময়ের তরুণ তরুণীদের চোখে হার্টথ্রবে পরিণত হতে মোটেও সময় লাগেনি তার, ফিল্মফেয়ারে সেরা নবাগত অভিনেতার পুরস্কারটাও সেই ইশক ভিশক দিয়েই জিতে নিয়েছিলেন শহীদ, সেই ২০০৩ সালেই তাকে ভাবা হচ্ছিল বলিউডের ভবিষ্যত হিসেবে। 

এখন ২০২০ সাল, বলিউডের জমিনে সতেরো বছর কাটিয়ে ফেলেছেন শহীদ কাপুর। তার পরে এসে তাকে ছাপিয়ে গেছেন অনেকেই, অথচ শহীদ কাপুরকে এখনও 'সুপারস্টার' বলা যায় কিনা- সেটা নিয়েই বিতর্ক হয়। কারণটা স্বাভাবিক, শুধু শহীদের নামের ওপরে সিনেমা চলবে, প্রযোজক বাজী ধর‍তে পারবেন- এমন অবস্থা তো শহীদ নিজেই তৈরী করতে পারেননি। নিজেকে ভেঙে গড়তে অনেক বছর লেগে গেছে তার, চকলেট বয় ইমেজটা ভাঙতে চাননি, টানা সিনেমা করে গেছেন সেই রোমান্টিক লুক নিয়েই। এক রসগোল্লা আর কাঁহাতক খাওয়া যায়? অমৃতেও তো অরুচি আসে একসময়! 

হায়দার সিনেমায় শহীদ যা করেছেন, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না

শহীদ কাপুরের ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ভিন্নধর্মী পাঁচটা সিনেমা খুঁজে বের করতেও কষ্ট হয়ে যাবে। জাব উই মেট, কামিনে, হায়দার, উড়তা পাঞ্জাব, তারপর কবীর সিং- এর আগে কেউ হয়তো ফিদা'র নামটাও যুক্ত করে দেবেন। এই পাঁচ-ছ'টার বাইরে বলার মতো কাজ শহীদ করতে পারেননি, এই ব্যর্থতার দায় তাকেই নিতে হবে। ২০১৪ সাল থেকে শহীদ ক্যারিয়ার নিয়ে যতোটা সিরিয়াস হয়েছেন, এই সিরিয়াসনেসটা আর পাঁচ বছর আগে এলেই হয়তো নামের পাশে দুটো ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড বেশি থাকতে পারতো। ক্যারিয়ারের প্রথম দশ বছর কাজের চেয়ে অনেক বেশি তিনি আলোচনায় থেকেছেন সম্পর্কের ভাঙা-গড়া নিয়ে। এই সময়টায় সিনেমার গল্পের ওপর ফোকাস করলেও লাভটা শহীদেরই হতো। 

সাফল্য-ব্যর্থতার এই খতিয়ানের ফাঁকে অবশ্য শহীদ কাপুরের অভিনয়প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না মোটেও। এক 'হায়দার' সিনেমাতেই তিনি যা করেছেন, সেটার পুনরাবৃত্তি বলিউডে আর কেউ করে দেখাতে পারবেন না কখনও। উড়তা পাঞ্জাবের ওই পাগলাটে গায়ক টমি সিং, কিংবা হাল আমলের কবীর সিং- এই চরিত্রগুলোতেও শহীদ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। রনবীর সিংয়ের সঙ্গে 'পদ্মাবত' সিনেমায় স্ক্রিন শেয়ার করেছেন, দুজনের টক্করে অনেকের কাছে শহীদের পারফরম্যান্সই ছিল তুলনামূলক ভালো! কাজেই ক্যারিয়ারে বৈচিত্র‍্য না আনার যে ব্যর্থতা, সেটার দায়ভার শহীদকেই নিতে হবে। 

দেরীতে হলেও শহীদ বুঝেছেন, ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে হলে, সেরাদের সেরা হতে হলে বৈচিত্র‍্যতার বিকল্প নেই। এই বোধটাই হয়তো আগামী বছরগুলোতে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ব্যাকগ্রাউন্ড ড্যান্সার সেই ছেলেটা, বারবার অডিশন দিয়ে বাদ পড়া সেই ছেলেটা, অথবা টিফিনে খাবার কেনার পয়সা না থাকায় বন্ধুদের নাচ দেখিয়ে সময় কাটানো ছেলেটার সাফল্য দেখলে আমাদের মনটা আর্দ্র হবে, পরিশ্রম আর একাগ্রতা যখন সফলতার মুখ দেখে, তখনই তো সবচেয়ে ভালো লাগার অনুভূতিটা হয়! 


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা