জেলখানায় বন্দী ছেলে বলে, "মা, ভাত খেতে ইচ্ছে করে। কালকে পারলে একটু ভাত নিয়ে এসো"। পরের দিন মা সকাল সকাল ভাত নিয়ে আবার দৌড়ে যান রমনা থানায়। কিন্তু ছেলে আর সেখানে নেই। মা ভাতের বাটি নিয়ে ফেরৎ আসেন। আহারে! আর কোনদিন ছেলেটার খোঁজ মেলেনি...
মুরগির মাংস, সাদা ভাত, আলুভর্তা, বেগুনভাজি- তালিকাটা ছিল কুখ্যাত রাজাকার, বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর শেষ খাবারের। কয়েক ঘন্টা পরেই ফাঁসিতে ঝুলতে যাচ্ছে এটা জানার পরেও সে কতটা তৃপ্তি করে ভাত খেতে পেরেছিল, তা জানার উপায় নেই। তবে নিজামীর ভাগ্য কিন্তু ভাল যে, অন্তত শেষ খাবারের ইচ্ছাটা তার কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী তাকে খেতেও দেয়া হয়েছিল।
এবার বলি আরেকটা ছেলের কথা। ভীষণ বড়লোকের ছেলে। ঝাঁ-চকচকে পোষাক-আশাক আর দামী গাড়ি করে স্কুলে আসে। বিটলস্, রোলিং স্টোনস্, ডুরস্ আর বব ডিলানের গান শোনে হরদম। সেই ১৯৬৯-৭০ সালে গীতাঞ্জলী থেকে একবারে ১২০০ টাকার গ্রামোফোন রেকর্ড কিনে ফেলার মতো শৌখিন বড়লোক! ধনীর ঘরের দুলাল আরকি।
যা হোক, ১৯৭১- এ সেই ছেলেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে পড়াশোনা লাটে উঠল। বাবা ঠিক করলেন ছেলেকে করাচী পাঠিয়ে দিবেন। কিন্তু ছেলেটা রাজী হয় না। সে যোগ দিল যুদ্ধে, ঢাকা শহরের ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য। বাড়িতে পরে রইল তার শখের রেকর্ডগুলো, গ্রামোফোন, জিন্সের প্যান্ট আর গিটার। একবেলা খেয়ে- না খেয়ে শহরের অলিগলিতে রেকি করে বেড়ায়, ঝট করে ঝুপঝাপ আক্রমণ করে আবার পালিয়ে বেড়ায়। থাকার ঠিক নেই, কাপড় চোপড়ের ঠিক নেই। যে ছেলে দামী বিছানার নরম তোষক ছাড়া কখনও শুয়ে দেখেনি, সে-ই আজ এক বাসার গ্যারেজে তো কাল আরেক জায়গায় মাটিতে ঘুমায়!
৭১ এর আগস্ট মাসের শেষ দিককার কথা। ছেলেটা ধরা পড়ে গেল! রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। ক্র্যাক প্ল্যাটুনের অন্য সদস্যদের খোঁজ বের করার জন্য চলল অমানুষিক অত্যাচার। ছেলে কোথায় আটক আছে সেই খবর অনেক কষ্টে বের করে মা দৌড়ে গেলেন রমনা থানায়। সারা শরীরে কালসিটে পড়া, আংগুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, রক্ত ঝরছে সেখান থেকে। আদরের ছেলের অবস্থা দেখে মায়ের বুক ফেটে যায়। ছেলে বলে, "মা, এরা অনেক মারে"। বুকে পাথর চেপে মা বলেন, "যতই মারুক, তুই অন্যদের কথা বলবি না"।
ফিরে আসার সময় ছেলে বলে, "মা, ভাত খেতে ইচ্ছে করে। কালকে পারলে একটু ভাত নিয়ে এসো"। পরের দিন মা সকাল সকাল ভাত নিয়ে আবার দৌড়ে যান রমনা থানায়। ভাত, মায়ের হাতের ধবধবে সাদা ভাত! কিন্তু ছেলে আর সেখানে নেই। মা ভাতের বাটি নিয়ে ফেরৎ আসেন। আহারে! আর কোনদিন ছেলেটার খোঁজ মেলেনি। নাম না জানা লাখ লাখ শহীদের মতো ছেলেটার দেহও মিশে গেছে এদেশের মাটিতে। কোথায় কে জানে!
সেই মা বেঁচে ছিলেন আরও ১৪ বছর। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একবারের জন্যও তিনি আর ভাত খাননি। যে ভাত আদরের ছেলেটাকে শেষবারের মতো খাওয়াতে পারেননি, সে ভাত আর মায়ের গলা দিয়ে নামে কীভাবে!
ছেলেটার নাম আজাদ। শহীদ রুমীদের ক্র্যাক প্ল্যাটুনের সদস্য মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। পরে জানা যায়, রমনা থানা থেকে আজাদকে নিয়ে যাওয়া হয় মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেইনিং কলেজে স্থাপিত টর্চার সেন্টারে। সেখানে অমানুষিক অত্যাচারে তিলে তিলে হত্যা করা হয় আজাদকে; সাথে রুমি, বদি, প্রখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদকে। সেদিন মোহাম্মদপুরের টর্চার সেন্টারের নেতা ছিল বদর বাহিনী প্রধান নিজামী, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রী হওয়া নিজামী!
তাইতো বলি নিজামীর ভাগ্য ভাল! ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীটা শেষ খাবারটা অন্তত: ইচ্ছামতো খেতে পেরেছিল! ভাত, সাদা সাদা নরম ভাত! সুপারহিরোর গল্প শুনতে Marvel কিংবা DC'র কমিকস্ পড়বার দরকার নেই। এরকম লক্ষ লক্ষ সুপারহিরোর গল্প আছে এদেশের প্রতিটা কোণায়, আকাশে-বাতাসে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন