মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফিয়া বেগম আর একটাবারের জন্যও ভাত মুখে তোলেননি। ১৪ বছর বেঁচে থাকার জন্য রুটি খেয়েছেন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটিও খেয়েছেন কখনও, কিন্তু ভাত না। তার আজাদ যে ভাত খেতে চেয়েও ভাত খেতে পায়নি…
আজাদ আলিয়াস মাগফার, ভালো নাম মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ। দুই নম্বর সেক্টরের আরবান গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলা। প্রতি বছর ঘুরে এই দিনটা আসে আর অসম্ভব সুদর্শন এক রাজপুত্রের জন্য আক্ষেপটা বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে।
ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে এদেশের একটা বড় জনগোষ্ঠী উল্লাসে ফেটে পড়ে। এদেশের অজস্র মানুষ মনে করে বাংলাদেশের জন্ম না হয়ে অখণ্ড পাকিস্তান থাকলেই নাকি ভালো হতো! অথচ ১৪টা বছর এক মা অপেক্ষায় ছিলেন, তার ছেলে ফিরে আসবে,যে ছেলেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানী সেনারা, জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা সেই মায়ের অপেক্ষার পালা ফুরোয়নি, কোন মধুর সমাপ্তি আসেনি। কিন্তু সাফিয়া বেগমের সেই অপেক্ষার কথা ক'জন জানে আজ? ক'জন মনে রেখেছে?
আজাদের বাবা ইউনুস চৌধুরীর উপর প্রচণ্ড রেগে আছেন সাফিয়া বেগম। টাটা কোম্পানির সাবেক ইঞ্জিনিয়ার ইউনুস চৌধুরী পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী বিজনেস ম্যাগনেট, ফলাফলে অবাধ নারীসঙ্গের চিরাচরিত স্খলনে সংসারে আগুন। শেষমেশ মাথার দিব্যি দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেলেন ইউনুস সাহেব। রাগ পড়ে যেতেই সাফিয়া বেগমের হঠাৎ খেয়াল হল, আজাদকে কি কাজের মেয়েগুলো মনে করে রাতে খাইয়েছে? নাহ, কাউকে দিয়ে আজকাল আর ভরসা নেই। মাছটা ছেলে খুব পছন্দ করে, কিন্তু মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারে না। কি অদ্ভুত কথা দেখো তো...
ভাবতে ভাবতেই আজাদের ঘরে উঁকি দেন তিনি, দেখেন হোম টাস্কের খাতার উপরই মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে ছেলেটা। “আজাদ, খেয়েছিস? ওঠ তো বাবা, একটু খাইয়ে দেই।'' ঘুমের দেশ থেকে উত্তর এলো, 'আরে খেয়েছি তো, এখন ঘুমাতে দাও...।' নিশ্চিত হতে পারেন না মা। আজাদের ফুলতোলা প্লেটে ভাত বেড়ে রুই মাছের দুটো টুকরো বাছতে বসেন। মাছ-ভাত সাজিয়ে ছেলের ঘরে ঢুকে দেয়ালে দুটো বালিশ ঠেস দিয়ে ছেলেকে তুলে বসান, 'দেখি বাবা, হাঁ করো তো”। আধো ঘুমের ঘোরে কোনোক্রমে ছেলের হাঁ করা মুখে ভাতের নলা পুরে দেন মা। ভাত গালে ছেলে আবার অতল ঘুমে তলিয়ে যায়। এইভাবে কয়েক গাল ভাত আর এক গেলাস পানি খাইয়ে তৃপ্ত হন মা, প্রশান্তি নেমে আসে তার হৃদয়ে...
মা, আমি এখানে ভালোই আছি। কিন্তু তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে একা থাকি বলেই কিনা মাঝে মাঝে প্রাণটা কেঁদে ওঠে। ঢাকায় থাকতে তোমার হাতে যে রোজই ভাত খেতাম, তা তো না। কিন্তু এই করাচিতে এসে ভাত জিনিসটা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে না পেয়ে হঠাৎ করেই হাহাকার বোধ হয়। ভাত খেতে অনেক দূরের এক হোটেলে যেতে হয় মা। মন মানে না। এখন মনে হয় তুমি যে ভাত রাঁধতে, তাতে টগবগ টগরবগর বলক ফুটতো, মাড়ের সুন্দর গন্ধ বেরোত, সেই গন্ধটাও কি অসাধারন ছিল। শুধু একটু ভাতের গন্ধ পাবার জন্যও মনটা ব্যাকুল হয় মা। এইখানে যাদের দেখি, কাউকেই আপন মনে হয় না। শুধু মনে হয় আমরা বাঙ্গালীরা এক জাতি, আর ওরা পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুঅলারা আরেক জাতি। মুসলমান হলেই জাতি এক হয় না।
নির্ঘুম রাতজুড়ে মনে মনে কত কথা সাজায় আজাদ। মাকে লিখবে বলে। সকালে তার কিছুই লেখা হয় না। মা যেন কোনভাবেই তার কষ্ট টের না পান, সেজন্য খুব সাবধানে ছোট্ট করে সে চিঠি লেখে। করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে আরও অনেকইন থাকতে হবে, বিএ –এমএ করতে হবে, এখনই মাকে টেনশনে ফেলা যাবে না।
“চাচি, আল্লাহর কাছে শোকর করেন। আমি আছি বইলাই আজাদড়ে ছাইড়া দেওয়ার একটা সুযোগ আইছে। উনারে ক্যাপ্টেন সাব পাঠাইছে। কি কয় মন দিয়া শুনেন।' সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পড়া আর্মি ছাটের কাটা চুলের মানুষটা সাফিয়া বেগমের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার গলার স্বরটা ততধিক ঠাণ্ডা শোনায়,
--আজাদের সাথে দেখা করতে চান?
--জি।
--ছেলেকে ছাড়ায়ে আনতে চান?
--জি!
--আজকে রাতে আজাদকে রমনা থানায় নিয়ে আসবে। দেখা করায়া দিব ওর সাথে। বুঝলেন?
--জি।
--তার সাথে দেখা করবেন। দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়। অস্ত্র কোথায় রেখেছে, তা বলে দেয়।
--জি?
--সে যদি সব বলে দেয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। ছেলেরে যদি ফিরে পাইতে চান, তারে সব বলতে বলবেন।
আজাদের মা লোকটার পাথুরে মুখের দিকে তাকান। তার চোখে নিঃস্পন্দ শুন্য দৃষ্টি...
গরাদের ওপারে দাড়িয়ে থাকা আজাদকে তার মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।
--'মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।'
--বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
--না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই...
--বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
--আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুই দিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
--আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।
সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। হায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে... এভাবে...
মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে পর দিন সারা রাত রমনা থানায় দাঁড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট-সব জায়গায় খুঁজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না। ক্র্যাকপ্লাটুনের বাকি সদস্যদের মতো আজাদকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাফিয়া বেগম আর একটাবারের জন্যও ভাত মুখে তোলেননি। বেঁচে থাকার জন্য রুটি খেয়েছেন, পানি দিয়ে ভিজিয়ে পাউরুটিও খেয়েছেন কখনও, কিন্তু ভাত না। তার আজাদ যে ভাত খেতে চেয়েও ভাত খেতে পায়নি... স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর আজ আজাদের মাকে রুপকথার চরিত্র বলে মনে হয়। পাকিস্তানের জয়ে উল্লসিত প্রজন্ম চিৎকার করে পাকিস্তানের জন্য শ্লোগান দেয়, অথচ আজাদের মা প্রতিটা মুহুর্ত কতটা যন্ত্রণা আর কষ্টে পার করেছেন, কেউ জানতে চায় না। সাফিয়া বেগম সন্তানের অপেক্ষায় ১৪ বছর অপেক্ষা করে রিক্ত হাতে শূন্য হৃদয়ে মারা গেলে আমাদের কি যায় আসে! তাই না?
লেখাটির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা আনিসুল হকের "মা" বইটিকে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন