গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা যদি কোনো শিল্প হয়, তবে সেই শিল্পের দ্য ভিঞ্চি হলেন শাহেদ করিম। বড় বড় সাংবাদিকদের সঙ্গে সখ্য ছিল তার, টেলিভিশন টকশোতে তাকে দেখা যেত নিয়মিত। কিন্ত শাহেদের উত্থানের পেছনে কি শুধু মিডিয়ায় দায়ী?

গণমাধ্যম, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এই তিনটি জিনিস যেকোনো দেশের অভিজাত শ্রেণীতেই কাউকে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের প্রেক্ষাপটে এই তিনের ভূমিকার ব্যাপকতা যে ঠিক কতটা, সে বিষয়ক গবেষণায় কেস স্টাডি হিসেবে খুব সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে শাহেদ করিমের উত্থানের বিষয়টি। তাছাড়া কেউ যদি চান উপরিউক্ত তিনের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে খুব বড় কিছুতে পরিণত হতে, তার জন্যও শাহেদ করিমের উদাহরণ বেশ কাজে লাগতে পারে। 

প্রথমে বলা যাক, গণমাধ্যমকে শাহেদ করিম কীভাবে ব্যবহার করেছেন। ২০১০ সাল থেকেই তিনি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টক-শোতে হাজির হতে থাকেন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে। তবে তার আলোচনার বিষয়বস্তু রাজনীতিকে ছাপিয়ে সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা মহাকাশ বিজ্ঞান পর্যন্তও গড়াত। তার জ্ঞানের পরিধি এতটাই বিস্তৃত।

২০১০ সাল থেকে নিজেকে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালালেও, শাহেদ করিমের ব্রেকআউট ইয়ার বলা চলে ২০১৫ সালকে। সে বছর ২৭ অক্টোবর থেকে তিনি যোগ দেন চ্যানেল আইয়ের বিখ্যাত অনুষ্ঠান তৃতীয় মাত্রায়। একই বছর অঞ্জন রায়ের উপস্থাপনায় একুশে টেলিভিশন ও গাজী টেলিভিশনে দুইটি টক শোতেও অংশ নিতে শুরু করেন তিনি। এছাড়া ওই একই বছরের ১১ মার্চ থেকে তিনি বের করেন দৈনিক নতুন কাগজ নামের একটি সংবাদপত্র। উত্তরা ও গুলশান এলাকার চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সাথে সখ্য গড়ে তুলে তিনি তাদেরকে এই সংবাদপত্রে চাকরি দিতেন। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল খ্যাতিমান সাংবাদিকদেরও নিজের সংবাদপত্রে নিয়ে এসে এটির আরো ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে। 

২০১৬ সাল থেকে মোহনা টিভিতে নিজের একটি টক শো-ও শুরু করেন। দৃষ্টিকোণ নামের সেই অনুষ্ঠানটিতে ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত অন্তত ১৫১টি পর্ব প্রচারিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ৭ মার্চ তিনি ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে জানান যে তিনি একটি টেলিভিশন চ্যানেল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

শাহেদ করিম

গণমাধ্যমে নিজের এই ভাবমূর্তিকে শাহেদ করিম নানাভাবে কাজে লাগিয়েছেন। যেমন তিনি নিয়মিতই সচিবালয়ে যেতেন, এবং নিজের সংবাদপত্রটিকে দেখিয়ে তিনি একটি প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড জোগাড় করেছিলেন। একজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তিনি বিশেষ সিকিউরিটি পাস সংগ্রহ করে সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতেও হাজিরা দিতেন। ধারণা করা যায়, ২০১৭ সালে যে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন, এক্ষেত্রেও তার গণমাধ্যমের ভাবমূর্তি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। 

পরের ধাপটি হলো গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের কাজে লাগানো। খুব চাতুরতার সাথেই দিনের পর দিন তিনি এই কাজটি করে এসেছেন। অঞ্জন রায় থেকে শুরু করে জিটিভি ও সারাবাংলার এডিটর-ইন-চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, ডিবিসির সম্পাদক প্রণব সাহা, সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদ প্রমুখ অনেক শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের সাথেই তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কিংবা ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাঝে ছবি তুলেছেন। 

শুধু ছবি তুলেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব ছবিও নিয়মিত পোস্ট করে গেছেন, যেন সকলের সামনে এটি প্রতিষ্ঠিত করা যায় যে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সাথে তার কতটা দহরম মহরম রয়েছে। 

কারো সাথে ছবি তোলা খুবই সহজ, কেননা অনেকেই শিষ্টাচার ও সৌজন্যের খাতিরে ছবি তোলার অনুরোধকে না করতে পারেন না। তাই উপরের তালিকায় উল্লিখিত অনেকেই যে প্রকৃতপক্ষে শাহেদ করিমের ঘনিষ্ঠজন নন, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে এটিও অনস্বীকার্য যে কারো কারো সাথে তার আসলেই সৌজন্যতা কিংবা পেশাদারী সম্পর্কের চেয়েও বেশি গভীর অন্তরঙ্গতা ছিল। যেমন অঞ্জন রায় নিজে তার ফেসবুকে শাহেদ করিমের ছবি দিয়ে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় রিজেন্ট হাসপাতালের "প্রশংসনীয় ভূমিকা" সম্পর্কে লিখেছেন। আবার টেলিভিশন চ্যানেল খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শাহেদ করিম একজন 'রেজা ভাই'-কে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। সেই 'রেজা ভাই' জিটিভির সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা হওয়া খুবই সম্ভব। অবশ্য তিনি সরাসরি এই দায় মেনে না নিয়ে বলেছেন, "ওটা যে আমি, এটা ভাবার কোনো কারণ নাই। এটা আরেকজন রেজা হতে পারে। এমনকি, আমি যদি কাউকে পরামর্শ দিয়েও থাকি যে- টেলিভিশন খোলেন, অন্যায় তো কিছু নাই।"

গ্রেপ্তারের পর শাহেদ করিম

সুতরাং একটি সিদ্ধান্তে আমরা উপনীত হতেই পারি যে গণমাধ্যম, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা যদি কোনো শিল্প হয়, তবে সেই শিল্পের দা ভিঞ্চি হলেন শাহেদ করিম। গোয়েন্দারা তো স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছেন, শাহেদ করিম "মিডিয়ার শক্তিকে" কাজে লাগিয়েছেন রাজনীতিবিদ, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে তার বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে।

কিন্তু এখানে একটি বিষয় খুবই আশঙ্কাজনক। সেটি হলো, শাহেদ করিমের উত্থানের পেছনে মিডিয়ার একটি বড় ভূমিকা ছিল এবং তা বহুল চর্চিত বলে যেন কেবল এটিকেই এককভাবে দোষারোপ করা না হয়, যাতে করে নেপথ্যে থাকা অন্য দোষীদের দোষ ঢাকা পড়ে যায়। এই আশঙ্কার কারণ হলো, গোয়েন্দারা এখন পর্যন্ত শুধু মিডিয়ার দোষই দেখতে পাচ্ছেন। তারা বলছেন, "আমরা এখন পর্যন্ত শাহেদের পেছনে কোনো গডফাদার কিংবা রাজনৈতিক নেতাকে খুঁজে পাইনি। শাহেদ তার সংবাদপত্রকে, এবং বিভিন্ন টক শোতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রাপ্ত খ্যাতিকে কাজে লাগিয়েছেন নিজের যেকোনো সমস্যা মোকাবেলার জন্য।"

শাহেদ করিম যে মিডিয়াকে তার উত্থানের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন, সে তো এখন এক সর্বজনস্বীকৃত সত্য। কিন্তু এটিই যে পূর্ণাঙ্গ সত্য নয়, সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না। মিডিয়া হয়তো তাকে প্রাথমিক পরিচিতিটুকু দিয়েছে, তার পায়ের তলায় শক্ত জমিন দিয়েছে। কিন্তু সেই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে তিনি যে ক্ষমতাসীন দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্যপদ পর্যন্ত বাগিয়ে নিয়েছেন, এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই খুব বড় কারো সুপারিশ লেগেছে। তারা কারা? জামাতে ইসলামীর নেতা, যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি হওয়া মীর কাশেম আলী, এবং বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে জেলে থাকা গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের মতো লোকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও কারা তাকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল? 

শাহেদ করিম যে উত্তরা, গুলশানের চিহ্নিত অপরাধীদের সহায়তায় নিজের সংবাদপত্রকে দাঁড় করিয়েছেন, সেই অপরাধীরা কারা? স্বাস্থ্য বিভাগ যে করোনাভাইরাস রোগীদের বিনামূল্যে টেস্ট ও চিকিৎসার জন্য রিজেন্ট হাসপাতালের সাথে চুক্তি করেছিল, সেটি বাস্তবায়িত হয়েছিল কার কার মদদে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে ইতঃপূর্বে শাহেদ করিমের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নিতে চাইত না, কিন্তু তিনি মামলা করলে সেটি নিতেন, তা সম্ভব হতো কার ইঙ্গিতে? 

এইসব প্রশ্নের সদুত্তর বের করে এনে গোটা ঘটনার গভীরে প্রবেশ করা আবশ্যক। তা না করে যদি একতরফাভাবে শুধু মিডিয়াকেই অভিযুক্ত করা হতে থাকে, সেটিও আসলে ন্যায়বিচার হবে না। যেকোনো আলোচিত ঘটনায় আমরা মিডিয়া ট্রায়াল দেখতে পাই। কিন্তু শাহেদ করিমের ঘটনায় যদি কেবল মিডিয়াকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তাহলে হয়তো দেখা যাবে মিডিয়ার কারসাজিতেই এই প্রসঙ্গটি এক সময়ে নতুন কোনো ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে গেছে!

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা