আটচল্লিশ ঘন্টার আল্টিমেটাম ও একটি নাইন ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মেঘ এখন স্কুলে পড়ে, অনেকটা বড় হয়ে গেছে, কিন্ত সেই আঘাত, সেই কষ্টটা হয়তো ভেতরে রয়ে গেছে এখনও। পৃথিবীতে সব কষ্ট ভুলে থাকা যায়, প্রিয় মানুষদের চিরতরে হারিয়ে ফেলার কষ্টটাতো ভোলার মতো নয়!
ভালো নাম মিহির সারওয়ার, ডাকনাম মেঘ। বয়স এখন তেরো বছর, তবে হঠাৎ দেখলে আরও কম মনে হয়। দেশের অনেক মানুষ ওকে চেনে এখন, ওর নাম জানে। তবে এই বিখ্যাত হওয়াটা ও উপভোগ করে না মোটেও। সাজানো একটা পৃথিবী ছারখার হয়ে যাবার পরে কে'ইবা বিখ্যাত হতে চায়? মেঘও চায়নি।
ওর যখন বছর পাঁচেক বয়স, বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসা নিয়ে ছোট্ট দুনিয়াটা ছিল সাজানো। ২০১২ সালের আজকের দিনে, মাঘ মাসের এক শীতল সকালে ঘুম ভেঙে পৃথিবীর সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্যটার সাক্ষী হতে হয়েছিল ওকে। বাবা-মা'কে ওর চোখের সামনে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল, দুজনের রক্তে ভেজা লাশ দুটো পড়ে ছিল ওর চোখের সামনেই। চলুন, তখন আপনাদের একটা এইট ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ দেখানো যাক।
২০১২ সালের এগারোই ফেব্রুরীর দিনটাকে মেঘ কোনদিনই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারবে না। সাংবাদিক সাগর সারওয়ার ছিলেন ওর বাবা, মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক। মায়ের নাম মেহেরুন রুনি, এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন তিনি। আজ থেকে সাত বছর আগে এক ভোরে দুজনই নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন নিজেদের পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায়, আর সেই খুনের একমাত্র সাক্ষী ছিল ছোট্ট মেঘ। বাবা মায়ের নিথর দেহের পাশে বসে থাকা মেঘ হয়তো তখন বুঝতেও পারেনি যে, ওর সবচেয়ে প্রিয় দুজন মানুষ আর কোনদিন জেগে উঠবে না, ওকে কোলে নেবে না, ওর সাথে কথা বলবে না আর কখনও।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আটচল্লিশ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। সেই আটচল্লিশ ঘন্টাটাও কৌতুকে পরিণত হয়েছে পরে। তদন্তের উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি আট বছরেও। যে সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতেন সাগর-রুনি, তারাও কিছুদিন আল্টিমেটাম দিয়েই মাঠ ছেড়েছেন। লাশ একবার দাফনের পরে আবার কবর থেকে তোলা হয়েছে, ভিসেরা সংগ্রহের পরে আমেরিকার ল্যাবে পাঠানো হয়েছে পরীক্ষার জন্যে, সেই পরীক্ষায় কি ফল এসেছে তদন্তকারী কর্মকর্তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমাদের জানা নেই।
আমরা শুধু খবরে পড়ি, প্রথম পাঁচ বছরে ছেচল্লিশবার পেছানো হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ, নয় বছরে মোট ৭৫ বার! তদন্ত এগোয় না, তদন্তকারী কর্মকর্তারা কোন 'ক্লু' খুঁজে পান না! ফাইলের ওপরে ফাইল জমে, তার ওপরে জমে ধুলোর পাহাড়, কিন্ত কাজের কাজ কিছু হয় না আর। এদিকে বড় বড় রাঘব বোয়ালদের নাম যুক্ত হয় এই মামলার সঙ্গে, হয়তো গুজব হিসেবেই। কিন্ত সেই গুজব থামিয়ে সত্যিটা সবাইকে জানানোর গরজটা কারো নেই, না রাষ্ট্রের, না আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
মিডিয়াও চুপচাপ, কারো কোন হেলদোল নেই। ফেব্রুয়ারীর এগারো তারিখ এলেই শুধু সাগর-রুনির কথা মনে পড়ে সবার, মেঘের সাক্ষাৎকার নিতে ছোটে সবাই। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেদনাবিধুর মিউজিক বসিয়ে করুণ একটা আবহ তৈরি করা হয়, দলবেঁধে সাংবাদিকেরা ছোটে ডিএমপি অফিসে, র্যাব কার্যালয়ে। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে গৎবাঁধা প্রশ্ন করা হয়, উত্তরগুলোও থাকে সেই একই ধাঁচের।
আমরা শুধু 'উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি'র কথা শুনি, কিন্ত সেটা কি, তা আর আমাদের জানা হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গিয়ে সাংবাদিক নেতারা তেলের ভাণ্ডার উপুড় করে দেন, নোবেল পুরস্কার থেকে শুরু করে খালেদা জিয়ার মেকাপ- সব প্রসঙ্গেই সেখানে আলোচনা হয়, কিন্ত সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ কেউ তোলে না, তদন্ত আর বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না, যেন সাগর আর রুনি বলে কারো অস্তিত্বই কখনও ছিল না!
তবে সেসবে মেঘের কিছু আসে যায় না এখন আর। ছেলেটা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সবকিছু থেকে। মামা আর নানীর সঙ্গেই শুধু ওর বন্ধুত্ব, অন্যদের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে। সাংবাদিকদের বাড়িয়ে ধরা মাইক্রোফোনের সামনেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে মেঘ, ফুটেজ খাওয়ার ইচ্ছেটা নেই ওর ভেতরে। বাবা-মায়ের সঙ্গে ওর ছবি দিয়ে ঘরের দেয়াল ভর্তি, সেগুলোর দিকে নির্বাক তাকিয়ে থেকেই ওর সময় কাটে।
মেঘ এখন স্কুলে পড়ে, অনেকটা বড় হয়ে গেছে, কিন্ত সেই আঘাত, সেই কষ্টটা হয়তো ভেতরে রয়ে গেছে এখনও। পৃথিবীতে সব কষ্ট ভুলে থাকা যায়, প্রিয় মানুষদের চিরতরে হারিয়ে ফেলার কষ্টটাতো ভোলার মতো নয়! রাস্তায় বা বাইরে কোথাও মেঘকে দেখলে অনেকে চিনে ফেলে, কেউ হয়তো চিনতে পারে না, তারা প্রশ্ন করে- তোমাকে কোথায় যেন দেখেছি, তুমি কি অ্যাড(বিজ্ঞাপন) করো? মেঘ জবাব দেয় না এসব প্রশ্নের। হ্যাঁ, মেঘ অভিনয় করে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে বাবা মা হারানো এক ছেলের হিসেবে জীবনের মঞ্চে অভিনয় করে চলেছে মেঘ, সবাই তো সেটা জানে না!
মেঘ এখন বেশ বড় হয়েছে, অনেক কিছুই বোঝে সে। বাবা-মা আর কোনদিন ফিরে আসবে না, এটাও যেমন সে জানে। আর জানে, ওদের খুনের বিচারটাও হয়তো সে আর পাবে না। ন্যায়বিচার, জাস্টিস- এসব ভারী ভারী শব্দ কেবল বই-খাতা আর অভিধানেই থাকে, বাস্তব জীবনে এসবের দেখা খুব কম মানুষই পায়। প্রতিদিন দেশে এত এত ঘটনা ঘটছে- ইস্যু আসছে, হারিয়ে যাচ্ছে, এতসব ইস্যুর ভীড়ে সাগর-রুনি বা মেঘের কথা ভাবার সময় আছে কারো?