এমন খবর এখন প্রায় নিয়মিতই পাওয়া যায়। আমরা যারা নিজেদের প্রাউড মুসলিম দাবি করি তাদের অবশ্য এসবে কোনো বিকার নেই। এসব ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র মনে হয় আমাদের কাছে। অথচ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা ঐসব অমানুষদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরবার প্রয়োজন ছিলো প্রাউড মুসলিমদের। যেহেতু মাদ্রাসা ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবার সম্ভাবনা আছে, সেহেতু চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করি আমরা। ঠিক এভাবেই নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছি।
সাল ১৯৭৬। আমেরিকার বোস্টন পুলিশ স্টেশন। দু'জন পুলিশ কথা বলছেন একটি গ্রেফতারের ব্যাপারে। বেশ স্পর্শকাতর মামলা, কারণ একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতন করেছেন ক্যাথলিক চার্চের এক ধর্মযাজক। উচ্চপদস্থ আরেক পাদ্রির সামনে শিশুটির মাকে বুঝানোর চেষ্টা চলছে। এক পর্যায়ে, সহকারী জেলা অ্যাটর্নি স্টেশনে প্রবেশ করলেন। ঘটনাটি যেহেতু স্পর্শকাতর, সেহেতু মামলা ধামাচাপা দিতে বললেন। অতঃপর, একটি নিস্পাপ শিশুকে যৌন নির্যাতন করা সেই অমানুষকে ছেড়ে দেয়া হলো। জাস্টিজ ওয়াজ ডিনাইড দ্যাট ডে।
সাল ২০০১। দ্যা বোস্টন গ্লোব পত্রিকায় নতুন সম্পাদক নিয়োগ করা হলো। সে পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন পড়ে ধর্মযাজকদের শিশু যৌন নির্যাতন সম্পর্কে জানতে পারলেন তিনি। ফলে, উক্ত পত্রিকার স্পটলাইট নামক অনুসন্ধান টিমকে দায়িত্ব দিলেন সত্য বের করে আনার। তদন্তে ফাঁস হলো ভয়ংকর সব চাঞ্চল্যকর তথ্য। একজনের বিরুদ্ধেই ৮০টি অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে ১৩ জন ধর্মযাজকের বিরুদ্ধে কয়েকশ' অভিযোগের কথা। বোস্টনের ক্যাথলিক চার্চ ব্যবস্থার প্রতিটি প্রকোষ্ঠে শিশুদের উপর যৌন নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র পরিলক্ষিত হয়।
নানা বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে এ ধরণের প্রায় ৬০০টি ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হবার পর, বোস্টনের ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পদত্যাগ করেন এবং অসংখ্য শিশু রক্ষা পায় শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে। যা তোলপাড় করেছিলো পুরো বিশ্বকে। সাংবাদিকতায় বিশেষ এই অবদানের জন্য বিখ্যাত পুলিৎজার সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলো স্পটলাইট টিম। এবং এই সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘স্পটলাইট’ চলচ্চিত্রটি ২০১৬ সালের অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ভূষিত হয়।
সাল ২০১৭। ১৫ই এপ্রিল রাতে, ঢাকার সবুজবাগ থানার বাসাবো এলাকার একটি মাদ্রাসায় আট বছরের এক ছাত্রকে হুজুর বেলাল হোসেন তার রুমে নিয়ে যায়। শিশুটির মুখে স্কচটেপ দিয়ে, হাত-পা বেঁধে এরপর তাকে ধর্ষণ করে। এসময় মাদ্রাসার বাবুর্চি হৃদয় ঘটনাটি দেখে ফেলে। এরপর সে বিষয়টি মাদ্রাসা কমিটিকে জানালে বেলালকে কৌশলে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এবং মাদ্রাসা কমিটি ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়। শিশুটির ফুপু জানান, ‘আমরা তখনও এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। পরবর্তীতে ছেলেটির জ্বর উঠলে আমরা তাকে বাসায় নিয়ে আসি। তখন সে পায়খানা করতে চাইতো না। পায়খানা করার সময় রক্ত বের হতো। তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। তখন সেখানের চিকিৎসকরা আমাদের বলেছে, শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। এরপর শিশুটির মা ঘটনাটি থানায় গিয়ে জানায় এবং সে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে।’ থানায় মামলা হবার পর, ঐ হুজুর পালিয়ে যায়।
আরো কয়েক বছর আগে, ২০১০ সাল থেকে যদি ১০ বছরের হিসেব টানি তবে প্রতিবছরেই মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ সংবাদ শিরোনামে ছিলো। এই শিশুদের মধ্যে যে শুধু মেয়েরা রয়েছে এমন নয়। মাদ্রাসায় শিক্ষকদের দ্বারা ছেলে শিশুরাও হয়েছে যৌন নিপীড়নের শিকার। ২০১০ সালে ময়মনসিংহে ছাত্রীকে ধর্ষণ, ধর্ষক মাদ্রাসার সুপার। ২০১১ সালে, রাজবাড়ীতে মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণের শিকার, মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেফতার। ২০১২ সালে, বাকলিয়ায় শিশু ধর্ষিত, মাদ্রাসা শিক্ষক আটক। ২০১৩ সালে, চট্টগ্রামে ৫ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করলো মাদ্রাসা শিক্ষক। ২০১৪ সালে, ঢাকায় মাদ্রাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে একাধিক ধর্ষণের অভিযোগ। ২০১৫ সালে, উত্তরায় মহিলা মাদ্রাসায় ছাত্রী ধর্ষণের শিকার। ২০১৬ সালে, বগুরায় মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণ করেছেন অধ্যক্ষ। ২০১৭ সালে, মৌলভীবাজারে দুই মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ; গৌরনদীতে মাদ্রাসা ছাত্রীর ধর্ষণের ভিডিও প্রকাশ। ২০১৮ সালে, রামপুরায় মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যা; বিচার চেয়ে স্বজনদের মিছিল। ২০১৯ সালে, নেত্রকোনায় আট ছাত্রীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন মাদ্রাসা শিক্ষক।
কয়েকশ ঘটনার মধ্যে, এখানে তুলে ধরা হয়েছে মাত্র কয়েকটির কথা। এতেই কী বীভৎস লাগছে দেখতে। এখন কল্পনা করুন, বাস্তব চিত্র কতোটা ভয়াবহ হতে পারে? গত এক দশকে এদেশের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি যে আকার ধারণ করেছে তা রীতিমত ভয়ঙ্কর। মাদ্রাসাগুলোতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ধর্ষণের সংখ্যা। তবুও আমরা চুপ করে আছি। কারণ, আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি এতোটাই প্রকট যে আমরা ধর্ষিত হবো তবুও প্রতিবাদ করবো না। প্রতিবাদ করলে কি আমাদের ধর্ম চলে যাবে? এতোটাই ঠুনকো আমাদের বিশ্বাস?
এই গত ১৬ জানুয়ারিতেই, নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় মাদ্রাসা সুপার কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়ে এক শিশু ছাত্রী (১১) অন্তঃসত্ত্বা হয়। পরে তাকে জোর করে গর্ভপাতের ট্যাবলেট খাওয়ানোয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে। রবিবার (১৯ জানুয়ারি) কেন্দুয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সুজন ব্যানার্জী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। উপজেলার রোয়াইলবাড়ী বাজারের কাছের আশরাফুল উলূম জান্নাতুল মাওয়া মহিলা মাদ্রাসায় এই ঘটনা ঘটে। মাদ্রাসা সুপার আব্দুল হালিম (৩৪) ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছে।
এদিকে গত ১৭ই জানুয়ারি, ইসলামকে হেফাজত করার দায়িত্ব নেয়া আল্লামা শফী বলেছেন, ‘স্কুল-কলেজ জেনার বাজার’।
তাহলে আসুন, সাম্প্রতিক সময়ে মাদ্রাসাগুলোতে কী হচ্ছে তাতে একটু চোখ বুলিয়ে নিই...
নারায়ণগঞ্জে ১২ ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার
ধর্ষণের শিকার ছাত্রী অন্তঃসত্ত্বা, মাদ্রাসা শিক্ষক গ্রেপ্তার
শেরপুরে মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ, লাখ টাকায় মীমাংসার চেষ্টা
লক্ষ্মীপুরে ১২ বছরের মাদ্রাসা ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে শিক্ষক গ্রেফতার
ধর্ষণের পর কোরআন শরীফ ছুঁইয়ে শপথ করাতেন নেত্রকোনার মাদ্রাসা অধ্যক্ষ
আখেরাতের ভয় দেখিয়ে নারায়নগঞ্জের মাদ্রাসায় ১১ ছাত্রীকে ধর্ষণ, মাদ্রাসা অধ্যক্ষের দায় স্বীকার
বগুড়ায় মাদ্রাসার কমনরুমে ছাত্রীকে ধর্ষণ, অধ্যক্ষ গ্রেফতার
গজবের ভয় দেখিয়ে কুড়িগ্রামের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকের ধর্ষণ, শিশু অন্তঃসত্ত্বা
ঢাকায় ছাত্র ধর্ষণের অভিযোগ, মাদ্রাসা শিক্ষক আটক
গতবছর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ২০ এর অধিক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় দুই শিক্ষককে গ্রেফতারের সংবাদটি টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ও পত্রপত্রিকায় ছবি দেখে উক্ত মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রী তার মাকে জানায় ‘আমাদের আল আমিন হুজুরও তো আমাদের সাথে এরকম করে’। এ সময় শিশুটি তার মায়ের কাছে বিস্তারিত ঘটনা জানায়।
পরে শিশুটির মা ঘটনাটি র্যাবকে জানালে ওই মেয়ের জবানবন্দি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে র্যাব। অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু ঐ শিক্ষার্থীই নয়, ২০১৮ সাল থেকে অর্থাৎ গত এক বছর যাবৎ ঐ মাদ্রাসার তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত অন্তত ১০ থেকে ১২ জন ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছেন অধ্যক্ষ। এ ছাড়া অনেক শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানিও করেছেন। এবার বুঝুন অবস্থা!
এমন খবর এখন প্রায় নিয়মিতই পাওয়া যায়। আমরা যারা নিজেদের প্রাউড মুসলিম দাবি করি তাদের অবশ্য এসবে কোনো বিকার নেই। এসব ইহুদি নাসারাদের ষড়যন্ত্র মনে হয় আমাদের কাছে। অথচ ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা ঐসব অমানুষদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরবার প্রয়োজন ছিলো প্রাউড মুসলিমদের। যেহেতু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হবার সম্ভাবনা আছে, সেহেতু চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করি আমরা। ঠিক এভাবেই নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছি। স্পটলাইটের অনুসন্ধানে বলা হয়েছিলো, 'সমগ্র বিশ্বের চার্চের যাজকদের মধ্যে অন্তত ৬% সদস্য যৌন নির্যাতনের সাথে জড়িত।'
মাদ্রাসা ব্যবস্থায় অনুসন্ধাণ চালালেও শুরু হবে তোলপাড়। বেরিয়ে আসবে অগণিত থলের বেড়াল। হয়তো-বা আরেকটি স্পটলাইট অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এ ব্যাপারে আমাদের মাথা-ই নেই, ব্যাথা থাকবে কোথা থেকে? আমরা কোনো খোঁজ খবর ছাড়াই একদম নির্ভয়ে এমন বিকৃত মস্তিস্কের শিক্ষকদের হাতে তুলে দিচ্ছি আমাদের প্রজন্মকে। কতৃপক্ষও যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আর আমরা তো মেনেই নিয়েছি সব। কারণ যা ঘটে সবই আমাদের কাছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র।
অকালপ্রয়াত জহির রায়হান বা তারেক মাসুদেরা যদি বেঁচে থাকতেন, তবে এই বিচ্ছিরি ঘটনাগুলোকেই পর্দায় তুলে ধরতেন হয়তো। এতে করে তাদের কল্লাও দাবি করা হতো হয়তো। মরে গিয়েই বেঁচেছেন সম্মান নিয়ে। প্রতিটা মানুষের মধ্যে ভালো-খারাপ উভয় দিক থাকে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, আপনি কোনটিকে পেলে পুষে বড় করছেন। এইটুক বুঝতে মহাপুরুষ হতে হয় না, চৌদ্দশ' বছরের ইতিহাস কপচানো লাগে না, চৌদ্দশ' গ্রামের একটি সুস্থ মস্তিস্কই যথেষ্ট।