সেরাম ইন্সটিটিউটের আগুন লাগলে আমরা কেন এত আনন্দিত হই?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যে সেরাম ইন্সটিটিউটের টিকা করোনা থেকে আমাদের বাঁচাবে, সেই সেরামের প্রতিই কেন এত বিদ্বেষ? কেন তাদের একটা ভবনে আগুন লাগার খবরে আমরা এত উচ্ছ্বসিত? তাদের সর্বনাশের খবর শুনে আমাদের মনে কেন পৌষ মাসের মেলা বসেছে?
ভারতের যে কোম্পানিতে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদান হচ্ছে, সেই সেরাম ইনস্টিউটের একটি স্থাপনায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডে অন্তত পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এই খবরের নিচে শত শত উৎসাহী মন্তব্য, উল্লাসে ফেটে পড়ছে একেকজন। তীব্র ভারতবিদ্বেষ এদেশের অনেক মানুষের মনেই আছে, সেটা চেপে রাখাটা দুস্কর হয়ে দাঁড়ায় মাঝেমধ্যেই। তাই বলে অন্যের বিপদে এভাব্র উল্লাস করার মতো অদ্ভুত কাজ বোধহয় আমরাই সবচেয়ে ভালোভাবে পারি। মন্তব্যগুলো পড়ে সেই বিশ্বাসটাই আরও একবার পোক্ত হলো।
খবর মারফত জানলাম, মহারাষ্ট্রের পুণের মঞ্জরী এলাকায় একশ একরের বেশি জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা সেরাম ইনস্টিউট অব ইন্ডিয়া পুরো বিশ্বেই টিকা উৎপাদনকারী সবচেয়ে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি করোনাভাইরাসের টিকার ৫ কোটি ডোজ সেখানে প্রতি মাসে উৎপাদন করা হচ্ছে, যার দিকে তাকিয়ে আছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বহু দেশ। বাংলাদেশ এই সেরাম ইনস্টিউটের কাছ থেকেই তিন কোটি ডোজ টিকা কিনেছে, যার প্রথম চালান ২৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশে পৌঁছানোর কথা। ভারত সরকার উপহার হিসেবে গতকাল যে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠিয়েছে, তাও সেরাম ইনস্টিউটেরই টিকা।
যে সেরামের টিকা করোনা থেকে আমাদের বাঁচাবে, সেই সেরামের প্রতিই কেন এত বিদ্বেষ? কেন তাদের একটা ভবনে আগুন লাগার খবরে আমরা এত উচ্ছ্বসিত? সেরাম একটা ভারতীয় কোম্পানী- শুধুমাত্র একারণেই কী? ভারতকে অপছন্দ করার নানা কারণ থাকতে পারে, ভারত সরকারের নানা নীতি, বাংলাদেশের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদ আমরা অবশ্যই করব। কিন্ত তাই বলে একশো ত্রিশ কোটি ভারতীয় নিশ্চয়ই আমাদের শত্রু নন। সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে তো আমাদের স্বার্থও জড়িত। তাহলে তাদের সর্বনাশের খবর শুনে আমাদের মনে কেন পৌষ মাসের মেলা বসেছে?
বাংলাদেশের জন্য বিশ লাখ ডোজ ফ্রি টিকা পাঠিয়েছে ভারত। এই টিকা সেরাম ইন্দটিটিউটেই প্রস্তুত হয়েছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনকার নির্দেশনা মেনে বানানো এগুলো। সেই টিকা নিয়েও চলছে প্রচুর ঠাট্টা তামাশা, সেই সঙ্গে হচ্ছে সন্দেহ আর ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা। ভারত নাকি বাংলাদেশীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, টিকা প্রয়োগের পর বাংলাদেশীরা বেঁচে গেলেই ভারত সেটা ব্যবহার করবে, নইলে না- এই হচ্ছে কন্সপিরেসি থিওরির জন্মদাতাদের অভিমত।
সমস্যাটা কী জানেন? যারা এরকম ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জন্ম দেয়, এরা একটু কষ্ট করে গুগলে ঘাঁটাঘাঁটি করার পরিশ্রমটা করতে চায় না। ভারত শুধু বাংলাদেশকেই ফ্রি ভ্যাক্সিন উপহার হিসেবে পাঠায়নি, পাঠিয়েছে পাকিস্তান এবং চীন ছাড়া প্রায় সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকেই। এই অঞ্চলে বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল, ভূটান, এবং মালদ্বীপেও কয়েক লক্ষ কোভিশিল্ড পাঠিয়েছে ভারত। এটা ভারতের ভ্যাক্সিন কূটনীতির একটা অংশ, সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার একটা বার্তা। আমাদের বাসায় যেমন ভালো-মন্দ কিছু রান্না হলে আমরা সেটা প্রতিবেশীর বাসায় পাঠাই- এই ব্যাপারটাও সেরকম।
অবশ্যই ভারত এটা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া করছে না। তবে এই স্বার্থটা বাণিজ্যিক, অন্য দেশের মানুষকে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করাটা উদ্দেশ্য নয়। ভারত সরকার এই উদ্যোগের নাম দিয়েছে 'ভ্যাক্সিন মৈত্রী'। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক আধিপত্য পূনঃপ্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্তত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে চীনের তৈরি টিকা সিনোভ্যাক বা সিনোফার্মকে টেক্কা দেওয়াটাই ভারতের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। ভারতের কাছ থেকে উপহার হিসেবে দেড় লক্ষ ডোজ টিকা উপহার পেয়েছে ভূটান, মালদ্বীপে পাঠানো হয়েছে এক লক্ষ 'মে ইন ইন্ডিয়া' টিকা। নেপাল এবং সিশেলসেও টিকা যাচ্ছে, কথাবার্তা চলছে শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এবং মরিশাসের সঙ্গেও।
বাংলাদেশ সরকার ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে করোনার টিকা কিনছে, এই ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না অনেকের। তারা প্রশ্ন তুলছেন, সেরাম ইন্সটিটিউট থেকেই কেন টিকা কিনতে হবে? কেন মর্ডানা বা ফাইজারের টিকা না কিনে সেরামের টিকা কেনা হচ্ছে, এই হলো আপত্তির কারণ। কিন্ত বাস্তবতা হচ্ছে, মর্ডানা বা ফাইজারের টিকার জন্য যে দাম এবং আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে হবে, সেটা বাংলাদেশের সিংহভাগ মানুষের জন্যেই অকল্পনীয়। সেজন্যেই সরকার স্বল্প মূল্যের অক্সফোর্ডের টিকা কিনছে, যেটির মূল্য ধরা হয়েছে চার ডলার প্রতি ডোজ, মর্ডানা বা ফাইজারের টিকার চেয়ে এটি কয়েকগুণ সস্তা।
আরেকটা কন্সপিরেসি থিওরি হচ্ছে, সেরাম ইন্সটিটিউট ভারত সরকারের কাছে টিকা সরবরাহ করছে প্রতি ডোজ আড়াই ডলার দামে। তাহলে বাংলাদেশ কেন প্রতি ডোজ চার ডলার দামে টিকা কিনছে? খুবই সহজ হিসেব, সেরাম ইন্সটিটিউট ভারতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ভারত সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পায়, সেকারণে সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার একটা ব্যাপার আছে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা কেবলই অর্থনৈতিক, কাজেই এখানে ছাড় দেয়ার কোন ব্যাপার নেই। তাছাড়া টিকার অর্ডার যত বেশি হবে, দামটাও তত কমে আসবে, সেখানেও ভারত সরকার বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি টিকার অর্ডার দিয়েছে। একারণে ভারত যেটা আড়াই ডলারে কিনছে, বাংলাদেশ কেন সেটা চার ডলারে কিনবে- এমন প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক।
ভারতের প্রতি বিরক্তি জন্মানোর শত শত কারণ থাকতে পারে, প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি ভারতের মোড়লসুলভ আচরণের সমালোচনা আমরা সবসময় করে এসেছি। কিন্ত শুধু বিরোধিতা করতে হবে বলেই কেউ যদি ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা করে, সেটা খুবই দৃষ্টিকটু একটা প্রক্রিয়া। সেরাম ইন্সটিটিউটে আগুন লাগার ঘটনায় আনন্দিত হবার মতো কিছু যে ঘটেনি- এটা তাই নিশ্চিত করেই বলা যায়। অন্যের বিপদে খুশি হওয়াটা কোন ভদ্রলোকের প্রতিক্রিয়া হতে পারে না।