ধর্ম আর বিজ্ঞানকে এই যে মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে- এটা কি সঠিক কোন কাজ?

আসলে ধর্ম আর বিজ্ঞানকে না, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দুটি ভিন্ন রকম চিন্তা পদ্ধতি। আর সেটা আজ থেকে নয়, বহু আগে থেকেই। এর একটি হচ্ছে যুক্তিভিত্তিক চিন্তাপদ্ধতি, অন্যটি হচ্ছে বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তাপদ্ধতি। যুক্তিভিত্তিক চিন্তা পদ্ধতির মূল টুল হচ্ছে যুক্তি, আর অন্যটির ক্ষেত্রে বিশ্বাস। যুক্তি কাজ করে পর্যবেক্ষণ-গবেষণা-প্রমাণ-সিদ্ধান্ত- এই মডেলে। আর বিশ্বাস কাজ করে 'পর্যবেক্ষণ- সিদ্ধান্ত' এই মডেলে।

একজন মানুষের মধ্যে একই সাথে দু ধরণের চিন্তা পদ্ধতিই কাজ করতে পারে। একজন পদার্থবিজ্ঞানী যখন পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করেন, তখন তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক মডেল অনুসরণ করেন। সেই একই বিজ্ঞানী হয়তো আবার বাড়ি ফিরে নামায পড়েন বিশ্বাসের জায়গা থেকে। কেউ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করলেই যে সর্বক্ষেত্রে যুক্তিভিত্তিক মডেল অনুসরণ করবেন এমন নাও হতে পারে। আবার সর্বক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে কাউকে বিজ্ঞানী হবার দরকার পড়ে না।

একইভাবে একজন মাদ্রাসা ছাত্র যখন রোগাক্রান্ত হলে অলৌকিক সাহায্যের আশায় বসে না থেকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখনি সে যুক্তিভিত্তিক মডেল অনুসরণ করে সিদ্ধান্ত নিল। বিশ্বাসভিত্তিক মডেল ধর্মভেদে, অঞ্চলভেদে আলাদা হয়। একজন মুসলমানের বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা, আর একজন হিন্দুর বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা এক হবে না। আবার একজন বাংলাদেশি মুসলিম আর ইরানের মুসলিমের মধ্যেও চিন্তার পার্থক্য থাকবে।

ধর্ম আর বিজ্ঞান মুখোমুখি দাঁড় করার কোন বিষয় নয়

আমাদের সবার জীবনেই দু ধরনের চিন্তাপদ্ধতিই আমরা কমবেশি ব্যবহার করি। সময়ের সাথে সমাজগুলো বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা থেকে যুক্তিভিত্তিক চিন্তাপদ্ধতির দিকে সরে এসেছে। কোন একটা সমাজে কোন ধরনের চিন্তাপদ্ধতি প্রাধান্য পাচ্ছে সেটা দেখে সেই সমাজটি সভ্যতার কোন পর্যায়ে আছে তা বলে দেয়া যায়।

এই দুটি চিন্তাপদ্ধতি পরস্পর বিপরীতমুখী। কাজেই একই ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গেলে সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। জুয়ার্দানো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা থেকে শুরু করে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা- সেই সংঘর্ষের ফল। বিশ্বাস যেহেতু লজিকের মতো নয়, তাই তাকে টিকে থাকার জন্য শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। সমস্যার শুরু তখন থেকেই।

একটি যুক্তিভিত্তিক সমাজ জানে তার জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাই সে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি চালু করে। কিন্তু এই সমাজের যে ব্যক্তিটি বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা দ্বারা পরিচালিত, সে বিশ্বাস করে 'সন্তান জন্ম দেয়া একটা ইবাদত' বা 'মুখ দিয়েছেন যিনি,আহার দেবেন তিনি' অথবা 'সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে আমি আমার সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি করছি'- সে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অস্বীকার করবে। ফলে সে নিজের তো বটেই, সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজকেই বিপদে ফেলছে।

আধুনিক পৃথিবীতে বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা যদি ডমিনেট করে, তার ফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। তাইতো আমরা এখন দেখছি, লজিক দিয়ে প্রাপ্ত উপায়- 'করোনা মোকাবিলায় ঘরে থাকুন' কে অস্বীকার করে বিশ্বাসভিত্তিক মডেল দ্বারা পরিচালিত মানুষগুলো মসজিদ-মন্দিরে এসে জড়ো হচ্ছে। ফলে তখন অনেক সমাজ, বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য এদের উপর বল প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়- যেটাকে দেখা হয় বিশ্বাসের উপর আঘাত হিসেবে।

আধুনিক বিশ্বে কেউই কেবল মাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে টিকে থাকতে পারে না

সমাজকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্বাসের গুরুত্ব আছে। ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিক বা মানসিক শান্তির জন্যেও বিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা 'বৈজ্ঞানিক ভাবে' প্রমাণিত! কিন্তু বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা পদ্ধতি যদি কোন সমাজে যুক্তিভিত্তিক চিন্তাকে ডমিনেট করে- তবে সেই সমাজের অগ্রগতি অসম্ভব। একারণেই ধর্ম বা বিশ্বাসকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখা জরুরি। রাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে যুক্তিভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এটি যদি পরিচালিত হয় বিশ্বাস দ্বারা (যে দেশের প্রধানমন্ত্রী তাহাজ্জুদ নামায পড়ে, সে দেশে করোনা আসবে না), তাহলে বিপর্যয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। আশার কথা, আধুনিক বিশ্বে কেউই কেবল মাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে টিকে থাকতে পারে না। তাই সংসদে আযাব মাফ চেয়ে দোয়ামাহফিল হলেও সেই সংসদ কিছু যৌক্তিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়।

যারা মন্দির-মসজিদ বা বিশ্বাসের সামনে বিজ্ঞানকে দাঁড় করিয়ে "বিজ্ঞান লড়েছিল একা" লিখে ছবি দিচ্ছেন- তাদের মূল উদ্দেশ্য এই দ্বন্দ্বটাকে সামনে আনা, আমাদের ভাবতে বাধ্য করা যে- সামনে এগিয়ে যেতে হলে, বিপর্যয় মোকাবিলা করতে হলে, সভ্যতার যাত্রায় সামিল হতে হলে বিজ্ঞান বা যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা পদ্ধতির কোন বিকল্প নেই। তারা মনে করিয়ে দিতে চাচ্ছেন- বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাই আমাদের সাহায্য করছে এই রোগ মোকাবিলায়, বিশ্বাস নয়। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

তাই তারা বলতে চাচ্ছেন, যদি এই বিপর্যয়ের পর আমরা টিকে থাকি, তাহলে যেন এই বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাপদ্ধতির চর্চা করি, তাকে আঁকড়ে ধরি। আমরা যেন আমাদের সমাজে বিশ্বাসভিত্তিক অযৌক্তিক চিন্তাকে প্রাধান্য বিস্তার করতে না দেই। তাদের এই প্রচেষ্টা কিছু মানুষকে যদি ভাবায়, চিন্তা করতে শেখায়- সেটাই তাদের সার্থকতা। তথাকথিত প্রগতিশীল বা শিক্ষিত মানুষ যারা বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার পোশাকের আড়ালে মূলত তীব্রভাবে চর্চা করে বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তার- তারাই চেষ্টা করছে এই সুন্দর বার্তাটিকে ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করতে। যারা বিশ্বাসভিত্তিক চিন্তা করে, তাদের থেকেও ভয়ংকর এই লোকগুলো।

সমাজে সেই সাথে ব্যক্তি জীবনেও যদি আমরা যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার প্রসার ঘটাতে না পারি, তবে তবে ইতিহাসের তলানিতে পড়ে থাকতে হবে আমাদের। যারা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, তারা বিশ্বাসকে ব্যক্তি পর্যায়ে সীমিত আকারে সীমাবদ্ধ রেখে যুক্তিভিত্তিক সমাজ গঠনেই আগ্রহী হবেন। এটাকে খেলা বা যুদ্ধ যে নামেই ডাকেন না কেন, এই খেলায় বা যুদ্ধে জিততেই হবে। যদি ভালো থাকতে চান...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা