'নিষ্পাপ' সাইদি 'সাহেব' এবং 'ইয়ামাশিতা ষ্ট্যাণ্ডার্ড'
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
এখন আপনার যদি মনে হয় জামাত ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেনি, তারা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে “পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া” গানের তালে তালে মুজরা করেছে তাহলে মিজানুর রহমান আজহারীদের ভাষায় বলুন- "অ্যাই সরকার ফ্যাসিবাদী, অ্যাই সরকার জালেম; অ্যাই সরকার খুন করেছে আড়াই হাজার আলেম!"
এক.
Doctrine of hierarchical accountability for war crimes বলতে আপনি কি বোঝেন? যদি কিছু না বোঝেন তাহলে আপনার ফৌজি বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন অথবা আন্তর্জাতিক আইন পড়েন এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। বন্ধুকে আরও জিজ্ঞাসা করুন hierarchical accountability মানে কি? Command responsibility বা Superior responsibility-র মানে কি?
এসবের মানে সহজ ভাষায় বুঝতে হলে ইয়ামাশিতার কাছে ফিরে যেতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হয়ে লড়ে যাওয়া জেনারেল ইয়ামাশিতা সাহেব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ ফিলিপাইনের ম্যানিলার এক আদালতে জেনারেল তময়উকি ইয়ামাশিতার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো war crime-এর। ম্যানিলা গনহত্যা সংগঠনে ভূমিকা, সিংগাপুর এবং ফিলিপাইনে নিরীহ মানুষদের হত্যার অভিযোগে তাকে দায়ী করা হয়।
বিচারে আদালত তার সেনাবাহিনীর অপরাধের দায়ে তাকে দন্ডিত করে। যদিও আদালত পরিষ্কার করে বলে, "যে সেনারা যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদের যে ইয়ামাশিতা এই অপরাধ গুলো করার অর্ডার দিয়েছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। Yamashita was found guilty of his troops' atrocities even though there was no evidence that he approved or even knew of them।"
তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল he had failed in his duty as commander of Japanese forces in the Philippines to prevent them from committing atrocities।
ইয়ামাশিতার নিজের আইনজীবীরা অভিযোগ ডিফেন্ড করেছে এই বলে যে, "জাপানি বাহিনী গনহত্যা করেছে এই কথা সত্য তবে যুদ্ধের ভেতর যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এবং জাপানি সেনাদের ভেতর চেইন অফ কম্যান্ড পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও জেনারেল ইয়ামাশিতা তার সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।"
ইয়ামাশিতার পক্ষে লড়েছিলেন আমেরিকান আইনজীবী Harry E. Clarke যিনি নিজে ছিলেন একজন কর্নেল। ম্যানিলায় স্থাপিত কোর্টে বিচারের প্রথম বক্তব্যেই তিনি যে কথাটা বলেন তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন,
"অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জগুলো 'তিনি কি করেছেন' কিংবা 'তিনি কি করেননি' এমন নয় বরং 'তিনি কি করতে পারতেন' এটাই আলোচ্য"
এই বিচারে কেবল মাত্র সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ব্যর্থতার কারণে (যারা অপরাধ করেছে বলে ইয়ামাশিতা স্বীকার করেছেন এবং যাদের তিনি অপরাধ করতে নির্দেশও দেননি) জেনারেল ইয়ামাশিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত, ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয় এই মৃত্যুদণ্ড। হিটলারের নৎসি বাহিনী, পলপটের খেমাররুজ বাহিনী, কিংবা রুয়ান্ডার বেতার ষ্টেশন Radio Television Libre des Mille Collines (RTLM) এরা সবাই জেনসাইডের অপরাধে দণ্ডিত।
একটা রেডিও ষ্টেশনের কথা যখন আসলো তাহলে সেই রেডিও নিয়ে দুটো তথ্য দেই। রুয়ান্ডার রেডিও Radio Television Libre des Mille Collines থেকে সেসময় সাধারণ হুতুদের উদ্দেশ্যে বলা হতো তারা যেন তুতসিদের ওপর আক্রমণ করে। নিয়মিত গান, নাটক, বিজ্ঞাপনে তুতসিদের Cockroach, Wicked, Sorcerers নামে সম্বোধন করে ডিহিউমেনাইজেশন করা হতো।
এই সব উশকানিতে মানুষ হত্যাকান্ড করেছিল এই মর্মে জাতিসংঘ পরিচালিত The International Criminal Tribunal for Rwanda-তে এই রেডিও ষ্টেশনের বিচার বসে। সেই রেডিওর গোটা দশেক কর্মচারীদের ভেতর তিনজন ধরা পড়েছিল। তিনজনের একজন ছিল রেডিওটির ডাইরেক্টর, একজন ছিল এক্সিকিটভ কমিটির চেয়ারম্যান আর একজন সামান্য এনাউন্সার, অর্থাৎ তার সামনে যা এনে দেওয়া হতো তিনি সেটা শুধু পড়তেন।
নিজেদের ডিফেন্ড করতে গিয়ে ডাইরেক্টর বলেছেন তার ওপর সরকারে চাপ ছিল এসব হেইট স্পিচ ছোড়ানোর জন্য। এক্সিকিটিভ কমিটির চেয়ারম্যান বলে সে জানেই না তাকে এটার চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এনাউন্সার বলে সে কি বলবে সেটা সে ঠিক করতে পারতো না।
এই তিনজনের একজনও একটা মানুষকে খুন করেনি, শুধু অর্ডার তামিল করেছে, একজন জানেই না তাকে যুদ্ধাবস্থায় সরকার এই রেডিওর চেয়ারম্যান বানিয়েছে। তবুও জাতিসংঘ পরিচালিত এই ট্রাইব্যুনাল এই তিনজনকে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
দুই.
সাইদি লন্ডনের বাংলা টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের মুখে বলেছেন যে ছাত্র অবস্থায় তিনি মউদুদির রচনার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ছাত্র জীবন শেষ করার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনি জামাতে যোগ দেন। একই ইন্টার্ভিউতে তিনি বলেছেন, তার ছাত্র জীবন শেষ হয়েছিল ১৯৬২ সালে। একই ইন্টার্ভিউতে তিনি বলেছেন, সত্তুরের দশকে (১৯৬১-১৯৭০) তিনি জামাতের রোকন হন। সত্তুরের দশকে যিনি রোকন তিনি ৭১ সালে কি? সর্বনিম্নে রোকন।
১৯৭১ সালে কি জামাতে ইসলাম নামের দলটি যুদ্ধাপরাধ করেছে? গণহত্যা করেছে? ধর্ষণ করেছে? লুটতরাজ করেছে? এগুলো কি ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটির আওতায় পড়ে? যেকোন rational মানুষের এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই হওয়া উচিত "হ্যা"।
দেলোয়ার হোসেন সাইদি, ১৯৪০ সালে যার জন্ম। ১৯৭১ সালে যার বয়স ৩১ বছর। ১৯৭১ সালে তিনি কি করেছেন? রাষ্ট্র কর্তৃক আনিত সমস্ত অভিযোগ এক মুহূর্তের জন্য যদি বাদ দেই, তিনি তো নিজের মুখে বলেছেন তিনি তখন জামাতের রোকন ছিলেন। তিনি কি ১৯৭১ সালে জামাতকে যুদ্ধাপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন? সমাবেশ করে বলেছেন "মানুষ হত্যা করা উচিত নয়"। এমনকি যদি সমাবেশ করার মত ক্যাপাসিটি ওনার না থাকে ওনার দলের নেতারা যে সমাবেশ করে বলেছিল "যেখানেই তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই তাদের খতম কর" (সংগ্রাম, জুলাই ১৯৭১) তখন কি তিনি এর বিরোধিতা করেছেন?
আচ্ছা ধরেন যুদ্ধের সময় যোগাযোগ ভেঙে পড়েছিল দেখে তিনি প্রতিবাদ জানাতে পারেননি। তাহলে নিশ্চয়ই যুদ্ধের পর তিনি গণহত্যা সংগঠনে পেছনে জামাতের অবস্থানের কারণে ঘৃণা ভরে দল ত্যাগ করেছেন? করেছিলেন কি? নাকি তিনি জামাতের আরও বড় নেতা হয়ে উঠতে লাগলেন? ‘জামাত ১৯৭১ সালে কিছুই করেনি’ এই স্ট্যান্ডকে স্টাব্লিস করতে ব্যাতব্যাস্ত হয়ে পড়লেন?
জেনোসাইড ওয়াচের প্রেসিডেন্ট জর্জ স্ট্যান্টনের “এইট স্টেইজ অফ জেনসাইড” প্রবন্ধটা পড়ে দেখবেন। এই একাডেমিশিয়ান দেখিয়েছেন কিভাবে গণহত্যার সংগঠকেরা গণহত্যার পর গণহত্যাকে চাপা দেওয়ার জন্য কাজ করে যায়। তিনি বলেছেন “গণহত্যা অস্বীকার গণহত্যারই অংশ”।
তিন.
সিদ্ধান্তে আসি। আপনি যদি 'আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন' মেনে থাকেন। আপনি যদি 'দশক' শব্দের অর্থ বুঝে থাকেন। সাইদি যদি সত্তুরের দশকে জামাতে রোকন হয়ে থাকেন। ডক্টর জর্জ স্ট্যান্টন যদি একাডেমিশিয়ান হয়ে থাকেন। সাইদি যদি গণহত্যার সাথে জামাতের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে থাকেন। আর জামাত যদি প্রকৃতই যুদ্ধাপরাধ করে থাকে।
তাহলে শুধু সত্তুরের দশকে জামাত করা, ৭১ সালে জামাতকে যুদ্ধাপরাধ করতে বাধা না দেওয়া এবং ৭১ সালের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধকে অস্বীকার করা কেবল এই তিন অপরাধে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া খুব যৌক্তিক। আর আমাদের আদালত তো তার সরাসরি মানুষ হত্যায় অংশ নেওয়ার পক্ষে প্রমাণ পেয়েছেই।
এখন আপনার যদি মনে হয় জামাত ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেনি তারা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে “পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া” গানের তালে তালে মুজরা করেছে তাহলে মিজানুর রহমান আজহারীদের ভাষায় বলুন-
অ্যাই সরকার ফ্যাসিবাদী, অ্যাই সরকার জালেম; অ্যাই সরকার খুন করেছে আড়াই হাজার আলেম!
আজহারী সাহেব প্রতিটা ওয়াজে বলেন "ঘরে ঘরে সাইদি দাও"। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে জামাতের হেডকোয়ার্টারে ষোলই ডিসেম্বরের পর এক বস্তা চোখ পাওয়া গিয়েছিল। একটু ভেবে দেখেন ৭১ সালে ৩১ বছর বয়সে যেই সাইদি ছিল জামাতের রোকন, ২০২০ সালে ৭৯ বছর বয়েসে জেলে বসে জামাতের নায়েবে আমীর হয়ে আছেন সেই সাইদিই। এক বস্তা চোখ আর তিরিশ লক্ষ লাশ যাকে জামাতের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি আপনারা ঘরে ঘরে তেমন সন্তান চান? সত্যিই কি চান?
একটু ভাবেন... একটু ভাবেন...