আরব্য রজনীর এক ভয়ঙ্কর রাজপুত্রের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছে, যারা সৌদি আরব আর ইসলামকে একই জিনিস মনে করে। যেন সৌদিই ইসলামের রক্ষাকর্তা, তারা না থাকলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে! সৌদিকে বড় করতে গিয়ে ইসলামকে ছোট করে ফেলে তারা। সৌদির এমন নৃশংস কীর্তিতে তারা চুপচাপ বসে থাকে মুখে আর কানে আঙুল দিয়ে, এই লেখাটা তাদের উৎসর্গ করা হলো।
মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে যখন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের আসনটা দখল করেছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান, তখন কেউই ভাবতে পারেনি, কি অশনি সংকেত দেখা দিচ্ছে কপালে! আর দশজন সৌদি প্রিন্সের মতোই যার অবস্থান ছিল, কোন একটা মন্ত্রণালয় সামলানোর দায়িত্ব যিনি পেয়েছিলেন, সেই প্রিন্স সালমান ক্রাউন প্রিন্সের দায়িত্ব নেয়ার পরে ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শনে মেতে উঠেছিলেন সময়ের সাথে সাথে। তবে সেটা সরাসরি বা প্রকাশ্যে নয়, খুবই ধীরে ধীরে, আর বুদ্ধিমত্তার সাথে, যাতে লোকে কিছুই আঁচ করতে না পারে সহজে। ধুরন্ধর এই ব্যক্তি এতটাই পারদর্শীতার সাথে সবকিছু সাজিয়েছেন যে, মানুষ আসলেই ধারণা করতে পারেনি যে তার ভেতরে এমন ভয়ঙ্কর একটা স্বত্বা লুকিয়ে আছে!
ক্ষমতায় আরোহনের দেড় বছরের মাথায় এসে আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় খেলার ইচ্ছেটা দেখা যাচ্ছে না অবশ্য তার মধ্যে। এখন প্রিন্স সালমানের হয়েছে ধর তক্তা মারো পেরেক অবস্থা। ভিন্ন মতাবলম্বী আর সমালোচকদের দমন-নিপীড়ন করতে করতে এমনই একটা অবস্থায় চলে গিয়েছেন তিনি, যে অন্য একটা দেশের সৌদি দূতাবাসের ভেতরে প্রখ্যাত একজন সাংবাদিককে হত্যার আদেশ দিতেও দুইবার ভাবতে হচ্ছে না তাকে। কারণ সালমান জানেন, সবকিছু 'ম্যানেজ' করে নেয়ার ক্ষমতা তার আছে! ক্ষমতায় আসার পরে সৌদি আরবের সংস্কারে মন দিয়েছিলেন সালমান। নারীদের ড্রাইভিঙের অনুমতি দিয়েছিলেন, চালু করেছিলেন সিনেমা হল!
অতি রক্ষণশীল একটা ভাবধারা থেকে সৌদি আরবকে বের করে আধুনিক মানসিকতার একটা রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সৌদি আরবকে পর্যটন নির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানিয়েছিলেন। ব্যাপক কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখিয়ে ঘোষণা করেছিলেন 'ভিশন ২০৩০' নামের একটা প্রোজেক্টের। তার সেই সিদ্ধান্তগুলো দারুণ সাড়া ফেলেছিল, প্রশংসাও কুড়িয়েছিল। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে প্রিন্স সালমানের জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী।
এসব ঘোষণার আড়ালেই শুরুর দিনগুলো থেকে প্রতিপক্ষ আর ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছেন প্রিন্স সালমান। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নাম করে নিজের প্রতিপক্ষের লোকজনকে গ্রেফতার করিয়েছেন, আবার বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের অনেককে মুক্তিও দিয়েছেন! যাদের সঙ্গে সালমানের বনিবনা হয়নি, তাদের বরণ করে নিতে হয়েছে চরম পরিণতি। শুরু থেকেই সেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
পশ্চিমা বিশ্লেষকদের সবাই একবাক্যে বলেছেন, সালমান আসলে দুর্নীতি খতম করছেন না, খতম করছেন তার শত্রুদের। তবে সেসব কথাবার্তা প্রিন্স সালমানকে টলাতে পারেনি। তিনি ভালো করেই জানতেন, মানুষের আইওয়াশ কি করে করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরে প্রথম আন্তর্জাতিক সফরে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সৌদি আরবে নিয়ে এসেছিলেন সালমান। বেশ কিছু দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সই করে সাড়াও ফেলে দিয়েছিলেন। ততদিনে সৌদি আরবের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন প্রিন্স সালমান। তার বাবা, বাদশাহ সালমান এখন নামকাওয়াস্তে সৌদি শাসক। কলকাঠি সবকিছু প্রিন্সই নাড়েন, এবং সেটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট।
ট্রাম্প তখন সালমানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তির হাতটা নিজের কাঁধের ওপরে নিয়ে সালমান শুরু করলেন আশেপাশের দেশগুলোর ওপর হম্বিতম্বি চালানো। সৌদি আরবের শত্রু ইরানের মিত্র দেশ হবার কারণে কাতারের ওপর অবরোধ দিলেন, ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে হত্যা করলেন হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে। রক্তের দাগ তো শুরু থেকেই লেগে ছিল তার হাতে, দিনে দিনে সেই রংটা গাঢ় হতে শুরু করলো।
সেই তালিকায় আরেক সংযোজন সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগি। পেশায় সাংবাদিক এই ভদ্রলোক ছিলেন সৌদি রাজপরিবার আর প্রিন্স সালমানের কর্মকাণ্ডের সমালোচক। ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা কলামে তিনি প্রশ্ন তুলতেন প্রিন্সের কাজকর্ম নিয়ে। দেড় বছর আগে মোহাম্মদ বিন সালমান যখন ক্রাউন প্রিন্স হন, তখন প্রান সংশয়ে পড়ার আশঙ্কায় সৌদি আরব ছাড়েন খাশোগি, কারন দেশে থাকলে বেঘোরে প্রাণটা হারাবেন, সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সৌদি আরব ছেড়ে তিনি চলে এসেছিলেন আমেরিকায়। কিন্ত তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। অক্টোবরের শুরুতে জামাল খাশোগি ছিলেন তুরস্কে। সেখানকার সৌদি দূতাবাসে তিনি গিয়েছিলেন কাগজপত্র নবায়নের কাজে। সেই দূাবাসের ভেতরেই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। জীবিত অবস্থায় তার শরীরটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, ভেতরে ঢোকার মাত্র সাত মিনিটের মধ্যেই হত্যা করা হয় খাশোগিকে। তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় কনস্যুলেট ভবনের ভেতরের দিকে, যেটা কিনা কনসাল জেনারেলের লাইব্রেরী ঘর। আর এই কাজটা করা হয়েছিল প্রিন্স সালমানের প্রত্যক্ষ আদেশে। মৃত্যুর সময় অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার ওপরে, খাশোগির হাতে থাকা অ্যাপল ওয়াচে রেকর্ড হওয়া অডিও ক্লিপের মাধ্যমেই জানা গেছে এসব তথ্য।
খাশোগি যে সেদিন আসবেন, সেটা জানতেন দূতাবাসের কর্তারা, শুধু তাকে হত্যা করার মিশন নিয়েই সৌদি আরব থেকে এসেছিল পনেরো জনের একটা স্কোয়াড। তাদের দায়িত্ব ছিল খাশোগিকে অপহরণ করে সৌদি আরবে নিয়ে যাওয়া, অথবা হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা। আর এই আদেশ তাদের দিয়েছিলেন প্রিন্স সালমান। নিজের কাজের সমালোচকদের মোটেই পছন্দ করেন না সালমান, একারণেই জামাল খাশোগিকে বরণ করে নিতে হয়েছে এমন করুণ পরিণতি।
কতটা উন্মাদ ফ্যানাটিক হলে একজন রাষ্ট্রপ্রধান একজন মানুষকে রাষ্ট্রীয় দূতাবাসে হত্যার আদেশ দিতে পারে, সেটা সত্যিই মাথায় ঢোকে না। তবে এমন জঘণ্য আর নৃশংস একটা কাণ্ড ঘটানোর পরেও অবশ্য প্রিন্স সালমানের কিছুই হচ্ছে না, হবার কথাও নয়। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের একজন তিনি, তার একটা লোমও কি কেউ ছিঁড়তে পারে? ডোনাল্ড ট্রাম্প দুয়েকদিন বাণী-বিবৃতি দিয়েছেন, তারপরে তিনিও চুপ। খাশোগির ছেলেকে রাজপ্রাসাদে ডেকে এনে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন সালমান, তাতেই সাতখুন মাফ হয়ে গেছে। লোকদেখানো একটা বিচারের আয়োজন করেছেন, হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে চাকরি খেয়েছেন কয়েকজনের। এই খুনের পেছনে থাকা মূল নাটের গুরুই যখন বিচারের আয়োজন করেন, তখন অট্টহাসি দেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না বোধহয়।
ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু তিনি ক্রাউন প্রিন্স, এতো সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন। শুধু ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে খুন করেই ক্ষান্ত হননি প্রিন্স সালমান। তারপর যেটা করেছেন সেটা হলিউডের কোনো ব্লকবাস্টার থ্রিলার সিনেমার চেয়ে কম নয়। প্রিন্স সালমান হ্যাক করেন প্রিথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষটির ফোন। কেন? কারন সেই ধনী মানুষটিই হচ্ছে প্রিন্সের সমালোচনাকারী ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক। সাংবাদিক তো দূর, তিনি সেই পত্রিকার মালিককেও ছাড় দিতে রাজি না।
সম্প্রতি গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট থেকে একটি বার্তা পেয়েছিলেন আমাজনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোস। এরপরই বেজোসের মোবাইল ফোনটি হ্যাক হয়ে যায়। এই হ্যাকিং এর পর বেজোসের ফোন থেকে যে তথ্য চুরি করা হয় সেটা প্রকাশ করা হয় আরেকটি আমেরিকান ট্যাবলয়েড দ্য ন্যাশনাল ইনকোয়ারার এ। এই তথ্যফাঁসেই উঠে আসে ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক জেভ বেজোসের পরকীয়া সম্পর্কের কথা। ভেঙ্গে যায় তার সংসার। অথচ, এই বেজোসের সাথে একটা সময়ে খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো প্রিন্স সালমানের। শুধুমাত্র সালমানের সমালোচনা করায় বেজোসের সংসার ভাঙ্গা থেকে শুরু করে তাকে ইমেজ সংকটে ফেলে দিয়েছেন এই সৌদি যুবরাজ। যে ডিভোর্সে জেফ বেজোসের ক্ষতি হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সৌদি রাজপুত্রের কী পরিমাণ ক্ষমতা এবার বুঝুন! শুধু শুধুই তো আর পৃথিবীকে রঙ্গমঞ্চ বলা হয় না!
এই প্রিন্স সালমান অফিশিয়ালি ক্ষমতা গ্রহণের আগেই যে খেলা দেখাচ্ছেন, এবার ভাবুন উনি ভবিষ্যতে কী কী করতে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছে, যারা সৌদি আরব আর ইসলামকে একই জিনিস মনে করে। যেন সৌদি আরবই ইসলামের রক্ষাকর্তা, সৌদি আরব না থাকলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে! কথায় কথায় তারা ইসরাইলকে গালি দেয়, অথচ সৌদি আরব যে ইজরাইলের সাথে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি করে, সেই অস্ত্র দিয়ে ইয়েমেনে মুসলমান মারে, সেটা তারা দেখে না। এসব ভণ্ড লোকগুলো গ্রামগঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে গিয়ে ফতোয়া দেয়, আইয়ুব বাচ্চু কেন জাহান্নামে যাবেন সেসব নিয়ে রসালো আলোচনা করে, তবে সৌদি আরবের এমন নৃশংস কীর্তিতে তারা চুপচাপ বসে থাকে মুখে আর কানে আঙুল দিয়ে। এই লেখাটা তাদের উৎসর্গ করা হলো।