কানাডা-ইংল্যান্ডের মতো খ্রিস্টান দেশগুলো যেখানে উইঘুর মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করছে, সেখানে সৌদি আরব আর পাকিস্তান কিনা উল্টো চীনের প্রশংসা করছে!

আমাদের দেশের অনেক মানুষের কাছে সৌদি আরব হচ্ছে পরম পূজনীয় পূতঃ পবিত্র একটা স্থান। এই দেশের ব্যাপারে কোন সমালোচনা করলেই একশ্রেনীর লোক গালাগালি শুরু করে দেয়। একজন আমাকে এমনও বলেছে, সৌদি আরবের নামে বাজে কথা বললে নাকি আল্লাহ নারাজ হন! তাদের যুক্তি অনুযায়ী, যেহেতু মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ইসলামের প্রচার করেছিলেন, সেহেতু এই দেশটা হচ্ছে ইসলামের ধ্বজাধারী। সৌদি আরবের নামে কোন মন্দ কথা বলা মানে নাকি আল্লাহর নবী আর ইসলামকে অপমান করা!

এসব উদ্ভট যুক্তি শুনে হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝে উঠতে পারি না। সৌদি আরবের পিশাচগুলো যখন আমাদের দেশ থেকে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া নারীদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালায়, তাদের ধর্ষণ করে, হাত পা ভেঙে দেয়, একেকটা মেয়েকে মানসিক ভারসাম্যহীন করে ছাড়ে, তখনও আমাদের দেশের একদল লোক এই অমানুষ জানোয়ারগুলোর হয়ে সাফাই গায়, কারণ তারা সৌদির নাগরিক, তারা নাকি এসব অপরাধ করেও চ্যালচ্যালায়ে বেহেশতে চলে যাবে!

কেউ কেউ তো দাবী করে, সব নাকি ইহুদি-নাসারাদের বানানো মিডিয়ার ষড়যন্ত্র, আদতে এরকম কিছু ঘটেইনি! নবীর দেশের লোকজন নাকি কোনভাবেই এমন অপকর্ম করতেই পারে না! যুক্তি শুনে মনে হয়, এদেরকে মাটি দিয়ে বানানোর সময় স্রষ্টা বোধহয় ইচ্ছে করেই মস্তিস্কের জায়গায় খানিকটা গোবর ঢেলে দিয়েছিলেন। নইলে এসব কথাবার্তা মাথায় আসে কি করে?

কারও কারও ধারণা- সৌদী প্রিন্স বা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কথা বললেই নাকি আল্লাহ নারাজ হন

যাই হোক, এই লেখাটা সেসব বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সেজে বসে থাকা চাটুকারদের জন্যে, যারা প্রতিটা অপকর্মের পরেও সৌদি আরবকে 'ইসলামের রক্ষক' কিংবা 'মুসলিম বিশ্বের নেতা' ভাবেন, তাদের জন্যে। আপনাদের প্রিয় রাষ্ট্র সৌদি আরব কে কখনও চীনের উইঘুর মুসলমানদের নির্যাতনের বিরোধিতা করতে দেখেছেন? রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়াতে শুনেছেন? উল্টো উইঘুর ইস্যুটাকে চীনের আভ্যন্তরীন সমস্যা হিসেবে মত দিয়ে চীনকে চিঠি পাঠিয়েছে দেশটা। এতে নাকি বহির্বিশ্বের নাক গলানোর কিছু নেই। তাহলে সৌদি কেন ইয়েমেনে নাক গলায়? কেন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে বাগড়া দেয়? কেন হুতি বিদ্রোহিদের দমনের নাম করে ইয়েমেনে হামলা চালিয়ে অসহায় মানুষকে হত্যা করে? পুরো মুসলিম বিশ্ব যখন ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়ে ইসরায়েলকে বয়কট করে, তখন সৌদি আরব কেন তাদের বন্ধু আমেরিকার হাত ধরে ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র কেনে, ইরানকে ঠেকানোর জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে গোপনে বন্ধুত্ব পাতায়?

উইঘুরদের নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের বাস। চীনের সর্ববৃহৎ মুসলিম অধিবাসী তারা। বিগত কয়েক দশক ধরেই তাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার এবং নির্যাতন চালিয়ে আসছে চীন সরকার। যদিও চীনের দাবী, সন্ত্রাসবাদ এবং মৌলবাদ দমনের উদ্দেশ্যেই উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে নানামূখী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে তারা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কি হচ্ছে সেখানে? 

অভিযোগ আছে, জোর করে সেখানকার মুসলমানদের আটকে রেখে মদ আর শূকরের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে, যে দুটো জিনিস ইসলাম ধর্ম মতে খাওয়া একেবারেই হারাম। উইঘুর মুসলমানদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার কোন স্বাধীনতা নেই, তাদেরকে রাখা হয় সার্বক্ষণিক নজরদারীতে। সন্দেহভাজনদের তালিকা ক্রমেই লম্বা হচ্ছে, নিয়মিত তাদের হাজিরা দিতে হয় থানায়। নাগরিক অনেক সুযোগ সুবিধা থেকেই বঞ্চিত এসব মুসলমানেরা। কারো ওপরে একটু সন্দেহ হলেই তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে থানায়, সেখান থেকে নিরাপত্তারক্ষীদের টর্চার শেলে।

উইঘুর মুসলমানদের ওপর নানারকম অত্যাচার করা হচ্ছে চীনে

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিনজিয়াংয়ে মুসলমান শিশুদের কৌশলে নিজেদের পরিবার, ধর্মবিশ্বাস ও ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে। শিশুদের পরিবার থেকে আলাদা করতে তাদের জন্য বড় বড় আবাসিক বিদ্যালয় তৈরি করা হচ্ছে পুরোদমে। প্রাইমারী লেভেলের পড়াশোনা শেষ হলেই জোরপূর্বক এসব শিশুদের পরিবার থেকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবাসিক স্কুলে। নিজেদের শিকড় এবং অতীত থেকে শিশুদের একেবারে বিচ্ছিন্ন করতেই এই কর্মসূচি নিয়েছে চীনের কর্তৃপক্ষ। 

'সামাজিক শিক্ষা' দেওয়ার কথা বলে জিনজিয়াংয়ে ১০ লাখ মুসলমানকে আটকে রাখা এবং নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে। চীনের ‘আটকে রেখে শিক্ষাদানের নীতির’ সমালোচনা করে বছরখানেক আগে জাতিসংঘে নিযুক্ত ২২টি দেশের রাষ্ট্রদূতেরা সংস্থাটির মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি চিঠি লেখেন। এই দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান। এর আগেও ফ্রান্স, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরও কয়েকটি দেশ উইঘুর মুসলমানদের প্রতি চীনের এই দমনমূলক নীতির বিরোধীতা করেছে, জাতিসংঘের কাছে চীনের নামে বিচার দিয়েছে।

আর তখন সৌদি আরব কি করেছে জানেন? তারা জাতিসংঘে একটা চিঠি দিয়েছে, বাইশ দেশের রাষ্ট্রদূতের স্বাক্ষরিত চিঠির প্রতিবাদে। সেখানে চীনের কার্যকলাপকে সমর্থন জানিয়ে বলা হয়েছে, উইঘুর সম্প্রদায়কে নিয়ে চীনের এই পরিকল্পনায় নাকি সেখানকার আইনশৃঙখলা পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে! সেই চিঠিতে সৌদি রাষ্ট্রদূতের পাশাপাশি স্বাক্ষর করেছেন পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া, ওমান, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, ভেনেজুয়েলা, কিউবা, বেলারুশ, মিয়ানমার, ফিলিপাইনের রাষ্ট্রদূতেরাও।

খেয়াল করে দেখুন, এরমধ্যে বেশিরভাগ দেশই কিন্ত মুসলিম দেশ। ক্রিকেট খেলায় আমাদের দেশের অনেকেই পাকিস্তানকে সমর্থন করে তারা মুসলমান, আমাদের ধর্মের ভাই, এই যুক্তিতে। তো সেই সৌদি আরব বা পাকিস্তান যখন চীনের নির্যাতিত মুসলমানদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো অত্যাচারীর পক্ষে বিবৃতি দেয়, তখন কোথায় যায় আপনার 'ধর্মের ভাই' বা 'পবিত্র দেশ' এর থিওরি? সৌদি আরব যখন ইয়েমেনের নিরীহ মুসলমানদের ওপরে বোমাবর্ষণ করে তাদের নির্বিচারে হত্যা করে, তারপরেও কিভাবে 'সৌদি আরবের নামে কিছু বললে আল্লাহ নারাজ হবেন' টাইপের পাগুলে যুক্তি মুখে আসে কি করে এসব লোকের? আয়োডিনের অভাব যে শরীরে প্রকট, সেটার প্রমাণ না দিলেই কি নয়?

একজন-দুজন নয়, এমন অজস্র মানুষ আছে, যারা সৌদি আরব আর ইসলামকে একই জিনিস মনে করে। যেন সৌদি আরবই ইসলামের রক্ষাকর্তা, সৌদি আরব না থাকলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে! কথায় কথায় তারা ইসরায়েলকে গালি দেয়, অথচ সৌদি আরব যে ইসরায়েলের সাথে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রচুক্তি করে, সেই অস্ত্র দিয়ে ইয়েমেনে মুসলমান মারে, সেটা তারা দেখে না। এসব ভণ্ড লোকগুলো গ্রামগঞ্জে ওয়াজ-মাহফিলে গিয়ে মনমতো ফতোয়া দেয়, অমুক শিল্পী বা নায়ক কেন জাহান্নামে যাবেন সেসব নিয়ে রসালো আলোচনা করে, তবে সৌদি আরবের এমন কীর্তিকলাপে তারা চুপচাপ বসে থাকে কানে আঙুল দিয়ে। এই লেখাটা তাদের উৎসর্গ করা হলো।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা