মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব হারিয়ে ফেলছে সৌদি আরব?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

ইরান ও তার মিত্র দেশগুলোর দাপটে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সৌদি আরব এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। নিজেদের করা একের পর এক ভুল আর অন্যায়ের খেসারত দিয়ে মুসলিম বিশ্বে নেতার আসনটা হারিয়ে ফেলেছে তারা...
আল জাজিরার সিনিয়র পলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট হিসেবে অনেকদিন ধরেই কাজ করছেন মারওয়ান বিশারা। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সংকট সম্পর্কে তার অনেকদিনের অভিজ্ঞতা গভীর জ্ঞান আছে। সেই মারওয়ান বিশারা গতকাল একটা প্রবন্ধ লিখেছেন আল জাজিরায়, বিষয়বস্তু হচ্ছে, কিভাবে ক্রাউন প্রিন্স সালমানের নেয়া একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে সৌদি আরবের পতন ঘটছে, আঞ্চলিক তো বটেই, মুসলিম বিশ্বেও নিজেদের প্রভাব হারিয়ে ফেলেছে দেশটি।
মারওয়ান বিশরার লেখা প্রবন্ধটা পড়ে মনে হলো, তার উল্লেখ করা কারনগুলোর পাশাপাশি ইরান-তুরস্ক-কাতার জোটের উত্থান, মুসলিম বিশ্বের পাশে না দাঁড়িয়ে বরাবরই নিজ স্বার্থে পশ্চিমা জোটের পক্ষাবলম্বন, ইয়েমেন আক্রমণ- সব মিলিয়ে সৌদি আরব সম্ভবত গত পঞ্চাশ বছরে অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে বাজে সময় কাটাচ্ছে। সৌদির অবস্থা এমনই খারাপ হয়েছে যে, টিকে থাকার স্বার্থে এখন ইসরায়েলের সঙ্গে নিজ গরজে সম্পর্ক ভালো রাখতে হচ্ছে, আরব আমিরাত বা বাহরাইনের সঙ্গে ইসরায়েলের বন্ধুত্ব পাতানোয় নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়তে হচ্ছে।
ষাটের দশকের শেষ ভাগেও মিশরের গামাল আবদেল নাসের ছিলেন মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বড় নেতা, তার কথায় গোটা আরব লিগ উঠতো আর বসতো। তুমুল জনপ্রিয়ও ছিলেন তিনি, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব তখন মিশরের হাতে। তার মৃত্যুর পরে আরব লিগের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেল ধীরে ধীরে, মিশরও সেনা শাসনের কবলে পড়লো। এই সময় ওআইসি দিয়ে মুসলিম দেশগুলোর স্বঘোষিত নেতা বনে গেল সৌদি আরব। ওপেকের দেশগুলো ইসরায়েলকে তেল।রপ্তানী বন্ধ করে দেয়ায় আচমকা তেলের দাম পড়ে গিয়েছিল, আর সেটা পৌষ মাস হয়ে এসেছিল সৌদি আরবের জন্য। অর্থনৈতিকভাবে শক্ত একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলে সৌদি আরব, সেটাই তাদের মোড়লের আসনটা পাকাপোক্ত করে দিয়েছিল।

গত পঞ্চাশ বছর ধরেই ওআইসিতে সৌদি আরবের একচ্ছত্র আধিপত্য। তবে বছর দুই-তিনেক ধরে সেই আধিপত্যে ভাটা পড়েছে, বিকল্প শক্তি হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে ইরান ও তুরস্ক জোট। তাদের পেছনে আছে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন, শিয়া অধ্যুষিত মুসলিম দেশগুলো তো বটেই, সুন্নীপ্রধান মুসলমান দেশগুলোও এখন সৌদির চেয়ে বড় ভরসার জায়গা হিসেবে তুরস্ক বা ইরানকেই মানছে। গত চার দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বড় একটা অংশ জুড়ে ইরানের প্রভাব-প্রতিপত্তি সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। তুরস্কের পাশাপাশি ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ওমান, ইয়েমেন- এসব দেশ যেভাবে ইরানের প্রভাব বলয়ে চলে গেছে, সেটা সৌদির জন্য অশণি সংকেত ছাড়া কিছুই নয়।
পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন দেশে ইরান আর সৌদি আরব একরকমের ‘প্রক্সি ওয়্যার’ বা ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত। ইয়েমেনে গত কয়েক বছর ধরে চলছে গৃহযুদ্ধ। সৌদি আরব লড়েছে এক পক্ষে, ইরান হুতি বিদ্রোহীদের পক্ষে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদকে সমর্থন করছে ইরান। সেখানে তারা সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। অন্যদিকে সৌদি আরব সমর্থন জোগাচ্ছে বিদ্রোহীদের। তারা অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ সবই দিচ্ছে বিদ্রোহীদের। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর এই অঞ্চলে ইরানের প্রভাব বেড়েছে। আবার লেবাননে শিয়া দল হিজবুল্লাহকে ইরান সাহায্য করছে, তারা আবার সৌদি আরবের দুই চোখের বিষ। ইরানের বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী, যাদেরকে 'কুদস ফোর্স' নামে ডাকা হয়, তারা গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির হিসেব-নিকেশই পাল্টে দিয়েছে অনেকটা।
তবে সৌদি আরবের বড় ক্ষতি তারা নিজেরাই করেছে, নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার কাজটা অবলীলায় করেছেন, এবং এখনও করে চলেছেন দেশটির ক্রাউন প্রিন্স সালমান। সৌদি আরবের সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু তিনি, রাষ্ট্রীয় সব সিদ্ধান্তই তার নেয়া। গত কয়েক বছর ধরে নিজের দেশে ফ্যাসিবাদের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং তার বিরোধীদের ওপর চালিয়েছেন নিপীড়ন, এর মধ্যে তার পরিবারের সদস্যরাও আছেন!
প্রিন্স সালমানের শাসন নীতির সমালোচনা করায় তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে তিনি এজেন্ট পাঠিয়ে নৃশংসভাবে খুন করিয়েছেন সাংবাদিক জামাল খাগোশিকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ছাপানোয় হ্যাক করিয়েছেন পত্রিকার মালিক জেফ বেজোসের ফোন! হীরক রাজার দেশের রাজারা কেমন হয়ে থাকেন, তার জ্বলন্ত নিদর্শন হচ্ছেন এই প্রিন্স সালমান। খাগোশি হত্যাকান্ডের জের যাতে টানতে না হয়, এজন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশ কিছু দাবী পূরণ করতে হয়েছে সালমান এবং সৌদি আরবকে।

সৌদি আরব যেহেতু নিজেদের মুসলিম বিশ্বের নেতা মনে করে, মুসলমানদের ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি জায়গাই এখানে, তাদের উচিত ছিল মুসলিমবান্ধব পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চলা। সেটা না করে তারা আমেরিকা এবং ইসরায়েলের ঘনিষ্ট হয়েছে, বরং মুসলমানদের ওপরেই চালিয়েছে নিপীড়ন। হুতি বিদ্রোহিদের দমনের নাম করে ইয়েমেনে হামলা চালিয়েছে তারা, সেই হামলায় মারা গেছে শত শত নিরপরাধ ইয়েমেনি নাগরিক, যাদের প্রায় সবাই মুসলমান। ফিলিস্তিনের ব্যাপারে সৌদি আরব কখনও মুখ খোলে না, চীনের উইঘুর মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হলেও তারা চুপ থাকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর গণহত্যার সময়ও কোন বক্তব্য আসে না তাদের তরফ থেকে। সৌদি আরব যে মুসলমানদের স্বার্থে কিছুই করছে না, সেটা সবার কাছেই এখন পরিস্কার হয়ে গেছে।
তাছাড়া একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্তে নিজের দেশের অভ্যন্তরেও প্রিন্স সালমানের জনপ্রিয়তা তলানীতে। নানা কারনে কট্টরপন্থীরা তার বিরোধিতা করে, আবার লিবারেল মেন্টালিটির মানুষজনও তাকে পছন্দ করে না তার দমন-নীতির কারনে। আবার তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় দেশে বেকারত্ব বাড়ছে, ২০২০ সালে আগের বছরের চেয়ে ৬২ শতাংশ তেল কম রপ্তানি হয়েছে সৌদি থেকে। ব্যবসাক্ষেত্র ধ্বংস হচ্ছে, মানুষের ক্ষোভও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সেসবের উপশম না করে প্রিন্স সালমান মেতে আছেন আমেরিকা-ইসরায়েল নিয়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই ভালো, অথচ আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের পতন ঘটলে যে তার কফিনেও শেষ পেরেক মারা হয়ে যেতে পারে- সেটা প্রিন্স সালমানের মাথায় আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ইরান ও তার মিত্র দেশগুলো সাম্প্রতিক সময়ে যে 'অক্ষ-শক্তি' তৈরি করেছে, তাতে সৌদি আরব এখন অনেকটাই ব্যাকফুটে। ইরানের সাথে তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও কাতার যোগ দিয়েছে, তারা এখন সৌদি আরবের নেতৃত্বকে অস্বীকার করে সরাসরি। সৌদির পেছনে আমেরিকা-ইসরায়েল থাকলেও, এই অক্ষশক্তিও চীন-রাশিয়ার মদদপুষ্ট। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্য বলুন কিংবা মুসলিম বিশ্ব- সব জায়গাতেই প্রভাব হারিয়ে বসেছে সৌদি আরব। মুসলিম দেশগুলোর ওপর ছড়ি ঘোরানোর একচ্ছত্র ক্ষমতা বিলীন হয়ে গেছে, সামনের দিনগুলো তাই সৌদি আরবের জন্য যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং হতে যাচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- আল জাজিরা
ছবি কৃতজ্ঞতা- ফিন্যান্সিয়াল টাইমস
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন