দিলীপ কুমারের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের কাজ করা হয়ে ওঠেনি কেবল একটা শার্টের জন্যে! গ্রামের কৃষকের রোলে দিলীপকে খালি গায়ে অভিনয় করতে বলেছিলেন সত্যজিৎ, দিলীপ কুমার রাজী হননি তাতে, সত্যজিৎও ছিলেন নাছোড়বান্দা...
সত্যজিৎ রায়কে চেনে না বা তাঁর কাজের সাথে পরিচিত নয় এমন একটা লোকও পাওয়া দুষ্কর। অামরা সবাই সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখেছি কিংবা বই পড়েছি। অগত্যা কিছু না হলেও তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ফেলুদার নাম তো শুনেছিই। অামরা যারা সত্যজিৎ রায়কে ভালোবাসি তাদের কাছে তিনি দেবতূল্য। অার, যারা সত্যজিৎ-এর কাজের সমালোচক বা সত্যজিৎকে পছন্দ করেন না (যদিও এর সংখ্যা বেশ কম) তারাও তাঁর অবদান ও শিল্পকর্মের বিশালত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার, অগ্রাহ্য করতে পারেন না। চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট বলেছিলেন, 'যে ব্যক্তি সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখে নি সে সত্যিকারের ভারতীয়ই না।' অার, অামি বলি যে সত্যজিৎ-এর ছবি দেখে নি সে সত্যিকারের বাঙ্গালিই না। হ্যাঁ, তাঁর কাজকে এমনই মানদণ্ড হিসেবে অনায়াসেই ধরা যায়। তো এমন কি সেই ক্ষমতা বা শিল্পের জাদু তাঁর মধ্যে ছিলো যা তাকে এই মর্যাদায় অাসীন করলো? সেটাই অালোচনা করবো।
সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে বড় গুণ বা শক্তি হলো তিনি ছিলেন একজন ভার্সেটাইল চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি পিয়ের অঁদ্রের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি নিজেকে রিপিট করতে পছন্দ করেন না। এবং অামরা যদি তাঁর কর্ম কলেবরের দিকে তাকাই তবে দেখবো অাসলেই তিনি বিভিন্ন অাঙ্গিকের, বিভিন্ন জনরা ও ঘরানার চলচ্চিত্র বানিয়েছেন এবং একটা জনরা থেকে চট করেই পরবর্তী কাজে সম্পূর্ণ অালাদা অন্য একটা জনরাতে নিজেকে অধিষ্ঠিত করিয়েছেন। তিনি কমেডি, ট্র্যাজেডি, ট্রিলজি, ফ্যান্টাসি, ড্রামা, সামাজিক ও পারিবারিক ছবি, অাত্নজৈবনিক ছবি, সায়েন্স ফিকশান, গোয়েন্দা গল্প কোনটা নিয়ে কাজ করেন নি তিনি!
কলকাতা ট্রিলজির তিনটা ছবির একেকটায় একেক রকমের কলকাতাকে উপস্থাপিত করেছেন যার প্রত্যেকটাই একে অপরের থেকে অালাদা হলেও প্রত্যেকটিই বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। সীমাবদ্ধে তিনি দেখিয়েছন কিভাবে ক্রমবর্ধমান কর্পোরেট সংস্কৃতি কলকাতাকে ছেয়ে ফেলছে এবং সমাজের একটা সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণি এর দাসে পরিণত হতে শুরু করেছে। অাত্নকেন্দ্রিক চিন্তা, স্বার্থান্বেষণ এখানে চিত্রায়িত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতে অাবার দেখতে পাই কিভাবে একজন বামপন্থি যুবক সংসারে দায়ভার কাঁধে পড়লে চাকুরির স্বার্থে রাজনৈতিক অাদর্শকে বিদায় জানায়। জনঅরণ্যেও একজন বেকার যুবকের ব্যবসায়ী হয়েওঠার গল্পের মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন ব্যবসায় ক্ষেত্রের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপকৌশলের কাহিনী।
তিনি দেবী ও মহাপুরুষ চলচ্চিত্রে কথা বলেছেন যথাক্রমে ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্ম ব্যবসার বিরুদ্ধে। জলসাঘরে উঠে এসেছে একজন জমিদারের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অাত্ন উপলব্ধি, অহংবোধ, মর্যাদা রক্ষার নকল লড়াইয়ের গল্প। এই ছবিতেই তিনি পাশ্চাত্যের ধ্রুপদী সংগীতকে উল্টো করে বাজিয়ে নেপথ্য সংগীত হিসেবে ব্যবহার করেন।
তাঁর প্রথম ছবি পথের পাঁচালি। অামরা সকলেই জানি যে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে চিত্রায়িত হয়েছে। পথের পাঁচালি, অাপরাজিত ও অাপুর সংসার এই তিনটি ছবি একত্রে বলা হয় অাপু ট্রিলজি। যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধরা হয় পথের পাঁচালিকে। সত্যজিৎ-এর ভাষ্যমতে এই ছবি বানাতে গিয়ে তিনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছবু বানানো শিখেছেন। প্রথমে তাদের ক্যামেরার এঙ্গেল, দৃশ্য ধারণের কৌশল ভুল হবার কারনে এডিটিং রুমে গিয়ে দেখা যেত এডিট করা যাচ্ছে না, কাট করারা যাচ্ছে না। তারপর অাস্তে অাস্তে তিনি শিখলেন।
পথের পাঁচালি বিভিন্ন অান্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শুধু সত্যজিৎকেই নয় বরং সমগ্র বাংলাকেই এক অনন্য উচ্চতার শিখরে নিয়ে গেছিলো। এই ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন দারিদ্র্যের বাস্তবিক সৌন্দর্য্য। এখানে তিনি গবেষণা করেছেন প্রকৃতি নিয়ে, অন্বেষণ করেছেন পার্থিব রুপবৈচিত্র্যের লাবণ্যকে। তার বিরুদ্ধে অবশ্য দারিদ্রকে মহান করে পর্দায় দেখাবার অভিযোগও এসেছে। চলচ্চিত্র অভিনেত্রী নার্গিস দত্ত বলেও দিয়েছেন যে সত্যজিৎ নাকি দারিদ্র্যকে রপ্তানি করছে। পথের পাঁচালিতে অপু-দূর্গার সেই অাইকনিক রেলগাড়ির দৃশ্যটা কার মনে না দাগ কেটেছে! সেই দৃশ্যের মাধ্যমে তিনি প্রতীকী রুপে উপস্থাপিত করেছেন একটা প্রযুক্তির অাগমনের প্রেক্ষিতে অামাদের মননে যে অাশ্চর্যের সঞ্চার ঘটে তারই প্রতিরুপ।
অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি অর্থাৎ অপরাজিততে অামরা দেখতে পাই অপু ট্রেনযাত্রা করে এক শহর থেকে অারেক শহরে এসে পৌঁছায়। এখানে অাশ্চর্যজনক সেই প্রযুক্তিটা এখন একটা নিত্য প্রয়োজন। অার, তৃতীয় ছবিতে রেল স্টেশনের পাশেই অপুর বাড়ি থেকে রেলের শব্দ শোনা গেলে দেখি কিভাবে অভিব্যক্তি দিয়ে অপু বিরক্তি প্রকাশ করে। অর্থাৎ, ধীরে ধীরে প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকটাও যে অাশ্চর্য ও প্রয়োজন ছাপিয়ে এক সময় অামাদের চোখে ধরা দেয় সেটাই এখানে বলা হয়েছে ভিজুয়্যাল স্টোরিটেলিং-এর মাধ্যমে।
তিনি বাংলায় মহানায়ক উত্তম কুমারকে নিয়ে কাজ করেছেন পরপর দুটি ছবিতে নায়ক ও চিড়িয়াখানা। এইই দুটি ছবির মাধ্যমে তিনি এক অন্য উত্তমকে অাবিষ্কার করলেন। নায়কে অামরা দেখি একজন সুপারস্টারের জীবনে গল্প যা ধীরে ধীরে পাখা মেলে তার সাথে একজন সাংবাদিকের সাক্ষাতের মাধ্যমে। নায়ক ছবির পর সত্যজিৎ রায় বলেন 'অামার ভুল হতে পারে তবে উত্তমের অভিনয়ে কোন ভুল নাই' অার এর জবাবে উত্তম কুমার বলেছিলেন 'অামার অার পুরষ্কার লাগবে না। অামার পুরষ্কার পাওয়া হয়ে গেছে।'
কাঞ্চনজঙ্ঘা সত্যজিৎ রায়ের প্রথম মৌলিক গল্প ও প্ররথম রঙিন ছবি। এই ছবিতে তিনি এক অপূর্ণ ন্যারেটিভ ব্যবহার করলেন। ছবির শুরুতে অালোকোজ্জ্বল এক পরিবেশ এবং শুরুতে চরিত্রগুলোর মাঝেও সকল সম্পর্কের ডায়নামিকস্ স্বাভাবিক ও অনুকূল দেখা যায়। ধীরে ধীরে পারিপার্শ্বিকতা কুয়াশায় অাচ্ছাদিত হতে থাকে এবং দেখা যায় ছবির চরিত্রগুলোর মাঝে জটিলতাও বাড়ে। একদম শেষদিকে অামরা দেখবো চরিত্রদের মধ্যকার জটিলতা কাটতে থাকে, কুয়াশায় কেটে যায় অার পরিস্ফুটিত হয় সূর্যের অালোতে প্রদীপ্ত ও ঔজ্জ্বল্যে পরিপূর্ণ কাঞ্চনজঙ্ঘার কাঙ্ক্ষিত চূড়া।
তিনি এখানে প্রকৃতির সাথে মানব সম্পর্কের উত্থানপতন ও টানাপোড়নের মাঝে এক ঐকতান তৈরির চেষ্টা করেছেন যেখানে প্রাকৃতিক স্বভাব ও মানবিক সম্পর্কের অবস্থার মাঝে একটা মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। ঠিক তার উল্টোটা অামরা দেখতে পাই অশনী সংকেতে যেখানে বাংলাদেশের ববিতা মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। অশনী সংকেতে প্রকৃতিগত সৌন্দর্য্যের প্রাচুর্যের প্রেক্ষিতে দেখানো হয় যুদ্ধ-প্রসূত ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও মন্বন্তর পীড়িত চরিত্রের স্বরূপ।
সত্যজিৎ তার শেষের দিকের ছবিগুলোতে ইনডোরে বেশি কাজ করেন। যেমন শাখা-প্রশাখা, অাগুন্তক ও গণশত্রু। এই ছবিগুলো তিনি সংলাপ-নির্ভর উপায়ে বানান। তাঁর শারীরিক অসুস্থতা তাঁর কাজের গণ্ডিকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সীমাবদ্ধ করে দেয়। অথচ, এরপরেও তাঁর কাজে নিজস্বতা, সৃষ্টিশীলতা ও তাঁর চিরাচরিত মুন্সিয়ানার তেমন অভাব দেখা যায় নি। অাগুন্তকে উৎপল দত্তের চরিত্রের মাধ্যমে তিনি যেন নিজেকে পর্দায় এনেছেন।
সত্যজিৎ রায় সবথেকে যেই কারনে স্মরণীয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে অাছেন এবং থাকবেন তা হলো তাঁর মানবঅাবেগ, মানুষিক প্রবৃত্তি, ভাবনা ও অাচরণ নিয়ে কাজ করার প্রবণতা। তিনি সব কিছুর উর্ধ্বে মানুষের অাবেগ ও গল্পকে প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষকে তিনি বুঝতে পেরেছেন। তাই মানুষও তাঁকে গ্রহণ করেছে ও সমাদর করেছে। তাঁর গল্পগুলো বেশ সরল হলেও শক্তিশালী। তাঁকে অামি বলি The Mighty Master of Subtelty। তাঁর সমসাময়িকতা ঋত্বিক ঘটক যেমন জোরালো কণ্ঠে বলেছেন তিনি সেদিক থেকে ছিলেন প্রচ্ছন্ন। সরাসরি না বলে ইশারায় কথা বলেছেন। মেটাফোর, সিম্বলিজম ব্যবহার করেছেন। গভীরে না গিয়েও অনেক গভীর কথা বলেছেন। অার এই কর্মগুণই তাকে মহারাজার অাসন পেতে দিয়েছে।
শেষ করার অাগে দুটি গল্প বলতে চাই।
অামরা অনেকেই হয়ত জানি না স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবি এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল বা ই.টি. সত্যজিৎ-এর লেখা দি এলিয়েনের পাণ্ডুলিপি চুরি করে বানানো হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের সাথে কলোম্বিয়া পিকচার্সের কাজ করার কথা থাকলেও তার অার পরবর্তীতে এগোয় নি এবং সত্যজিৎ-এর জমা দেয়া পাণ্ডুলিপির বিভিন্ন কপি হলিউডে ছড়িয়ে পড়ে। তখন স্পিলবার্গ অবশ্য স্কুলের ছাত্র। কাজ না এগোনোয় ধামাচাপা পড়ে যায়। পরবর্তীতে ই.টি. মুক্তি পেলে সত্যজিৎ রায় স্বয়ং এবং মার্টিন স্করসিজি সহ অারো অনেকেই দি এলিয়েনের স্ক্রিপ্টের সাথে ই.টি.-এর গল্পের সাদৃশ্য খুঁজে পান। সত্যজিৎ-এর এই নিয়ে অাক্ষেপ ছিলো যায় কথা এসেছে তাঁর সাক্ষাৎকারেও।
বলিউডের মহারথী দিলীপ কুমারের সঙ্গে তাঁর কাজ করা হয়ে ওঠেনি একটা শার্টের জন্য। দিলীপ কুমারকে তিনি ওয়াহিদা রহমানের মাধ্যমে একটি গ্রাম্য কৃষকের চরিত্রেরে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। দিলীপ কুমার রাজিও হন। তবে পার্ফেকশনিস্ট সত্যজিৎ বলেন দিলীপ কুমারকে খালি গায়ে এই চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। কারন, গ্রামাঞ্চলের একজন কৃষক বেশিরভাগ সময়ই খালি গায়ে থাকেন। দিলীপ কুমার এই কথা মানতে নারাজ। তাঁর কথা হলো তিনি একজন সুপারস্টার হয়ে খালি গায়ে দর্শকের সামনে অাসতে পারবেন না। এতে তাঁর জনপ্রিয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে। অার, সত্যজিৎও নাছোড়বান্দা। ফলশ্রুতিতে তাঁদের মধ্যে আর কাজ করা হয়ে উঠে নি।