ধর্মান্ধদের আহাজারি আর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ দেখে মনে হচ্ছে, সত্য প্রসাদ মজুমদারের জায়গায় কাজী ইব্রাহিমের মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীকে বুয়েটের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিলেই এরা খুশি হতো...
বুয়েটের নতুন উপাচার্য্য হিসেবে চার বছরের জন্য দায়িত্ব নিয়েছেন অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপক মজুমদারের এই দায়িত্ব প্রাপ্তির খবরটা গণমাধ্যমে প্রকাশ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একদল অমানুষ নেমে পড়েছে নিজেদের পারিবারিক এবং ধর্মীয় পরিচয় দেয়ার কাজে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হচ্ছে এই শিক্ষককে, এবং সব কথার কেন্দ্রবিন্দু একটাই- তিনি নাকি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হবার কারণেই ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন! কেউ কেউ তো আবার তার এই নিয়োগের মাধ্যমে দেশ কিভাবে ভারতের হাতে চলে গেল, হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হয়ে গেল, সেই সমীকরণও আবিস্কার করে ফেলেছেন!
সত্য প্রসাদ মজুমদার বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংবিভাগ থেকে ১৯৮১ সালে স্নাতক ও ১৯৮৫ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। রেজাল্ট খুব ভালো ছিল, তাই ১৯৮১ সালে তিনি নিজের বিভাগেই প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৯১ সালে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি), খড়গপুর থেকে ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। উপাচার্য হবার আগে তিনি বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক ও নিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দায়িত্বপালন করেছেন।
যা বলছিলাম, অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারকে যে তার যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার কারণেই উপাচার্যের পদটা দেয়া হয়েছে, সেটা মাথায় ঘিলু থাকলে যে কেউই বুঝবে। যোগ্যতার পাশাপাশি আনুগত্যও একটা কারণ। বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদেই সরকারের প্রতি অনুগত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়, এটা বিএনপির আমলে যেমন হয়েছে, আওয়ামী লিগের আমলেও সেই ধারা বজায় আছে। সত্য প্রসাদ মজুমদারের বেলাতেও সেটার ব্যতিক্রম ঘটেনি বলেই ধারণা করি।
কিন্ত সেটা পুরোপুরি আলাদা একটা ইস্যু। এর সঙ্গে তার ধর্মকে টেনে এনে গালাগাল দেয়ার কোন যুক্তিই নেই। কিন্ত ধর্মান্ধ লোকজন তো আর যুক্তির ধার ধারে না। সত্য প্রসাদ মজুমদার যদি সরকারের অনুগত হয়েও থাকেন, সেটার সমালোচনা হবে তার কাজের দ্বারা। বুয়েটের সদ্য বিদায়ী ভিসি যেমন আবরার হত্যার পরে দুইদিন গায়েব ছিলেন, এমন কোন কাজ করলে, সরকারী ছাত্র সংগঠনকে প্রশ্রয় দিলে, নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত হলে, দুর্নীতিতে জড়ালে নিশ্চয়ই তার সমালোচনা করা যাবে। কিন্ত তার আগেই কেন এই মানুষটাকে ধর্ম টেনে এনে গালিগালাজ করা হচ্ছে, কটুকথা বলা হচ্ছে? নব্বই পার্সেন্ট মুসলমানের দেশে কি হিন্দু হওয়াটা অপরাধ? নাকি হিন্দু কারো বুয়েটের বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়াটা অপরাধ?
খবরগুলোর নিচে এসব কমেন্ট পড়লে যে কারোরই মনে হবে, দেশটা বুঝি ভারতের অঙ্গরাজ্য হয়ে গেছে, দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে আছে র এজেন্টরা। এই ধর্মান্ধদের অভিযোগ, সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নাকি হিন্দুদের বসিয়ে রাখা হয়েছে। জাতীয় সংসদে হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাংসদ কতজন? সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী কিংবা র্যাব-পুলিশের প্রধান পদগুলোতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাটা কিরকম? সচিব-অতিরিক্ত সচিব বা উপসচিব পদমর্যাদায় কয়জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী কর্মরত আছেন? আর থাকলেই বা দেশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে কেন?
ভারতে একই কাজটা করে কট্টরপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলো। মুসলমানরা বেশি বাচ্চা নেয়ায় মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, ভালো ভালো পদে মুসলমানরা আসছে, একসময় ভারতে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে- এসব গুজব রটিয়ে তারা ভোটের মাঠে সুবিধা নিতে চায়, সাধারণ মানুষকে সেখানকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। বাংলাদেশেও একই কাজটাই চলছে, শুধু স্থান আর পাত্র আলাদা।
কমেন্টবক্সে এই লোকগুলোর আহাজারি আর ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ দেখে মনে হচ্ছে, সত্য প্রসাদ মজুমদারের জায়গায় কাজী ইব্রাহিমের মতো বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের বুয়েটের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল। তাহলেই এরা খুশি হতো। বুয়েট যে দেশে সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, এটা কোন কওমি মাদ্রাসা নয় যে এখানে কামিল পাশ কোন মাওলানাকে এনে বসিয়ে দেয়া হবে- সেটা এদের ঘিলুতে ঢোকে না। এদের দৌড় ওই কমেন্টবক্সে নোংরামি করা পর্যন্তই।
এই ধর্মান্ধরা ভারতকে দিন-রাত গালি দেয়। অথচ ভারতে বিজেপির আমলেই এপিজে আবদুল কালামের মতো মানুষ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, যার জন্ম হয়েছিল তামিলনাড়ুর এক মুসলমান এক পরিবারে। একবার ভাবুন তো, বাংলাদেশে কোনদিন হিন্দু ধর্মাবলম্বী কেউ প্রেসিডেন্ট হলে এরা কি করবে তখন? বুয়েটের ভিসি হওয়াতেই এদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর নোংরামির যন্ত্রণায় টিকে থাকা যাচ্ছে না, এমন কোন ঘটনা ঘটলে তো এরা দলে দলে রাস্তায় নেমে আসবে বোধহয়!
কিছুদিন আগে আমেরিকায় পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড খুন হলেন, গোটা আমেরিকা উত্তাল হয়ে উঠলো সেই ঘটনার বিচারের দাবীতে। সেটার ঢেউ এসে লেগেছিল আমাদের দেশেও। অজস্র মানুষ সেই ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর হওয়া নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন, শ্বেতাঙ্গদের মতো তাদেরও সমান নাগরিক অধিকার দেয়া হোক বলে ফেসবুকে লিখেছেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যাদেরকে ব্যথিত করেছিল, তাদের অনেকেও কিন্ত এই গালিবাজদের দলে আছেন। মানে, সমঅধিকার তারা বাকী বিশ্বের জন্য চায়, শুধু নিজের দেশের বেলায় নিজের ধর্মটা সবার ওপরে থাকবে! হিপোক্রেসির তো একটা লিমিট থাকে! আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যুতে এরা শোক জানায়, আর নিজের দেশে অন্য ধর্মের কেউ বুয়েটের ভিসি হলে তাকে গালি দেয়, গোটা ঘটনার পেছনে ইসকনের ষড়যন্ত্র আর ভারতের চক্রান্ত আবিস্কার করে ফেলে! এই কিউট রামছাগলের পালে দেশ ভরে যাচ্ছে। সুশিক্ষার চেয়ে স্বশিক্ষাটা যে বেশি দরকার, কমনসেন্সের ব্যবহারটা যে খুব বেশি জরুরী- সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই ঘটনাগুলো।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমাদের দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বলে একটা আইন আছে। সরকারের কোন মন্ত্রীর সমালোচনা করে কার্টুন আঁকলেও এই আইনের আওতায় গ্রেফতার হয়ে আপনি জেলে চলে যাবে। কিন্ত গালিগালাজ করে, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিষবাস্প ছড়ালেও এই আইন আপনার ওপর বলবৎ না-ও হতে পারে। এপর্যন্ত তো এমন কোন ঘটনা ঘটতে দেখিনি আমরা...