মার্স ভাইরাস, ইবোলার মতো মহামারীকে ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেই সারাহ গিলবার্টের দিকে তাকিয়ে আছে এখন পুরো দুনিয়া, করোনার প্রতিষেধক আবিস্কার করেছেন তিনি!

১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইংল্যান্ডের ক্যাটেরিং গার্লজ হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল সদ্য কৈশোরে পা দেয়া মেয়েটা। বন্ধুবান্ধব ছিল না কেউই, নিজের মতো চুপচাপ থাকতো। কারো সঙ্গে মিশতে পারত না আগ বাড়িয়ে। টিফিন পিরিয়ডে তাকে খুঁজে পাওয়া যেতো স্কুলের লাইব্রেরীতে, উঁচু ক্লাসের বিজ্ঞানের বই নিয়ে বসে আছে সে। ভালো ছাত্রী ছিল মেয়েটা, শিক্ষকেরাও জানতেন সেটা। কিন্ত ও লেভেলের পরীক্ষায় যখন ছয়টা সাবজেক্টে এ-গ্রেড পেয়ে গেল সে, তখন চোখ কপালে উঠলো সবার! কী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে সারাহ গিলবার্ট নামের মেয়েটা!

সত্তর দশকের যে কিশোরীর গল্প শোনাচ্ছিলাম, তিনি এখন পরিপূর্ণ নারী, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনোলোজির প্রফেসর হিসেবে কর্মরত আছেন ভদ্রমহিলা। করোনার থাবায় বিপর্যস্ত মানবজাতিকে রক্ষার সংকল্প নিয়ে ভ্যাকসিন আবিস্কারে যিনি অবিরাম কাজ করে চলেছেন, মাসের পর মাস ধরে পড়ে আছেন গবেষণাগারে- যাকে ঘিরে আশায় বুক বাঁধছেন সবাই, যে মানুষটার দিকে ভরসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিশ্বের রথী-মহারথী দেশ আর রাষ্ট্রপ্রধানেরা- তিনিই প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট।

করোনার প্রতিষেধক আবিস্কারে ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের যে দলটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সারাহ গিলবার্ট। ইতিমধ্যেই চ্যাডক্স-১ নামের একটা টিকা আবিস্কার করেছেন তারা। ইংল্যান্ডজুড়ে বিভিন্ন বয়স ও শারীরিক সামর্থ্যের প্রায় আটশো জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর প্রয়োগ করা হবে এই টিকা। সারাহ দাবী করেছেন, তারা মোটামুটি ৮০% নিশ্চিত যে, তাদের আবিস্কৃত এই প্রতিষেধক করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে। ৮০% বিশাল একটা সম্ভাবনা, এটাকে হেলাফেলা করার কোন উপায় নেই।

প্রফেসর সারাহ গিলবার্ট

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে আফ্রিকা কাপিয়েছিলো মার্স এবং ইবোলা নামের দুটি ভাইরাস। পশ্চিম আফ্রিকায় প্রাদুর্ভাব হওয়া এই দুই মহামারিতে প্রায় সাড়ে তেরো হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। সংখ্যাটা লক্ষাধিক হতে পারতো, টানা কয়েক বছর ধরে বিশাল এলাকাজুড়ে চলতে পারতো এর তাণ্ডব, ছড়িয়ে পড়তে পারতো এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকায়। সেটা সম্ভব হয়নি সারাহ গিলবার্টের কারণে। দুইবারই এই ভাইরাসগুলোকে রুখতে দিশা দেখিয়েছিলেন মহীয়সী এই নারী বিজ্ঞানী, সেগুলোর প্রতিষেধক আবিস্কার হয়েছিল তার হাতে।

আরও একবার মানবসভ্যতা যখন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে, করোনার প্রকোপে অর্থনীতির এভারেস্ট ধ্বসে পড়েছে, লাশের স্তুপ জমছে সর্বত্র, ইউরোপ থেকে আমেরিকা- প্রতিটা জায়গা পরিণত হয়েছে শ্মশানে, তখন আরও একবার অন্ধকারের বুক চিরে আলো হাতে সম্মুখ সমরে এসে দাঁড়িয়েছেন সারাহ গিলবার্ট। নিজের দলবল নিয়ে ঢুকেছেন ল্যাবরেটরিতে, দিনরাত এক করে চালিয়েছেন গবেষণা। তিন মাসের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অবশেষে একটা ভ্যাক্সিন আবিস্কারে সক্ষম হয়েছেন তারা, সেটার পরীক্ষামূলক ফলাফল হাতে পেলেই বোঝা যাবে, এই মিশনে কতখানি সফল হতে পেরেছেন তারা।

ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণার একটা পর্যায়ে সারাহ এবং তার দল বুঝতে পেরেছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসকে দমন করতে পারবে শিম্পাঞ্জির শরীরে সর্দি-কাশির ফলে জন্ম নেয়া অ্যান্টিবডি। সেভাবেই শিম্পাঞ্জির সাধারণ সর্দির ভাইরাসের দুর্বল সংস্করণ, যেটার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাডেনোভাইরাস- সেটা ব্যবহার করে ‘চ্যাডক্স-১’ নামের এই ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেছেন সারাহ গিলবার্ট এন্ড টিম। তাদের প্রত্যাশা, আবিষ্কৃত এই টিকা শরীরে দিলেই মানবদেহে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হবে, যা ঠেকিয়ে দেবে করোনাভাইরাসকে।

স্বেচ্ছাসেবীদের শরীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে টিকা

চিকিৎসা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য বিশারদ, যারা করোনাভাইরাসের গতি-প্রকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য নিয়ে খোঁজ-খবর তাখেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করছেন, সারাহ ও তার দলের আবিকৃত এই ‘চ্যাডক্স-১’ একটি সুপার ভ্যাক্সিন। কারণ এর আগে করোনার যেসব ভ্যাক্সিন আবিস্কৃত হয়েছে, সেগুলো বানাতে অনেক লম্বা সময় লেগেছে। প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেই প্রচুর সময় নষ্ট করেছে সেগুলো, ফলাফলও আশাব্যাঞ্জক ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, এবারের আবিস্কারের পেছনে সারাহ গিলবার্টের নামটা আছে, যিনি এর আগে মার্স ও ইবোলাকে পরাস্ত করেছেন। তাই আশায় বুক বাঁধতে চাইছেন সবাই।

আর সারাহ গিলবার্ট- যার দিকে তাকিয়ে আছে পুরো দুনিয়া, তিনি নিজে কি বলছেন? সারাহ’র কথা হচ্ছে- “আমি এ ধরনের প্রতিষেধক নিয়ে আগেও কাজ করেছি। করোনাভাইরাস গোত্রেরই মার্স-এর প্রতিষেধক নিয়ে কাজ করেছি। এর কী ক্ষমতা তা জানি। আমার বিশ্বাস, এই প্রতিষেধক কাজ করবে। ব্যক্তিগতভাবে, এটি কাজ করবে বলে আমি ৮০ পার্সেন্ট আত্মবিশ্বাসী। তবে তার আগে এটি নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা করতে হবে আমাদের, সময় দিতে হবে।”

সারাহ’র আবিস্কৃত টিকা একদিন আগেই দু’জন স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রবেশ করানো হয়েছে, পর্যায়ক্রমে আরও প্রায় ৫০০-৮০০ জন মানুষের শরীরে দেয়া হবে এই টিকা। করোনাভাইরাস হয়তো হার মেনে যাবে মানুষের অদম্য পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তার কাছে, সারাহ গিলবার্টের মতো মানুষগুলো যে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেখানে মানবজাতি হারতে পারে না। এই যুদ্ধে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধানরা হেরে গেছে, টাকার কুতুবরা অসহায়, ধর্মের ধ্বজাধারী মোল্লা-ঠাকুর-বিশপরা সবাই পালিয়েছে- টিকে আছেন কেবল বিজ্ঞানীরা, টিকে আছেন সারাহ গিলবার্ট।

আগুনের এই দিন ফুরিয়ে যাবে, প্রচারবিমুখ সারাহ গিলবার্টকে তখন খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। এখন মিডিয়ার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা মানুষটা চলে যাবেন আপন নিবাসে, নিভৃত এক জগতে, যেখানে তিনি থাকতে পছন্দ করেন। ক্লাস নেবেন, গবেষণা করবেন, কুকুরকে নিয়ে পার্কে হাঁটতে বেরুবেন। গবেষণাটা সফল হলে হয়তো নোবেল পুরস্কারটাও দেয়া হবে তাকে- তাতে তার জীবন বদলাবে না, ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবটাও বদলাবে না। অর্থ-বিত্ত-বা খ্যাতি তো সারাহদের টানে না, আবারও যদি কখনও মানব সভ্যতা এমন হুমকির মুখে পড়ে, তখনই শুধু এগিয়ে এসে যুদ্ধের ব্যাটনটা হাতে তুলে নেবেন সারাহ, তার আগে নয়...

কথা বলুন নিঃসংকোচে

প্রিয় পাঠক, করোনার এই দিনগুলিতে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হতেই পারেন আপনি। সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক, মানসিক- বা অন্য কিছু। আপনার সমস্যার কথা জানান আমাদের, আমরা চেষ্টা করব সেটা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অবহিত করার, যাতে বেরিয়ে আসে সমাধানের পথ।

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা